শ্রমিক সাপ্লাইয়ের নিয়ন্ত্রণ নিতেই গন্ডামারায় উস্কানি!

56

বাঁশখালীর গন্ডামারার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পাঁচ বছরে দশজন লাশ হয়েছেন। দশজনের নয়জনই মারা গেছেন পুলিশের গুলিতে। প্রতিটি ঘটনাতেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার যোগসূত্রে ছিল স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
প্রকল্পের আধিপত্য দেখানোকে কেন্দ্র করেই প্রতিবার এসব ঘটনা ঘটেছে। প্রায় সময় প্রকল্পের পক্ষে-বিপক্ষে একটি পক্ষ দাঁড়িয়ে যায়। বারবার ঘটনায় প্রকল্প কাজ বাধাগ্রস্ত হয় এবং নিরীহ আসামি হয়ে জীবনের ঘূর্ণিপাকে নিমজ্জিত হয় সাধারণ মানুষ। প্রকৃতপক্ষে প্রকল্পের শুরু থেকেই প্রভাবশালীরা একজনকে সরিয়ে আরেকজন প্রকল্প কর্তৃপক্ষের আস্থাভাজন হওয়ার মিশনে নামেন। আর প্রকল্প বাস্তবায়নে নিজেদের সুবিধাকেই প্রাধান্য দিতে থাকেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। গন্ডামারা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সমন্বয়কারী আদিল বিল্লাহ পূর্বদেশকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাতেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। বিদেশীরা দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে এখানে বিনিয়োগ করেছে। এভাবে বারবার বাধার মুখে পড়লে প্রকৃতপক্ষে দেশেরই ক্ষতি হবে। এটা ঠিক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে আমাদের নানা বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। স্থানীয়রা নিজেদের আধিপত্য দেখাতে গিয়ে বারবার ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। আর বলির পাঁঠা হতে হচ্ছে আমাদের।’
স্থানীয়রা জানান, ২০১৪-১৫ সালের দিকে গন্ডামারায় কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জায়গা কেনার পর্বটির নেতৃত্বে ছিলেন শীলকূপের বাসিন্দা নাছির উদ্দিন। তার দাপট এতই ছিল যে, সড়কে চলাফেরায় নিজ গাড়ির আগে-পিছে মোটরবাইকের বহর যেতো। মূলত এই সময়েই প্রকল্পটি ঘিরে মানুষের চিন্তাচেতনার পরিবর্তন ঘটে। সংঘবদ্ধ হয়ে জায়গা কেনাবেচায় যুক্ত হন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের স্থানীয় নেতারা। আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যান অনেকেই। গাড়ি-বাড়ি প্রাচুর্য বাড়ে জায়গার মালিক-দালালদের। তাদের এই আধিপত্যের চিড় ধরে ২০১৬ সালে।
সে বছরের ৪ এপ্রিল পুলিশের গুলিতে চার গ্রামবাসী নিহত হলে আন্দোলন গড়ে তুলেন বিএনপি নেতা লেয়াকত আলী। গোরস্থান রক্ষা কমিটির নামে বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলেন। এই পুঁজি তার কাছে আর্শীবাদ হয়। নাছিরকে হটিয়ে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের আস্থাভাজন হতে অনেকদূর এগিয়ে যায় লেয়াকত। তার দাপটে তখনকার সময়ে গন্ডামারার চেয়ারম্যান হয়েও কোনটাসা হয়ে পড়েন জামায়াত নেতা আরিফুল্লাহ।
অন্যদিকে নানা কারণে সমালোচিত নাছির প্রকল্পের নেতৃত্ব থেকে ছিঁটকে পড়েন। তবে সেসময় প্রকল্প বিরোধী নানা ঘটনায় মামলার আসামিও হন নাছির-লেয়াকত।
