শিশুশ্রম নিরসন হোক

66

 

শ্রম আইন-২০০৬ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সিদের দিয়ে কাজ করানো হলে তা শিশুশ্রম বলে গণ্য হয়। শিশুশ্রম দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ভয়াবহ সমস্যা। অর্থনৈতিক দুরবস্থা শিশুশ্রমের প্রথম ও প্রধান কারণ। লেখাপড়ার খরচ দিতে না পেরে এবং সংসারের অসচ্ছলতার গ্লানি কোনো মা-বাবাকে বাধ্য করে তার সন্তানকে শ্রমে নিযুক্ত করতে। এ অঞ্চলের দেশগুলোতে আয় বৈষম্যের কারণের দরিদ্রতা থেকে মুক্ত হতে পারছে না বিশাল অংকের মানুষগোষ্ঠী। তাই শিশুরা দারিদ্রের কষাঘাতে বাধ্য হয়ে শিশুশ্রমে নিযুক্ত হয়।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ইউনিসেফের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা বেড়ে ১৬ কোটিতে পৌঁছেছে, যা গত চার বছরে বেড়েছে ৮৪ লাখ। উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে শিশুশ্রমে নিযুক্ত ৫ থেকে ১১ বছর বয়সি শিশুর সংখ্যা, যে শিশুদের সংখ্যা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রমে নিয়োজিত মোট শিশুর অর্ধেকের কিছু বেশি। শিশুদের স্বাস্থ্য, সুরক্ষা ও নৈতিকতার ক্ষতি করতে পারে এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশুর সংখ্যা ২০১৬ সালের পর ৬৫ লাখ বেড়ে ৭ কোটি ৯০ লাখে পৌঁছেছে। কোভিড পরিস্থিতির কারণে ২০২২ সাল সমাপ্ত হওয়ার আগেই বিশ্বব্যাপী অতিরিক্ত ৯০ লাখ শিশু শ্রমে নিযুক্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। যদি তাদের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা না হয়, তাহলে এই সংখ্যা বেড়ে ৪ কোটি ৬০ লাখে পৌঁছাতে পারে। কোভিড পরিস্থিতিতে পারিবারিক বাড়তি অর্থনৈতিক চাপ এবং স্কুল বন্ধের কারণে ইতিমধ্যে শিশুশ্রমে নিযুক্ত শিশুর সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে। অন্যদিকে ঝুঁকির মুখে থাকা পরিবারগুলোতে কাজ হারানো বা আয় কমে যাওয়ার কারণে আরো অনেক শিশু শ্রমে নিযুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছে।
শিশুশ্রম প্রতিরোধে বাংলাদেশে বেশ কিছু আইন রয়েছে, তবে এর প্রয়োগ খুবই কম। শিশুশ্রম বিষয়ে প্রচলিত আইনে ন্যূনতম মজুরি অধ্যাদেশ ১৯৬১-তে বলা হয়েছে, কিশোরসহ সব শ্রমিকের জন্য ন্যূনতম মজুরি প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে এবং নিয়োগকারী কর্তৃক কিশোর শ্রমিককে (১৮ বছরের নিচে) এই অধ্যাদেশের আওতায় গঠিত বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত পরিমাণের কম মজুরি প্রদান বেআইনি বলে ঘোষণা করা হয়েছে। দোকান ও স্থাপনা আইন, ১৯৬৫-তে বলা হয়েছে, দোকানে বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ১২ বছরের কম বয়সি শিশু নিয়োগ নিষিদ্ধ। এই আইন ১৮ বছরের কম বয়সি শিশুর জন্য শ্রমঘণ্টাও নির্ধারণ করে দিয়েছে।
শিশুশ্রম বিষয়ে প্রচলিত কারখানা আইন, ১৯৬৫-তে বলা হয়েছে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ১৪ বছরের কম বয়সি শিশুকে নিয়োগদান নিষিদ্ধ করেছে এবং শিশু ও কিশোরের জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কাজের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য প্রবিধান দিয়েছে। এছাড়া এই আইন কোনো কারখানায় নারী শ্রমিকদের ছয় বছরের নিচে সন্তানদের লালন-পালনের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির নির্দেশ দিয়েছে। শিশু আইন, ১৯৭৪ এবং শিশুবিধি, ১৯৭৬-তে সব ধরনের আইনগত প্রক্রিয়াকালে শিশুর স্বার্থ রক্ষা করবে। এই আইনে আলাদা কিশোর আদালত গঠনের জন্য বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশু অপরাধী যদি যৌথভাবে একই অপরাধ করে থাকে, তাহলেও তাদের যৌথ বিচার অনুষ্ঠান করা যাবে না।
খনি আইন, ১৯২৩-এ বলা হয়েছে, ১৫ বছরের কম বয়সের কোনো ব্যক্তিকে কোনো খনিতে নিয়োগদান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং ১৫ থেকে ১৭ বছরের কিশোরদের নিয়োগ প্রদান নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। শিশু নিয়োগ আইন, ১৯৩৮-এ বলা হয়েছে, রেলওয়ের কয়েকটি কাজে শিশুদের নিয়োগ দেওয়া যাবে না এবং রেলওয়ে কারে অথবা বাসে অথবা কোনো বন্দরের অধীন এলাকায় শিশুরা কোনো দ্রব্য বিক্রি করতে পারবে না। শিশু (শ্রম অঙ্গীকার) আইন, ১৯৩৩-এ ১৫ বছরের কম বয়সি শিশুর শ্রম চুক্তির অঙ্গীকার অকার্যকর ঘোষণা করা হয়েছে।
২০১১ সালে প্রণীত জাতীয় শিশু নীতিতে বলা হয়েছে, ৫-১৮ বছরের কোন শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করানো যাবে না। ৫-১৮ বছরের শিশুকে কর্মে নিয়োগ দেওয়া দন্ডনীয় অপরাধ। শিশু আইন ২০১৩ এ বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি তার দায়িত্বে থাকা শিশুকে আঘাত, উৎপীড়ন বা অবহেলা করেন, তাহলে ঐ ব্যক্তি অনধিক ৫ বছরের কারাদন্ড দন্ডিত হবেন।
শিশুশ্রম ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। করোনার প্রভাবে পরিবারের উপার্জন কমে যাওয়া এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে তা বেড়েছে কয়েক গুণ। এ থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে নানামুখী ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন। সর্বজনীন শিশুসুবিধাসহ সবার জন্য পর্যাপ্ত সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করা, মানসম্মত শিক্ষার পেছনে ব্যয় বাড়ানো এবং করোনার আগে থেকেই স্কুলের বাইরে থাকা শিশুদেরসহ সব শিশুকে স্কুলে ফিরিয়ে আনা, অসচ্ছল পরিবারে শিক্ষার্থীদের ভাতা প্রদান, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য যথোপযুক্ত কাজের ব্যবস্থা করার বিষয়টি তুলে ধরা, যাতে পরিবারগুলোকে পারিবারিক উপার্জন বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে শিশুদের অবলম্বন করতে না হয়। প্রাপ্তবয়স্কদের কাজের ব্যবস্থা না করতে পারলে তাদের বেকার ভাতা প্রদান, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিনা মূল্যে সকাল-দুপুরের খাবার বিতরণ এবং শিশুশ্রমে জড়িত শিশুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফেরাতে সরকার ও শিশুদের নিয়ে কাজ করা এনজিওগুলোর নানামুখী ভূমিকা পালন করতে হবে। শিশুশ্রম প্রতিরোধে তৈরিকৃত আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। তবেই শিশুদের বাঁচানো সম্ভব হবে। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।
লেখক: কলামিস্ট