সমন্বয় ও উন্নয়ন : মেয়রের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স

60

অভীক ওসমান

২০২০ সালে ১৫ ফেব্রæয়ারি ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে সুধী সমাবেশের পর বিকেলে টাইগারপাসস্থ নগর ভবনের অস্থায়ী কার্যালয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এর মেয়র ও ওয়ার্ড কমিশনাররা দায়িত্ব বুঝে নিলেন। এরপর জাতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেলের এক টকশোতে অংশ নিয়ে আমি মূলত চট্টগ্রামের পৌরসভা/সিটি কর্পোরেশনের অতীত প্রশাসক,চেয়ারম্যান ও মেয়রদের সফলতাগুলো তুলে ধরেছিলাম।
পূর্বসূরিগণ : অতীতে চট্টগ্রাম পৌরসভার দীর্ঘ মেয়াদের চেয়াম্যনের দায়িত্বপালন কালে নুর আহমদ চেয়ারম্যান পূর্ব পাকিস্তানের প্রাথমিক শিক্ষার প্রথম জনক হিসেবে কিংবদন্তী হয়ে আছেন। পরবর্তীতে স্বাধীনতার পর ফলমন্ডির মালিক ফজল করিম চেয়ারম্যান হন। তিনি জনহিতৈষী ছিলেন। বিশেষত তিনি স্যানিটেশন জোন ও সুয়ারেজের কিছু উন্নয়ন করেছেন যা মানুষ এখনো স্মরণ করে। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র বেবী আমার বন্ধু এবং চেয়ারম্যানের স্ত্রী সারাক্ষণ মাথায় গোলাপ ফুল গুজে থাকতেন। এসব কিছু সাধারণ মানুষের কাছে আন্তরিকতা ও প্রিয়তা পেয়েছে।
এরপর ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাÐের পরে ব্রিগেডিয়ার মফিজুর রহমানকে চট্টগ্রাম পৌরসভার প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়। বিগ্রেডিয়ার মফিজুর রহমান, ব্যারিস্টার সুলতান আহমদ চৌধুরী, সেকান্দার হোসেন মিয়া- এই তিন জনকে পর্যায়ক্রমে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল।
পরবর্তীতে মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরীর সময় পৌরসভা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত হয়। আমরা নাগরিক হিসেবে পর্যবেক্ষণ করেছি মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী ছাত্রজীবন থেকেই বুদ্ধিমান এবং প্রজ্ঞাবান ছিলেন। তাঁকে প্রথমে উপমন্ত্রী এবং পরের দিনই তাঁকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দেয়া হয়। চট্টগ্রামের উন্নয়নের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অত্যন্ত আন্তরিক। গত শতাব্দীর শেষ দশকের শুরুতে বিএনপির মীর নাসির উদ্দীন মেয়রের পদে আসীন হন। তিনি ট্যাক্স আদায়, সড়ক নির্মাণ, ৯১ এর ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখেন।
গত শতাব্দীর রাজনীতির ইতিবাচক দিক হলো বিএনপি শাসনামলে চট্টগ্রামে আবুল বাশার মোহাম্মদ মহিউদ্দিন চৌধুরী (পরিচিত নাম মহিউদ্দিন চৌধুরী ) বিপুল ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। মধুর বিষয় হচ্ছে যে, বিমান বন্দরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে প্রটোকল করতে গেলে বেগম জিয়া মেয়র মহিউদ্দিনকে স্মিত হাসি দিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়নের আশ্বাস দিয়েছিলেন। এক কথায় বলতে গেলে তিন তিনবারের নির্বাচিত মেয়র মহিউদ্দিনের কোনো তুলনা নেই। তার মৃত্যুতে আমি ব্যক্তিগতভাবে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে ছিলাম-‘ দ্যা লাষ্ট পাবলিক লিডার’। একজন সাংবাদিক মন্তব্য করেছিলেন, ‘দ্যা লাস্ট পাবলিক লীডার অফ চিটাগাং’। আসলে ঢাকাকে/কেন্দ্রকে হিট করার মতো এমন আঞ্চলিক নেতা এক দফার প্রবক্তা আর গড়ে উঠেনি। অথচ যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিম বঙ্গসহ প্রত্যেক রাজ্যে কেন্দ্রকে হিট করার মতো অনেক নেতা বিশেষ করে কংগ্রেস-এ আছে। এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরি, নুর আহমদ চেয়ারম্যানের প্রাথমিক শিক্ষাকে বর্ধিত করে কলেজ পর্যন্ত করেছেন। এমন