এরমধ্যে ২০১৭ সালের ফেব্রূয়ারিতে প্রকল্প ঘিরে আধিপত্যের জের ধরে আরেকজন খুন হয়। তৎসময়ে প্রকল্পটি দাঁড় করাতে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি টিমও মাঠে নামেন। সেই টিমের সামনে নিজের গ্রহণযোগ্যতা তুলে ধরে সফল হন লেয়াকত। সমঝোতার সুবাধে মামলার আসামি হয়েও প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগিতা করে অল্পদিনেই প্রতিপক্ষ থেকে আস্থাভাজন নেতায় পরিণত হন তিনি। ২০১৭ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে গন্ডামারায় আওয়ামী লীগ-জামায়াতের জয়রথ থামিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন লেয়াকত আলী। এতেই ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। একদিকে নিজে বিএনপির বিত্তশালী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন অন্যদিকে অঢেল টাকার মালিক বনে যান।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপি নেতা লেয়াকতের এমন উত্থান মানতে পারছিল না স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। বিভিন্ন সময় প্রকল্পের নানা সরবরাহ কাজ ভাগিয়ে নিতে চেষ্টা চালান তারাও। সেখানেও লেয়াকতের ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ হিসেবে পরিচিত যুবদল নেতা আবু আহমদ বাধা হয়ে দাঁড়ান। অল্পসময়ে ভাগ্য বদল হয় আবু আহমদের। এস. আলমের আস্থায় লেয়াকতের সাথে যুক্ত হন আবু আহমদ। গত শনিবারের সংঘর্ষের ঘটনাতেও প্রকল্প কর্তৃপক্ষের ডাকে শ্রমিক অসন্তোষ ঠেকাতে ঘটনাস্থলে অবস্থান নেয় আবু আহমদ ও তার অনুসারীরা।
ঘটনার দিন (শনিবার) বিকালে সকাল বাজার এলাকায় গ্রামবাসীর সাথে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তাদের সবার মুখে মুখে প্রকল্প ঘিরে লেয়াকত আলী ও আবু আহমদের কোটিপতি হওয়ার মুখরোচক গল্প। প্রকল্প বিরোধিতার স্বার্থে অনেকেই এই দুজনকে ‘বেঈমান’ বললেও কেউ কেউ এ দুজনের সহযোগিতায় প্রকল্প কর্তৃপক্ষ এলাকায় উন্নয়ন করছে বলেও জানান। তারই প্রমাণ মিলে গন্ডামারার অলিগলিতে লাগানো ‘নিজস্ব অর্থায়নে সড়ক সংস্কারে লেয়াকত আলী’ নামফলক।
গন্ডামারার চেয়ারম্যান লেয়াকত আলী পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে বারবার ষড়যন্ত্র হয়েছে। আমি কখনো প্রকল্প ঘিরে ব্যবসা করি না। আমরা ব্যবসা কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে ও সীতাকুন্ড এলাকায়। আমি এলাকার উন্নয়নে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা নিই।’
জানা যায়, প্রকল্প এলাকায় প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক কাজ করছিল। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এনে এসব শ্রমিক সরবরাহ দিত বেসরকারি সাতটি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হলো- মাহি এন্টারপ্রাইজ, এনআরএম এন্টারপ্রাইজ, রকিব এন্টারপ্রাইজ, আলী এন্টারপ্রাইজ, আদিবা এন্টারপ্রাইজ, ইমা এন্টারপ্রাইজ, উজ্জ্বল এন্টারপ্রাইজ। স্থানীয়ভাবে এ প্রকল্প কর্মরত শ্রমিক ছিল কম।
পশ্চিম বড়ঘোনা এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রকল্প করার আগে কর্তৃপক্ষ স্থানীয় মানুষদের কর্মক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বললেও একশ্রেণির মানুষ ছাড়া সাধারণ মানুষ এর সুফল পায়নি। যা নিয়ে এলাকার মানুষের ক্ষোভ ছিল।’
