শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার

18

পারভীন আকতার

শিশুকালে পড়তে মন চাইত না। স্কুল মানেই ছিল যমের ঘর!চারজন চারদিকে হাতে পায়ে ধরে স্কুল ঘরে পৌঁছে দিত। স্যারদের ভয়ে আড়ষ্ট থাকতাম।কেউ কেউ পাহারাও দিত।কেমন আনপড় মন ছিল! ধীরে ধীরে পড়ায় মন বসল।মা বাবা গৃহশিক্ষক, স্কুলশিক্ষক আর ধর্মীয় শিক্ষক এতোগুলো কড়া বান্দার পাহারায় না পড়ে কোথায় যায়! তবুও ফাঁক ফেলেই পলায়ন যেদিকে সবুজে সবুজ খেলা করে। স্কুলের সিদে স্যার (শ্রদ্ধেয় প্রয়াত অরুণ স্যার)আমায় বেশ পছন্দ করতেন। বাবা ছিলেন আমাদের পাড়ার স্কুলের এসএমসির সভাপতি।বাবা প্রায়ই সবকিছুর কড়া খোঁজ নিতেন। আমার ভাল মন্দ মুহূর্তেই মায়ের কানে চলে যেত। এ মহা মুশকিল! স্যাররা বলেন, ‘কী রে পড়েছিস মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে একসাথে।’ সেখানে আবার আমার কিছু সহপাঠী ছিল যাদের কারো পড়ালেখায় তীক্ষ্ণ মেধা আর কারো ঘুটঘুট গোলগাল হাতের লেখা!আমারও একসময় জেদ উঠল। নাহ্, আর বকা শুনব না। অরুণ স্যার আমাদের লক্ষীছাড়ি বলে বকা দিত।পরে কত আদর করতেন। তাঁর দুই লাইন লেখা ভাঙা কাঠের নড়বড়ে বø্যাকবোর্ডে মুক্তার মতো হাতের লেখায় আমি যেন গোটা বিশ্ব দেখতাম। শিক্ষক এমনি নিবেদিত প্রাণ বলেই শ্রেষ্ঠত্বের আসন দিতে হয় বার উপরে।
আজ আমিও শিক্ষক। নিষ্পাপ শিশুদের ভালোবাসার রাজ্যের মাষ্টারনি! সারাদিন মনে হয় একটা ঘোরের মধ্যে থাকি। কী করব, কীভাবে আমার ছাত্রছাত্রীদের হৃদয়ের জোয়ার আনব তাই ভাবি। তাদের মনের খলখলানি পাখির মতো কিচিরমিচির শব্দ আমরা শিক্ষকরা শুনতে পাই। অনুমান করতে পারি কে কতটা জীবনে সফল হবে। কার কতটা শরীরের অসুখবিসুখ এইটা-সেইটা। কে ঢেরা, কম দেখে কিংবা তোতলায়। কীভাবে, কী করলে তারা পড়ায় মনোযোগ দেয় তাও শিক্ষকরা জানেন, বুঝেন। আমাদের শিক্ষকরাও তেমন ছিলেন। পথঘাটে দেখলে পা ছুঁয়ে সালাম করি, শান্তি লাগে। কত যে দোয়া ও আশীর্বাদ করেন তাঁরা।
আমার প্রিয় শিক্ষকগণ আজ অনেকেই প্রয়াত। তাঁদের আমি বিনম্র চিত্তে স্মরণ করি। আর যাঁরা বেঁচে আছে তাঁদের দীর্ঘ সুস্থ ও শান্তিময় জীবন কামনা করি। তাঁরা কখনো বাজার দর দেখে আমাদের মানুষ করেননি। সম্পূর্ণ মায়া মমতা আর শতভাগ পেশাদারিত্ব দিয়ে আমাদের পড়িয়েছেন তাই আমরা আজ আলোর পথের যাত্রী। একেকজন একেক বিশাল পদে সফল পদচারণা। ঝরে যাওয়ার সংখ্যা নগন্যই বটে।
আমি শিক্ষক শ্রেষ্ঠ মানেই সকল শিক্ষকই শ্রেষ্ঠ। বিধাতার আলোর মশাল হাতে বিদ্যার আধার অগ্রসর ব্যক্তিত্ব তিনি। তাঁদের ফেলনা ভেবে কাঁচের মতো টুকরো করে ভাঙতে গেলে কাঁচ পায়ে ফুটে রক্ত ঝরবে। আর সোজা হয়ে হাঁটতে পারবে না জাতি। আমরাই তৈরি করি সুন্দর সুনাগরিকের শ্রেষ্ঠ মানব বাগান যা ফুল ফলে সুশোভিত সুগন্ধ ছড়ায় পৃথিবীতে। একজন আমলা থেকে শুরু করে দেশপ্রধান তৈরির কারিগর শিক্ষক এবং শিক্ষক। মনে মগজে মেধার স্ফুরণ একজন দক্ষ, বিনয়ী এবং আন্তরিক শিক্ষকের পরিশ্রমের ফসল তারা। শিক্ষা কখনো অর্থের বিনিময়ে সর্বোচ্চ দেয়া যায় না। শিক্ষা দিতে ও নিতে হয় অন্তর ও মেধা থেকে। এতো অমূল্য! কতটা অর্থ দিয়ে তা মূল্যায়ন করবে মানুষ!
পেশা হিসেবে শিক্ষকতা অনন্য।নিরানব্বই ভাগ শিক্ষক ঘুষ, সুদ আর বিলাসীতায় সময় অপচয় করে রোজগার করেন না। তাঁরা সদা একটি জ্ঞানের চক্করে থাকেন। স্বপ্ন দেখান এবং তা বাস্তবায়নের নূতন নূতন কৌশল, দীক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থী ও আলোকিত সমাজ গড়ে তোলেন। উনারাই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানুষ। রাষ্ট্রকে অবশ্য শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা, সম্মান ও আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতার প্রতিবিধান দিতে হবে। দিতে হবে মানসিক স্তুতি। তাঁরা কারো গোলাম নন বরং একটি জাতির সৌভাগ্যের দুয়ার খুলে দেয়ার কান্ডারী। তাই কোন শিক্ষক কোন অফিসে যাওয়া মাত্র সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান করবেন এবং তাঁর কাজ এবং কথা গুরুত্বসহকারে শুনবেন, মূল্যায়ন করবেন। এমনিই হবে শিক্ষকের সম্মান ও মর্যাদা। শিক্ষকের বুক তখন গর্বে ভরে যাবে এই ভেবে যে সত্যিইতো এমন বিনয়ী জ্ঞানী জাতিইতো আমরা শিক্ষকরা তৈরির প্রয়াস চালিয়েছি আজীবন। খেয়ে না খেয়ে, অর্থকষ্টে কিংবা বহু ক্রোশ পথ পাড়ি দিয়ে গোমূর্খদের ভিতর জ্ঞান বিতরণ করে সুশিক্ষিত ও স্বশিক্ষিত করার আনন্দই তখন চোখের আনন্দাশ্রæ হয়ে ঝরে শিক্ষকদের।
‘আর হীনমন্যতা নয়, শিক্ষকের হবে জয়।
মানে সম্মানে তিনিই শ্রেষ্ঠ সবার।
শিক্ষাব্যবস্থা তাঁর হাতে ধরেই প্রকৃষ্টরূপ ধারণ করবে এবার।’
লেখক : শিক্ষক, কবি ও প্রাবন্ধিক