কি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমি ২০০০ সালে যখন মার্কিন মুল্লুক ভ্রমণ করি তখন কূটনৈতিক পাড়ায় মহিউদ্দিন চৌধূরীর সুনাম শুনেছি। আশ্চর্য যে সারাক্ষণ মুখে গালি দেয়া চট্টগ্রামের এ নেতা সংস্কৃতির উন্নয়নের জন্য টিএসসি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তিনি কর্পোরেশনের কর্মকর্তাদের জন্য আলাদা নার্সিং ইন্সটিটিউট নির্মাণ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য আলাদা প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট, হাসপাতালের প্যারাসিটামলের জন্য আলাদা ল্যাব নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার এসকল কর্মের জন্য করোনাকালীন সময়েও চট্টগ্রামবাসী ‘’হন্ডে আঁরার মহিউদ্দিন চৌধুরী’’ বলে আর্তনাদ করেছেন। সবচেয়ে বড় ট্রাজেডী হলো তার শিষ্য ও কর্মী মনজুর আলমের কাছে তিনি নির্বাচনে হেরে যান। মনজুর আলম প্রশাসকের চাইতেও বেহেতর হলো তিনি একজন সজ্জন ভদ্রলোক।
আবু জাহেদ মো.নাছির উদ্দীন (পরিচিত নাম- আ.জ.ম. নাছির উদ্দীন) চট্টগ্রাম কলেজে আমার বন্ধু ছিলেন এবং ছাত্রলীগের এক অংশের সভাপতি ছিলেন। ছাত্র রাজনীতিতে তার নির্বাসনসহ অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা রিয়েছে। চট্টগ্রামে বিল বোর্ড উচ্ছেদসহ করোনাকালে ও অনেক কাজ করেছেন তিনি। ছয় মাসের প্রশাসক থাকাকালীন গত শতাব্দীর ছাত্র নেতা ও সংস্কৃতিমনস্ক খোরশেদ আলম সুজন কর্পোরেশনের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে ভেসপা চালিয়ে সুনাম অর্জন করেছেন।
এবার গত ২৭ জানুয়ারি অভিজাত ঘরের সন্তান ছাত্রজীবন থেকে প্রতিভাবান রাজনীতিবিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম চৌধুরী নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁকে আমরা অভিনন্দন ও সাধুবাদ জানাচ্ছি। এসব ইতিবাচক কথাগুলো বলা হলো যাতে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী পূর্বসূরিদের আদলে অনুপ্রাণিত হন।
চসিক কার্যক্রমের টেরিটরি ও মেয়রদের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স :
এবার আমরা মূল প্রসঙ্গে আসি। আমরা শুনেছি যে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এর কাজ হলো জলাবদ্ধতা নিরসন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা। এ সকল উন্নয়নের সমন্বয়ের জন্য চট্টগ্রামের সরকারি সংস্থাগুলোর আন্ত বিভাগীয় সমন্বয় অতি আবশ্যক। প্রথম বিষয় হলো-অতীতে আ জ ম নাসিরের গাড়ীতে পতাকা উড়েছে। কিন্তু তার মেয়াদ কালের শেষে জনগণ জানতে পারলো যে, তার পদটি অতিরিক্ত সচিব মর্যাদার। গত শতাব্দীতে বিকেন্দ্রীকরণের ফলে বর্তমানে চট্টগ্রামের জিওসি, নৌ বাহিনী, বিমান বাহিনীর চট্টগ্রামের অঞ্চল প্রধানগণ, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, কাস্টমস, বন্দর, ইষ্টার্ণ রিফাইনারি, ডক ইয়ার্ড, শিপিং কর্পোরেশন, কেজিডিসিএল, চা বোর্ড, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল, ওয়াসা, সিডিএ প্রধানগণ অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদা)। অবশ্য নাছির ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম যে সভা ডেকেছিলেন তাতে সকল সরকারি অফিসের বিভাগীয় প্রধানগণ নাছিরকে সমীহ করে উপস্থিত ছিলেন। পরে তারা নিম্নপর্যায়ের কর্মকর্তাদের পাঠানো শুরু করেন। এক জন অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার লোক ডাকলে তারা কেন আসবেন। দ্বিতীয় পয়েন্ট হলো, চট্টগ্রামের সার্বিক উন্নয়নের দেখভাল এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে।অতীতে চট্টগ্রামের উন্নয়নের দায়িত্ব একজন মন্ত্রীর হাতে থাকতো উদাহরণ স্বরুপ- আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। এরা চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেন। বিষয়টা হয়তো সেমি অফিসিয়াল।