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, বাইরের যে প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রমিক সরবরাহ করেন তাদের সাথে স্থানীয় কিছু মানুষের সখ্যতা গড়ে উঠে। কিছু কিছু কাজে স্থানীয়দের সহযোগিতাও নিতো শ্রমিক সরবরাহকারীরা। ভিন্ন জেলার বাসিন্দারা গন্ডামারায় শ্রমিক সরবরাহের বিনিময়ে যে টাকা উপার্জন করতো তার কৌশল অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যায় স্থানীয়দের কাছে। বিশেষ করে মামলার প্রধান আসামি আব্দুর রশিদের মুদির দোকানে শ্রমিকদের আনাগোনা থাকায় তার কাছে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। যে কারণে রশিদও শ্রমিক সরবরাহের মতো কাজে নিজেকে যুক্ত করতে মরিয়া হয়ে ওঠে।
চলমান এমন পরিস্থিতিতে প্রকল্পে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে মোটামুটি মানসম্পন্ন টয়লেট, পানি, বেতন ভাতাদি নিয়ে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। সুযোগটি কাজে লাগায় আব্দুর রশিদের নেতৃত্বে স্থানীয় একটি চক্র। তারা বারবার শ্রমিক সরবরাহের নিয়ন্ত্রণ নিতে চেষ্টা চালায়। প্রকল্প কর্তৃপক্ষের কাছেও নানা সময়ে আবদার খাটানোর চেষ্টা করেন। রমজান শুরুর পর থেকে শ্রমিকরা ইফতার ও সেহরীর সুবিধার্থে কর্মঘণ্টটা কমাতে ১০ দফা দাবি দিলে সুযোগটি কাজে লাগায় স্থানীয় চক্রটি। তারা শ্রমিকদের নানাভাবে উস্কানি দিতে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও সেই অভিযোগ তারা অস্বীকার করে। জামায়াত-বিএনপির দূর্গখ্যাত গন্ডামারার এ প্রকল্পে কর্মরত স্থানীয় কয়েক’শ শ্রমিক এতে ক্ষিপ্ত হন। স্থানীয়দের ইন্ধন পেয়ে শ্রমিকরা মারমুখি আচরণ শুরু করেন। গাড়িতে আগুন ধরিয়ে চীনাদের বিরুদ্ধে জোরালোভাবে অবস্থান নেন। শ্রমিকদের ইট-পাটকেলের তোপে পরিস্থিতি সামলে নিতে পিছু হটেন পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা। একপর্যায়ে পুলিশ গুলি ছুঁড়লে পাঁচজন শ্রমিক মারা যান। আহত হন পুলিশসহ ২১ জন।
পশ্চিম বড়ঘোনা পুরুষশূণ্য : ঘটনার দিন রাতেই প্রকল্প কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের পক্ষ থেকে দুটি মামলা দায়ের করা হয়। দুটি মামলায় ২২জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত প্রায় সাড়ে তিন হাজার জনকে আসামি করা হয়। এরমধ্যে প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটর ফারুক আহমদের দায়েরকৃত মামলায় ১০ কোটি টাকা মালামাল চুরি ও ১৫ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। মামলা দুটি দায়েরের পর থেকে পশ্চিম বড়ঘোনা ৪নং ওয়ার্ডের পুরুষরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। গ্রেপ্তার আতঙ্কে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন অনেকেই। পুলিশ এজহারনামীয় ২২ আসামিকে ধরতে অভিযোগ শুরু করেছেন।
দুটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাঁশখালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আজিজুল ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, ‘মামলা হওয়ার পরপরই কাজ শুরু করেছি। এখনো কোন আসামি গ্রেপ্তার করা হয়নি। ঘটনার সার্বিক বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত কাজ এগিয়ে নিচ্ছি। ঘটনায় প্রকৃত দোষীরা যাতে পার না পায় সেদিকটাও নজরে রাখছি।’
তদন্ত টিম মাঠে : গত দুইদিন ধরে গন্ডামারায় কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ঘটনার তদন্তে কাজ করেছেন জেলা প্রশাসন ও পুলিশের পক্ষ থেকে গঠিত দুটি তদন্ত টিম। গতকাল জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত টিমের প্রধান সুমনী আক্তারের নেতৃত্বে তদন্ত টিম ঘটনাস্থলে যান। এসময় শ্রমিকদের সাথে কথা বলেন এবং ঘটনার খুঁটিনাটি অনুসন্ধান করেন।