রেহেনা মাহমুদ এর কবিতা চিন্তার মনোহরপুরে

66

রিজোয়ান মাহমুদ

কবিতার শব্দগুলো মুক্তোর দানার মতো গড়িয়ে পড়ে। অনর্থক ভারী কিছু না। আড়ম্বরও তেমন নেই। গড়িয়ে পড়ার ভঙ্গি দেখলে মনে হবে, গায়ে এসে স্পর্শ করে এক পশলা সরলমুখো বৃষ্টি বাতাস ; আপাত এই ক্ষরণের অভিক্ষেপণ নিয়ে রেহেনা মাহমুদের কবিতা। কোথাও কোথাও নিভৃত দুপুরের চিন্ময়ক্ষণ হয়ে ওঠছে চিন্তার মনোহরপুর। অন্তর্দেশ মসুরদানায় যেন সিক্ত সারা রাত্রির মনোদহনে উদ্বেলিত স্বরভঙ্গি। একটি কবিতা আসলে তখনই কবিতা হয়ে ওঠে যখন মস্তিষ্ক ও মনে জলের ছোট ছোট ঢেউ ঘুরে ঘুরে একা একা নিজের একটা ঘূর্ণন তৈরি করে। এটিই শব্দের ফেনা, উজাড় করা ঢেউয়ের আহবান। ভাবনার অতলান্তিক সংগীত। এটিই সংগীতের শুদ্ধস্বরের বেদনা বেহাগ। শব্দ ও অনুভূতির অনুরণন যতক্ষণ পর্যন্ত চলতে থাকে কানের দুপাশ জুড়ে, ধরে নিতে হবে কবিতাটি স্মৃতি ও শ্রুতির প্রাণিত উচ্ছ¡াস। এভাবে একটি কবিতা অনুভূতির বাঙময় আবেশ নিয়ে তীর্থযাত্রার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। সেই সক্ষমতার চূড়ান্ত পাঠ রেহেনা মাহমুদ এর কবিতা। পাঠকের আবিষ্টতা ও সংলগ্নতা বোঝা কবির বড় কাজ। সক্ষম কবিরা খুব সাবলীলভাবে সংযোগ তৈরি করতে পারেন জনপদের বিবিধ অনুষঙ্গের স্বপ্ন অস্বপ্ন নিয়ে। যারা বিষয় নির্মাণের দিকে ঝুঁকেন এবং কবিতাকে দুরবর্তী চিত্রপ্লাবী করে তোলার খসরৎ করেন, তাদের বহুকিছু পাঠকের চিন্তার বাইরে থেকে যায়। বোধ যদি চিন্তা ও মননের ক্রিয়া হয় সেটিতে “অ” উপসর্গ দিয়ে অবোধ্য করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কবিতা মানে পাহাড়, পর্বত, নদী এবং সমতলে বয়ে যাওয়া কুল কুল নদীর ধ্বনি, সারি সারি গ্রামের পথ ধরে হেঁটে যাওয়া স্কুলগামী বালক বালিকার দল, যারা একমুঠো স্বপ্ন নিয়ে নির্মাণ করতে শেখেন জীবন ও জীবনবোধ। অনেকটা বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পী ভ্যান গঁগ, স্টুয়ার্ট এবং জোসেফ ফারিংটন এর ল্যান্ডস্কেপর মতো। আবার সমাজ রাষ্ট্রের অনিয়ম অসংগতি, বিদ্রোহ আসবেনা তাও নয়। পুরো মাত্রার এই ছবিটি আনার জন্য কবির দরকার এপিস্টেমোলজি কিংবা বিশদ অভিজ্ঞতা। শুধু অভিজ্ঞতা থাকলেও কাজ হয় না। থাকতে হয় সুক্ষ পর্যবেক্ষণ শক্তি। মাত্রাতিরিক্ত কল্পনাশক্তি। অন্তর্গূঢ় আর্তনাদ। শব্দ ও অনুভূতি নিক্তি ওজনে ভারী ও হাল্কা করতে জানতে হয়।
মন অন্তপুরের পুষ্পরেণুর দিগন্ত উন্মোচিত সৌন্দর্যের অবিরাম ছটা নিয়ে রেহেনা মাহমুদ এর কবিতা শুদ্ধ হৃদয়ের সারাগাম। স্নিগ্ধতা কোমলতা একরাশ কুলকুল বয়ে যাওয়া ঢেউয়ের দোলায় তীরের খুশবো নিয়ে এগুতে থাকে। যে সমস্ত পাঠক মস্তিষ্কের ব্যায়াম বলে কবিতাকে দূরে সরিয়ে রাখে তাদের জন্য অবিরাম পাঠের দরজা খুলে দেবে তাঁর কবিতা। কবিতা যে বাঙালি পাঠকের ক্লান্তি হরণ করে হরফের অনুভূতিতে বরফের আচ্ছাদন দিতে পারে, অন্তত রেহেনার হরফ স্বাক্ষর দ্যোতক ও দ্যুতিতের মধ্যে সেই অনুভূতি দ্রবণ হয়ে ওঠে। রেহেনার কবিতার জন্য ত্বত্ত¡ আলোচনায় যেতে হয় না। নিভৃত অন্তপুরে পুষ্পরেণু ছড়িয়ে যে গলি আছে সেই পথে হেঁটে গেলে যে দহন মেলে সরল মধ্যবিত্তের জীবন জিজ্ঞাসার করুণালোক, তা যেন এই জনপদেরই মনোদর্শন ;
আব্বাকে সদ্য স্বাধীন দেশ মনে হয় ;
ভাঙাচোরা, বিধ্বস্ত।
প্রতিদিন ভোর সকালে যে ক্লান্ত, নুব্জ
একটা ছায়া শরীর নিয়ে
বেরিয়ে পড়ে সেলাই কলের উদ্দ্যেশ্যে
কিন্তু জোড়াতালি দিয়ে কোনমতেই
ঢাকতে পারে না কোন দীনতা।

