সংবাদপত্র শিল্পের বিকাশে আবদুল্লাহ আল ছগীরের অবদান

4

মুহাম্মদ শামসুল হক

চট্টগ্রামের সংবাদপত্র শিল্প ও সাংবাদিকতার বিকাশে যাঁরা অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব দৈনিক নয়াবাংলা সম্পাদক আবদুল্লাহ-আল-ছগীর। তিনি সদালাপী, বন্ধুবৎসল, অমায়িক সমাজহিতৈষী ব্যক্তি হিসেবে সুধী সমাজে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। ১৯৭৮ সালে চট্টগ্রামে যখন মাত্র দুটি পত্রিকা (দৈনিক আজাদী, দৈনিক স্বাধীনতা) পাঠকের কাছে সুপরিচিত ছিল তখন অনেকটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে তিনি দৈনিক নয়াবাংলা পত্রিকা বের করেন। ওই বছর ৩০ আগস্ট নয়াবাংলা বের হবার পর থেকেই পত্রিকাটিকে বিশ্বাসভাজন করে পাঠকের কাছে পৌঁছানোর জন্য তাঁর মেধা ও কৌশলী ভ‚মিকা অনেকের দৃষ্টি কাড়ে। অল্প কয়েকমাসের মধ্যে এটি শহর ছাড়িয়ে মফস্বল এলাকায়ও পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। এর পেছনে ছিল সম্পাদক আবদুল্লাহ আল ছগীরের কঠোর পরিশ্রম, দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষমতা, যোগ্যতা ও দক্ষতা। যে কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য সাংবাদিক-কর্মচারীদের সঙ্গে বোঝাপড়ার মানসিকতা ছিল তাঁর। নবীন, বিশেষত মফস্বল সাংবাদিকদের নানাভাবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য ও দক্ষ করে তুলে পত্রিকার মানোন্নয়নে তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টা ছিল লক্ষণীয়। তাঁর সান্নিধ্যে থেকে এবং নয়াবাংলা পরিবারের সঙ্গে কয়েক বছর যুক্ত থাকার সুবাদে তাঁর এসব গুণের সমাহার আমি উপলব্ধি করেছি। নিজেও নানামুখি অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়েছি। আমার প্রথম ঢাকা যাওয়া এবং সচিবালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু অফিস ও শহরের রাস্তাঘাট চেনা-জানার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আমার পথপ্রদর্শক। এজন্য আমি তাঁর কাছে বিশেষভাবে ঋণী।
দৈনিক নয়াবাংলার সঙ্গে আমার যুক্ততা বলতে গেলে কাকতালীয় ঘটনা। ১৯৭৭ সালের এপ্রিল থেকে আমি দৈনিক জমানার পটিয়া প্রতিনিধি এবং আগস্ট থেকে একই সঙ্গে দৈনিক স্বাধীনতার পটিয়া মহকুমা প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম। তখন মোবাইল-ফ্যাক্সসহ আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির সুবিধা না থাকায় গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ও ছবি নিয়ে কিংবা বিশেষ পরামর্শের জন্য প্রায় সময় শহরে আসতে হতো। সম্ভবত ৭৮ সালের শেষের দিকে একদিন একটি প্রতিবেদন নিয়ে জামাল খান রোডস্থ দৈনিক স্বাধীনতা অফিসে যাওয়ার সময় চেরাগী পাহাড় মোড়ে পৌঁছলে স্বাধীনতার বার্তা সম্পাদক এটিএম মোদাব্বের ভাই এবং নয়াবাংলার চীফ রিপোর্টার স্বপন কুমার মহাজন আমাকে আটকান এবং রিকশায় তাঁরা দুজনের মাঝখানে বসিয়ে আন্দরকিল্লা হয়ে কোতোয়ালীর দিকে রওনা দেন। যেতে যেতে আমাকে বললেন, ‘স্বাধীনতায় অঞ্জন সেনের গায়ে হারুন সাহেব (স্বাধীনতার সম্পাদক) হাত তুলেছেন, সেখানে আর নিউজ দিতে হবে না। তোমাকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি। সেখানে কাজ করবে, দেখবে ভালো লাগবে।’ কিছুক্ষণ পর দেখি আমাকে পাথরঘাটা গীর্জা স্কুলের পেছন দিকে মুসলিম আর্ট প্রেসের ভেতরে একটা অফিসে নিয়ে এক রাশভারী লোককে দেখিয়ে দিয়ে মোদাব্বের ভাই বললেন, ‘ইনি হচ্ছেন আমাদের শ্রদ্ধেয় হাবিবুর রহমান খান, নয়াবাংলার নির্বাহী সম্পাদক।’ একই সঙ্গে হাবিবুর রহমান খান সাহেবকে বললেন, ‘এ হচ্ছে তৈরি মাল, বাড়িও আপনার এলাকা পটিয়া। আমার সঙ্গে কাজ করতো, ওকে নিয়ে তেমন একটা মাথা কুটতে হবে না। তাই নিয়ে এলাম।’ নির্বাহী সম্পাদক মহোদয় মাথা তুলে নির্মোহ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমরা যখন বলছো কাজ করুক দেখি।’ আমাকে বললেন, ‘কিছু নিয়ে আসছ-দেখি।’ আমি স্বাধীনতার জন্য আনা প্রতিবেদনটি এগিয়ে দিলে তিনি সেটি আধা মিনিট চোখ বুলিয়ে বললেন, ‘আমি দেখবো, তবে এলাকার লোক হিসেবে নয়, কাজই হবে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।’
এরপর মোদাব্বের ভাই ও স্বপনদা পাশের আরেকটা কক্ষে নিয়ে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন সম্পাদক আবদুল্লাহ আল ছগীর সাহেবের সঙ্গে। তিনি সব শুনে বললেন, ‘নিউজের বিষয়তো দেখবেন খান সাহেব। কিন্তু আমার তো নতুন পত্রিকা, চেষ্টা করছি ভালো করার জন্য। নিউজতো নিয়মিত দেবেই, পাশাপাশি নিউজগুলো যাতে মানুষের চোখে পড়ে, হাতে হাতে যায়-অর্থাৎ সার্কুলেশনটা কীভাবে বাড়ানো যায় সে ব্যাপারেও খেয়াল রাখতে হবে। মনে করবে কাগজের উন্নতি হলে তোমাদেরও উন্নতি হবে।’ কথাগুলো তিনি বলছিলেন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায়। সেই থেকে প্রায় সপ্তাহে আমার ছোট-বড় একাধিক প্রতিবেদন ছাপা হতে থাকে নয়া বাংলায়। পত্রিকার সার্কুলেশন দ্রুত বাড়তে থাকে। আমি অফিসে এলে সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদক আমার সঙ্গে হাসিমুখে স্নেহের সুরে উৎসাহব্যঞ্জক কথা বলেন। এরই মধ্যে ১৯৭৯ এবং ১৯৮১ সালে দু’দফায় মফস্বল সাংবাদিকদের যোগ্যতা ও দক্ষতা উন্নয়নের লক্ষ্যে একনাগাড়ে ৭-৮ দিনের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করে নয়াবাংলা কর্তৃপক্ষ। এরমধ্যে একবার নিজস্ব উদ্যোগে, আরেকবার পিআইবির সহযোগিতায়। প্রশিক্ষকদের মধ্যে মধ্যে ছিলেন পিপলস ভিউ সম্পাদক নুরুল ইসলাম, ইত্তেফাকের আবাসিক সম্পাদক মঈনুল আলম, বাসস’র নুরুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান খান, পিআইবির মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, মুহাম্মদ নাসিমসহ বিশিষ্ট সাংবাদিকেরা। পিআইবির সহায়তায় আয়োজিত প্রশিক্ষণের সমাপনি দিনে অতিথি ছিলেন পিআইবির তৎকালীন মহাপরিচালক এবিএম মুসা, এবং ভারতীয় প্রেস ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক। কুমিল্লা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকার অংশগ্রহণকারীদের জন্য শহরে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৮২ সালের মাঝামাঝি সময়ে আমাকে শহরে এনে সপ্তাহ তিনেক রিপোর্টিংয়ের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন সম্পাদক মহোদয়। আমি কিছুটা সংশয় নিয়েই শহরে থেকে কাজ করার পর তিনি সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে নয়াবাংলার ঢাকা অফিসে যোগদানের প্রস্তাব দেন। আমি অজানা-অচেনা ঢাকা শহরে কীভাবে কাজ করবো-এ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করলে তিনি অভয় দিয়ে বললেন, ‘আমার বিশ্বাস তুমি পারবে। সাহস করে আল্লাহর নাম নিয়ে যাও, আমিই তোমাকে নিয়ে যাব। দরকারি মানুষগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব।’ তাঁর কাছ থেকে সাহস ও উৎসাহ পেয়ে আমি প্রথম ৮২ সালের জুলাই আগস্টের দিকে স্বপ্নের ঢাকা শহরে পা রাখি। তিনি আমাকে রিকশায় করে কমলাপুর থেকে তোপখানা রোডের চট্টগ্রাম সমিতি এবং পরের দিন সচিবালয়, সেগুনবাগিচা, শাহবাগ, কাকরাইল, গুলিস্তান ইত্যাদি জায়গায় ঘোরালেন এবং সাইন বোর্ড দেখিয়ে কোনটা কোন এলাকা, কিসের অফিস ইত্যাদি পরিচয় করিয়ে দেন। একজন সম্পাদক তাঁর কর্মীকে এভাবে রিকশায় পাশে বসিয়ে সরেজমিন পথ দেখাবেন এটা দেখে আমি পুলকিত হয়ে গিয়েছিলাম।
