শিমুলের যুদ্ধে যাওয়া

54

 

প্রচন্ড শীত পড়েছে। ঠান্ডায় হাত পা জমে গেছে। ঘর নেই, বাড়ি নেই। এই শীতে শুনশান রাস্তায় শুয়ে থাকা যে কতটা কষ্টকর একমাত্র শিমুল সেটা জানে। জন্মের পর মা-বাবাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার। বড় হয়েছে অনাথাশ্রমে। বয়স যখন বারো, অনাথাশ্রম থেকে পালিয়ে একটু স্বাধীনভাবে বাঁচার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায় শহরে। শহরের গলিতে চায়ের দোকানে কাজ করে জীবন অতিবাহিত করে সে। কিন্তু মাথা গুজার মতো ঠাঁই কোথাও পায় নি। তাই ফ্লাইওভারের নিচে রাস্তার এক কোণে শুয়ে থাকে। তার পাশে আরও অনেক লোক ঘুমায়। হয়তো তারাও তার মতোই।
দেশে যুদ্ধের কলরব। ঘুমানোর সময় প্রতিরাতেই শিমুল মিলিটারিদের আসা যাওয়া করতে দেখে। ওদের গাড়ির শব্দে কখনো কখনো ঘুম হয় না তার। চায়ের দোকানে কাজ করার সময় ওখানের রেডিওতে প্রতিদিনই সে যুদ্ধের কথা শুনে। বঙ্গবন্ধুর আহব্বানে বাঙ্গালি জাতি অধিকার আদায়ের যে লড়াইয়ে নেমেছে তার কথা শুনে। এসব শুনে শিমুলেরও ইচ্ছে হয় যুদ্ধে যাবার। কিন্তু কোনো উপায় নেই। তার দোকানের মালিকের সাথে মাঝে মাঝে মিলিটারিরা এসে কী জানি আলোচনা করে। তারপর চা খেয়ে চলে যায়। তবে শিমুল বুঝতে পারে যে, তার মালিক পাকিস্তানিদের কোনো না কোনোভাবে সাহায্য করছে।
শিমুল একদিন ভয়ে ভয়ে তার মালিককে জিজ্ঞেস করে, চাচা, ওরা কারা? ওদের দেখলে আমার খুব ডর লাগে। ওদের হাতে কত বড় বড় লাঠি! মালিক বলে, তুই এসব জেনে কি করবি? এরা পাকিস্তানি। আমার বন্ধু। আমাকে ওরা সম্মান দেয়। আর আমি ওদের একটু আধটু সাহায্য করি। ওদের হাতে লাঠি না বন্দুক থাকে। উল্টাপাল্টা কথা কইলেই ‘ঠুস’ কইরা গুলি কইরা দিব। তাই ওদের সাথে মিল রাখা ভালো। শিমুল বলে, কিন্তু এরা তো বাঙালিদের মারে। মারে কেন? মালিক বলে, চুপ, বেয়াদব। ওরা সেসব বাঙালিদের মারে যারা পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে চায়। স্বাধীন হতে চায়। আমাদের মারবে না কারণ আমরা ওদের পক্ষে।
এসব শুনে শিমুলের খুব রাগ হয়।
গভীর রাতে রাস্তায় শুয়ে থাকা অবস্থায় শিমুল পাশের ঝোপে কিছু মানুষের আওয়াজ শুনতে পায়। অন্ধকার জায়গায় ওরা যেন কী করছে। সে এগিয়ে যায় তাদের দিকে। কাছে যেতেই ওরা যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। ওদের মধ্যে থেকে একজন বলছে, কে রে তুই? এখানে কী করিস?
– আমি এখানেই ঘুমাই। বাড়ি ঘর নেই। শব্দ শুনে এলাম। তোমরা কি মিলিটারি?
– না না। আমরা তো মিলিটারির শত্রূ। ওদের মারতে এসেছি। আমাদের কাছে খবর আছে ওরা এ রাস্তা দিয়েই আসা যাওয়া করে। তুই কী কিছু জানিস ওদের বিষয়ে?
– আমি জানব না তো কে জানবে। এই রাস্তায় শেষ মাথায় ওদের ক্যাম্প। আমাদের দোকানে এসে চা খায় ওরা।
– আমাদের একটু সাহায্য করবি?
– তোমরা যা বলো তাই করবো। কিন্তু একটা কথা, আমাকে তোমাদের দলে নিতে হবে।
– তুই ছোট। তুই গিয়ে কী করবি?
– আমি প্রথমেই আমার মালিককে শাস্তি দেব। সে পাকিস্তানিদের সাহায্য করে। আমার খুব রাগ হয় তখন। আমি এর প্রতিশোধ নেব।
– হ্যাঁ, অবশ্যই। তোর চোখে আমি মুক্তিকামী ভাব দেখতে পাচ্ছি। চল আমাদের দলে চল। তবে আজ আমরা আক্রমণ করব না। তুই কাল ভালো করে ক্যাম্পের খবরটা নিয়ে আসবি। আর ওদের অবস্থান জানাবি।
– আচ্ছা। আমি এখন যাই। তোমরা সাবধানে থাকো। ওদের হাতে বন্দুক আছে।
শিমুল পরদিন সব খবরাখবর নিয়ে রাতে ঝোপের কাছে ওদের কাছে যায়। সব জেনে নিয়ে ওরা ভোরে ক্যাম্প আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে। যেই কথা সেই কাজ। শিমুলের দেয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে তারা ক্যাম্প আক্রমণ করে এবং তা ধ্বংস করে দেয়। মারা যায় শতাধিক মিলিটারি। সকালে সে খবর ছড়িয়ে যায় চারদিকে। চায়ের দোকানের মালিক ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। শিমুল মিটিমিটি হাসে। মুক্তিসেনারা চায়ের দোকানে আসে এবং চা খেতে খেতে দোকানের মালিককে শাসিয়ে যায়। যদি দ্বিতীয়বার পাকিস্তানিকে সাহায্য করার চিন্তাও মাথায় আসে তাহলে সে আর রক্ষা পাবে না। তারপর ওরা শিমুলকে তাদের সঙ্গে নিয়ে যায়। দেশের মানুষের মুখে হাসি ফিরিয়ে আনার জন্য শিমুলও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে ওদের সাথে চলে যায়।
দীর্ঘদিন যুদ্ধ করার অসংখ্য মানুষের প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পৃথিবীর মানচিত্রে মাথা তুলে দাঁড়ায়। যুদ্ধ ফেরত শিমুলের মুখে ফোটে বিজয়ের হাসি। উল্লাসে মেতে উঠে বাঙালি। শিমুলের মতো কোটি মানুষ ফিরে পায় মাথার গুঁজার মতো নিজের একটি দেশ।