একবিংশ শতাব্দীতে চসিকের গুরুত্ব :
একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষের প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামে গুরুত্ব বহুগুণ বেড়ে গেছে। এখানে, বন্দর, বে টার্মিনাল, মাতারবাড়ী সমুদ্র বন্দর, কর্ণফুলি টানেল, কক্সবাজার- ঘুনধুম রেল লাইন, অনেকগুলো ইপিজেড, এশিয়ান হাইওয়েসহ অনেক উন্নয়ন প্রকলের কাজ চলছে। এ সকল উন্নয়নের জন্য দরকার আন্ত বিভাগীয় সমন্বয়। সেখানে এমন একটা সিস্টেম তৈরী হয়ে গেছে যে, সিটি কর্পোরেশন রাস্তা ঠিক করে গেলে ওয়াসা খোড়াখুড়ি শুরু করে, ওয়াসা কাজ শেষ করলে টি এন্ড টি / কে জি ডি সি এল কাজ শুরু করে। এই সমন্বয়হীনতার কারনেই সারা বছর সড়ক উন্নয়নের কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে সি ডি এর ও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। আমাদের জানা মতে, কেনইবা পরবর্তীতে মেয়রদের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা বহাল রইলো না তা মাননীয় প্রধান মন্ত্রী ও এল জি আর ডি মন্ত্রী বিবেচনা করে দেখতে পারেন। আগামীর মেয়রকে জনগণের কাছে একটা জিনিস ক্লিয়ার করতে হবে যাতে সাধারণত নাগরিকগণ মেয়রকে সকল কিছুর জন্য দায়ী করেন। কেউ বৌ তালাক দিলো, সতীন সতীনে ঝগড়া করলো এর জন্য ও মেয়রকে দায়ী করা হয়। তাই আগামীর মেয়রকে তার কর্ম পরিধি জনগণের কাছে পরিষ্কার করতে হবে মোটিভেশনাল ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে। সবিনয় নিবেদন এই যে, মেয়র যাতে আন্ত বিভাগীয় সমন্বয়পূর্বক উন্নয়ন করতে পারেন তার জন্য ঢাকার মতো তার ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স পূর্বের প্রতিমন্ত্রী মর্যাদা দেবার বিষয় পুনর্বিবেচনা করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে আবেদন রইলো।
সর্বশেষে কিঞ্চিত কথকথা :
নাগরিকদের পক্ষ থেকে সজ্জন ও সংস্কতিমনা মেয়রের কাছে কিছু আবেদন জানাতে চাই-লালদীঘির মোড়ে জাইকার অর্থায়নে নির্মিত লাইব্রেরির পাশাপাশি একটি মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর, আর্কাইভ, এবং কম টাকায় শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিভিন্ন সভা করা যায় এমন একটি কক্ষ বরাদ্দ করা হোক। এক্ষেত্রে ফিনিন্সিয়াল আউটসোর্সিংয়ে প্রাইভেট সেক্টরের সহায়তা নেয়া যেতে পারে।
সম্মানিত মেয়র, বাইরের অর্নামেন্টাল সভায় উপস্থিত না হয়ে যদি ফাইল ও ফিল্ডে অধিক সময় দেন তবে প্রোডাক্টিভিটি ও ইমেজ বাড়বে। প্রত্যেক ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের এক্ষেত্রে ‘’কম কিন্তু পারফেক্ট’’ – নীতি অনুসরণ করে প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলরদের একটি করে সড়ক, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উন্নয়নের জন্য মডেল প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া উচিৎ। আমরা আশা করবো যে, কর্পোরেশনের রাজস্ব ঘাটতি, এডজাস্ট করার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর, রেল সহ নগরের অন্যান্য সরকারি সকল সংস্থা থেকে ফান্ড সোর্সিং করতে হবে।
আজাদীতে একজন নারী কলামিস্ট লিখেছিলেন- মেগা সিটি চাই না, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন নগর চাই। একাত্তর পূর্ববর্তী জাতীয়তাবাদের উত্থানপর্বে ছাত্রনেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা, নির্লোভ, সৎ, সাহসী, সমাজ উন্নয়নে সমতার চিন্তক অভিজাত ঘরের সন্তান রেজাউল করিম চৌধুরীর নেতৃত্বে আগামীতে সুন্দর পরিচ্ছন্ন স্বাস্থ্যসম্মত একটি কর্পোরেশন গড়ে উঠুক এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: চিটাগাং চেম্বারের সাবেক সচিব ও সিইও, লেখক, অর্থনীতি ও উন্নয়ন গবেষক