আব্বার কাঁপা হাতে সেলাই হয় না
সন্তানের ক্ষুধার্ত মুখ
কিংবা মায়ের ছেড়া শাড়ির আঁচল।
আম্মার সে আঁচলে পূর্ণিমার আলো
গোল হয়ে বসে থাকে আর আমাদের
হাভাতে মুখ আরও হা হয়ে ওঠে
যেন সমস্ত আলো গোগ্রাসে খেয়ে ফেলবে।

অথচ আমাদের সমস্ত অপেক্ষার দিন শেষে
রাত্রির সকল অন্ধকার মুখে নিয়ে
আব্বা আরো ন্যুব্জ হয়ে ঘরে ফিরে আসে।
তার বাজারের ব্যাগ ফুটো
ছিদ্র গলে পালিয়ে গেছে আমাদের আনন্দ আয়োজন।
সীমাতিক্রমী অনুভূতির জীবন অনুষঙ্গ এই কবিতায় রয়েছে পারিবারিক জীবনালেখ্য। পরতে পরতে রয়েছে একটা মানবিক জীবনের দুঃসহ যন্ত্রণার পরিণত ছবি। বাস্তবতায় অঙ্কিত হয়েছে সাহসী ও শিল্পিত চিত্রপট। একটি কবিতার সৃজনক্ষমতা বোঝার জন্য প্রতিটি পঙক্তির ব্যবচ্ছেদের প্রয়োজন পড়ে না। বেদনা দগ্ধান স্বরলিপি মানবিক সম্পর্কের সম্ভোগে জেগে উঠলে বোঝা যাবে কবিতা শিল্পকলা। কবিতা সর্বপ্লাবী হতে পারে অনায়সে অন্তর্গত বোধের উৎসারণে। কবিতার সারল্য কবিতাকে নিমিষেই পৌঁছে দিতে পারে পাঠ সীমানায়। পাঠ সীমানা স্থুল অর্থে কবিতার শাব্দিক অর্থেই সীমাবদ্ধ। সম্প্রসারিত কবিতার মৌলিক ও উত্তাল অর্থে বাবা এক যুদ্ধংদেহী ঔপনিবেশিক মানুষ। রক্তগঙ্গা থেকে ফিরে পাওয়া একটা বড় উত্তাল ঢেউ নিজের ঘরে নিয়ে আসা। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ফিরে পাওয়ার শক্তি দিয়েই তো একজন বাবার আবির্ভাব হয়েছিল নিগৃহীত নিষ্পেষিত মা কে আগলে রাখার জন্য। কবিতাটির দুটো অর্থ দাঁড় করানো যায় অনায়াসে। একটা নিছকই পারিবারিক সাদামাটা বাবার দিনপঞ্জি। অন্যটি রূপকার্থে বাবা, দেশ, জাতির অভিভাবক, অসাধারণ এক বাবার আত্মত্যাগ। একটি আটপৌরে কবিতা বিষয়বুননগুণে এক অভাবিত সুন্দরে প্রতিস্থাপিত হতে পারে, যা পাঠ করলে বোঝা যায়। কবিতাটি সুন্দরের সওগাত মেলে দিয়ে অর্থ ও দর্শনের নিরাভরণ সৌন্দর্য চেতনায় প্রস্ফুটিত বিশ্বাস।