সংবাদমাধ্যমের স্বকীয়তা অক্ষুন্ন রাখতে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগী হতে হবে

17

 

আধুনিক জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। মাধ্যমগুলোর মধ্যে রয়েছে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, টুইটার, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, লিংকডইন, পিন্টারেস্ট, টাম্বলার, ভাইবার, স্ন্যাপচ্যাট, উইচ্যাট ইত্যাদি। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে ফেসবুক। এযাবৎকালে আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় সামাজিক মাধ্যমের নাম ফেসবুক। ২০২১ সালের এপ্রিলে পরিচালিত একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপে দেখা যায় বিশ্বে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২৯০ কোটির অধিক। আর বাংলাদেশে এই সংখ্যা চার কোটি ১০ লাখ। ফেসবুক ব্যবহারকারীর কাছে এখন আর সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ তাদের কাছে ব্যক্তিগত স¤প্রচার মাধ্যম শুধুই ফেইসবুক। তবে বিপদ হচ্ছে, ফেইসবুকের পোস্ট বা স্ট্যাটাসগুলোকে যখন সংবাদ হিসাবে গ্রহণ করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সংবাদ মাধ্যম হতে পারবে না। অন্তত বর্তমান প্রেক্ষাপট তাই বলছে। ফেইসবুকের ¯্রষ্টা মার্ক জুকারবার্গ নিজেই ‘ভ্রান্ত খবর’ ঠেকাতে ফেসবুকে ব্যক্তিগত টাইমলাইনে সংবাদকে প্রাধান্য কম দেওয়ার ঘোষণা দিলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যক্তিগত কোনো পোস্ট বড়জোর সংবাদের তথ্য হতে পারে, সেটাও নির্ভর করবে সত্যতা যাচাই-বাছাইয়ের উপর। আমরা লক্ষ্য করছি, সারা পৃথিবীতে সামাজিক মাধ্যমগুলো বিভিন্ন ফেক ছবি ও উস্কানিমূলক পোস্ট দিয়ে মারাত্মকভাবে বিভ্রান্ত ছড়াচ্ছে। এজন্য ‘ভ্রান্ত সংবাদ’ বা ‘ফেক নিউজ’ ঠেকাতে দুনিয়াজুড়ে চলছে তৎপরতা। ইন্দোনেশিয়া ও সিঙ্গাপুরে সরকারের ক্যাম্পেইন রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেক নিউজ চেনার বিষয়ে জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে। আমাদের দেশেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো ফেক ছবি নিয়ে বিভিন্ন সময় ঘটেছে বিশৃঙ্খলা। যেটা প্রমাণ করে এই মাধ্যমটি সংবাদ মাধ্যম হয়ে ওঠার জন্য কতটা পিছিয়ে। সম্প্রতি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুর্গাপূজার মন্ডপে কুরআন শরীফ পাওয়া এবং এনিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ফেক ছবির ছড়াছড়িতে দেশ চরম বিশৃঙ্খলার মুখে পড়েছিল। গত সোমবার বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের একটি পিলারের ফাটলের যে ছবি ভাইরাল হয় এবং গণমাধ্যমগুলো যে ছবিকে সম্বল করে দেশব্যাপী ঝড় তুলেছে-অবশেষে বলা হচ্ছে সেই ছবি ফেক। পিলারে কোন ফাটল ধরেনি। অথচ ফাটলের কথা শুনে নগর কর্তৃপক্ষ ও সেবা সংস্থার প্রকৌশলীরা নানা মন্তব্য করেছেন; কথিত ফাটলের কারণে ওই অংশে গাড়ি চলাচলও বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। এতে আতঙ্ক ও দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে সাধারণ নাগরিকদের। গতকাল বৃহস্পতিবার দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ বিশ্লেষণে উল্লেখ করা হয়, বিকাশমান তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থার কল্যাণে সামাজিক মাধ্যম, মোবাইল, ক্যামেরা এবং ভিডিওর ব্যবহার প্রচলিত সাংবাদিকতাকে ভেঙে দিচ্ছে, নানাভাবেই মুহূর্তের মধ্যেই নানা তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে- এই বিষয়টি নানাভাবে বিপদসংকুলও করে ফেলছে সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বকে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এটি কখনও কখনও ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। দেশে এখনও ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিষয়ে বেশিরভাগ মানুষেরই স্পষ্ট ধারণা নেই। তাদের ওপর ভ্রান্ত সংবাদ, গুজব বা অপপ্রচার, এডিটেড ভিডিও মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করছে। কখনও কখনও মিথ্যা সংবাদ এবং এডিটেড ভিডিও ভিজুয়্যাল ম্যাটার দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে এবং মুহূর্তেই সমাজকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। সামাজিক মাধ্যমের এই ব্যাপক প্রভাবকে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করছে নানা শ্রেণি ও দল, ব্যবহার করা হচ্ছে স্বার্থগত ফায়দা হাসিলে।
মুলতঃ বহদ্দারহাটের পিলার ফাটল সংক্রান্ত সংবাদ থেকে এ বিশ্লেষণটি। এতে বলা হয়, পিলারের দৃশ্যমান ফাটল সদৃশ অংশটা আদৌ ফাটল কিনা তা যথার্থভাবে খতিয়ে দেখার বিষয়টির প্রতি জাস্টিস হয়েছে কিনা এমন প্রশ্ন আসছে যখন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞরা বলছেন এটা ফাটল নয়। তাহলে কেবল একটা ছবিকে নিউজ সোর্স হিসেবে নিয়ে কয়েকজন প্রকৌশলী যারা নিজেরাও ঘরে বসে কমেন্ট করেছেন তাদের বক্তব্য দিয়ে নিউজ হয়ে গেল। যোগ হলো আতঙ্কের সাথে বিস্ময়। এ জায়গাতে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন সোশ্যাল মিডিয়া এখন নিউজ মিডিয়াকে নাচাচ্ছে। এসব ঘটনা প্রমাণ করে, যে সব তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তা কোনভাবেই সংবাদ নয়। এটিকে সুস্পষ্টভাবেই বলা হচ্ছে ‘পোস্ট’ বা ‘স্ট্যাটাস’। তবে সাংবাদিক যদি সেই তথ্য যাচাই-বাছাই করে সংবাদ মাধ্যমে উপস্থাপন করেন, তখন সেটি সংবাদ হয়ে উঠবে। আমাদেরও মনে রাখতে হবে, ‘দুটো মাধ্যমের নাম সুস্পষ্টভাবেই ভিন্ন। একটি সংবাদ মাধ্যম। আর অন্যটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। দুটোর দায়বদ্ধতাও ভিন্নতর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যক্তি মনের মর্জিমতো কথা বলে, মিথ্যা বললেও তার দায়বদ্ধতা নেই। তবে সংবাদ মাধ্যমের রয়েছে দায়বদ্ধতা। সংবাদমাধ্যমের কন্টেন্ট বাস্তবতা। তাই চূড়ান্তভাবে মানুষ সংবাদ মাধ্যমের তথ্যকেই গ্রহণ করবেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নয়। সংবাদ মাধ্যমের যে স্বকীয়তা ও বিশ্বস্ততা তা যেন সামাজিক মাধ্যমের কাছে হারিয়ে না যায়-এমনটি উদ্যোগ নিতে হবে সংশ্লিষ্টদের।