আবদুল্লাহ আল ছগীর তাঁর মেধা, শ্রম ও সাধনার মাধ্যমে চট্টগ্রামের তৎকালীন দৈনিক পত্রিকাগুলোর মধ্যে নয়া বাংলাকে ৬ পৃষ্ঠা করে মেজর ডেইলিতে পরিণত করেছিলেন। পাকিস্তান আমলে তিনি মুসলিম লীগের সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত হলেও সংবাদ, কলাম, ফিচার পরিবেশনায় তার তেমন ছাপ দেখা যায়নি। তাঁর মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত দৈনিকটি দৈনিক আজাদীর পর চট্টগ্রামের অন্যতম দৈনিকে হিসেবে পরিচিত ছিল। একজন মধ্যবিত্তের অধিকারী হয়েও নিজ অধ্যবসায় ও শ্রম দিয়ে এবং সময়োপযোগী প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে অল্প সময়ে পত্রিকাটিকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিলেন। যখন চট্টগ্রামের অন্য কোনো পত্রিকায় অঙ্গ সৌষ্টব নিয়ে তেমন ভাবেনি তখন আবদুল্লাহ-আল-ছগীর শিল্পী নিয়োগ করে গল্প কবিতার জন্য পাতা চালু করে লেখক সমাজের কাছে পত্রিকার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। দৈনিক নয়াবাংলায় কাজ করেছেন এমন অনেক সাংবাদিক জাতীয় ও স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন শামসুল হক হায়দরী মোয়াজ্জেমুল হক, অঞ্জন কুমার সেন, নূর মোহাম্মদ রফিক, হুমায়ুন ছাদেক, জসীম চৌধুরী সবুজ প্রমুখ। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, আবদুল্লাহ আল-ছগীরের জন্ম ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার হালদা নদীর তীরে গড়দুয়ারা গ্রামে। তাঁর বাবা ছুফী আবদুল গণি। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান আন্দোলনের সময় তিনি চট্টগ্রাম জেলা মুসলিম লীগের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৬২ সালে তিনি চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ থেকে ৭০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম পৌরসভার মনোনীত ওয়ার্ড কমিশনার ছিলেন। উত্তর চট্টগ্রামে রাস্তা-ঘাট, সেতু, স্কুল, মাদ্রাসা তথা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে তাঁর অবদান অনেকে স্মরণ করেন। গড়দুয়ারা মাদ্রাসা, জ্ঞানতাপস ড. শহীদুল্লাহ একাডেমী প্রতিষ্ঠায়ও তাঁর অবদান ছিল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন তিনি। আবদুল্লাহ ছগীর ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কাউন্সিল পরিষদের সদস্য, ১৯৬২-৭০ সন পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলা মুসলিম লীগের যুগ্ম-সম্পাদক ও প্রচার সম্পাদক ছিলেন। ৭০ সনের অক্টোবর মাসে রাজনৈতিক মতভেদের কারণে কারণে মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার পরিচালনা পরিষদের সদস্য, বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদের সহ-সভাপতি ছিলেন। ১৯৮৬ সালে তিনি বিনা প্রতিদ্ব›দ্বীতায় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সভাপতি নির্বাচিত হন। রাজধানীর বাইরের আঞ্চলিক সংবাদপত্রের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্যও সংগ্রাম করে গেছেন তিনি। আবদুল্লাহ আল ছগীর ১৯৯১ সালের ২৯ মার্চ ভোর রাতে মাত্র ৬২ বছর বয়সে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, ফেলো-বাংলা একাডেমি, সম্পাদক-ইতিহাসের খসড়া