যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কৌশলে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে রাশিয়া, চীন, ইরান

9

 

যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া, চীন ও ইরান ধীরে ধীরে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়া বিশ্বে হাতেগোনা যে কয়েকটি দেশের সমর্থন পেয়েছে তার মধ্য অন্যতম চীন। তা ইউক্রেন যুদ্ধের আগে সীমাহীন কৌশলগত অংশীদারিত্বের ঘোষণা দিয়েছে শক্তিশালী দেশ দুটি। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বেইজিংয়ে শীতকালীন অলিম্পিকে নিজেদের সম্পর্ক ঝালাই করে নিয়েছে চীন ও রাশিয়া। সে সময় এই দুই দেশ ‘অভিন্ন শত্রæ’ যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবেলায় ‘বন্ধুত্ব ও কৌশলগত অংশীদারিত্বের পথ’ সুগম করাও ঘোষণা দিয়েছিল। একইভাবে রাজনৈতিকভাবে পুতিনের একঘরে অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে কাজে লাগানো সম্ভব, এমন উপলব্ধি গুটিকয় নেতার মধ্যে হয়েছে। এর মধ্যে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি অন্যতম। ইউক্রেন যুদ্ধে লড়তে পুতিনকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে ইরান। কয়েক দশক ধরে বেইজিং ও তেহরানের নিজস্ব একটি কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, যা দিন দিন গভীরতর হচ্ছে।
তবে ওয়াশিংটন এখনও বৈরী শক্তিগুলোর দৃঢ় জোটের মুখোমুখি হয়নি। কিন্তু, আগামীতে হবে না সে নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। বিশেষত আলোচিত তিনটি দেশই যখন আমেরিকার চরম বিরোধী এবং প্রতিনিয়ত এক হচ্ছে তাদের স্বার্থের যোগসূত্র।
যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক আধিপত্য ধরে রাখতে বিশ্বের অনেক দেশের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক জোট গড়েছে। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সহযোগিতার এটাই সর্বোচ্চ মানদÐ তার কাছে। এজন্য বিশ্বের নানান প্রান্তের মিত্রদের সাথে ডজন ডজন চুক্তি করেছে ওয়াশিংটন। এসব চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের চেতনায়, জোট গঠন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কিছু ধারণারও জন্ম দিয়েছে। যেমন মার্কিনীরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা-দৃঢ় অঙ্গীকারমূলক চুক্তি দ্বারা নির্ধারিত। দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভিন্নতা যার উৎস। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের গঠিত সমর জোটগুলি একাধিক ক্ষেত্রে নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একত্রে কাজ করে। যেমন- চীন ও রাশিয়ার মতো প্রতিদ্বন্দ্বী মোকাবিলাসহ এর আওতায় মিত্র দেশের বাহিনীকে প্রশিক্ষিত করা, প্রতিরক্ষার পরিকল্পনা ও একসঙ্গে সমর অভিযান পরিচালনায় সক্ষমতা গড়ে তোলা হয়।
মার্কিন জোটগুলিকে তুলনামূলক দীর্ঘস্থায়ী: যেমন নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন (ন্যাটো) এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে করা নিরাপত্তা চুক্তিসমূহ, যেগুলি অনেক প্রজন্ম ধরে কার্যকর রয়েছে। সে তুলনায়, ততোটা মর্যাদার জাগায় না ইরান, চীন ও রাশিয়ার সম্পর্ক। এই দেশগুলি একে-অপরকে রক্ষায় প্রকাশ্য কোনো ঘোষণা দেয়নি। পরস্পরের সাথে তাদের সম্পর্কও অবিশ্বাসে ঘেরা।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ইউক্রেনের রণাঙ্গনে রাশিয়াকে একলা ছেড়ে দেয়ায় নিঃসন্দেহে ক্ষুব্ধ পুতিন। অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বী তেহরান ও মস্কো। সে তুলনায়, যুক্তরাষ্ট্রও যুক্তরাজ্য একে অপরের শত্রুতে পরিণত হবে- এমন ভবিষ্যৎ কল্পনা করাও কঠিন। অন্যদিকে, স¤প্রসারণবাদী অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলো এক পর্যায়ে একে-অন্যের গলা কাটতে উদ্যত হবে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে সহজেই সে অনুমান করা হয়।
কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্র মিত্রতার যে সংজ্ঞায় বিশ্বাসী তেমন মিত্র নয় রাশিয়া, ইরান ও চীন। হয়তো তাদের তা দরকারও নেই। চীন ও রাশিয়ার অংশীদারিত্ব প্রধানত ক্রমবর্ধমান অস্ত্র বাণিজ্য, যৌথ সামরিক মহড়া ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা নির্ভর। মধ্য এশিয়ায় অগণতান্ত্রিক সরকারগুলিকে টিকিয়ে রাখতে একাট্টা মস্কো ও বেইজিং, যা দুর্বল করছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রচেষ্টা। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো উভয় দেশ একদা তাদের মধ্যে উত্তেজনার কারণ হয়ে থাকা অনেক বিষয়ের সমাধান করতে পেরেছে, যাতে তারা অভিন্ন শত্রু যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বৈরিতায় মনোযোগ দিতে পারে।
রাশিয়া ও চীন উভয়ই ইরানের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক কামনা করে। ২০১৫ সালে সিরিয়ায় সামরিক মিত্র হয়ে ওঠে রাশিয়া ও ইরান। বাশার আল আসাদ সরকারের পতন ঠেকাতে সেনা পাঠায় তারা। এর মাধ্যমে মার্কিন চালকে বাজিমাৎ দেয় ভূরাজনীতির দাবায়। দীর্ঘদিন ধরেই রাশিয়া ও চীনের দেয়া সমরাস্ত্র ইরানি সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করছে; তাদের সাথে অর্থনৈতিক ও ক‚টনৈতিক সম্পর্কের বন্ধন তেহরানকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আঘাত লঘু করার শক্তি দিয়েছে।
২০২১ সালে ইরানের সাথে ২৫ বছর মেয়াদী কৌশলগত অংশীদারিত্বের চুক্তি করে চীন। রাশিয়া-ইরানের সম্পর্ক আরও উল্লেখযোগ্য। প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ইউক্রেন যুদ্ধে লড়তে মস্কোকে ড্রোন দিচ্ছে ইরান। এতে মস্কো বেশ উপকৃতই হচ্ছে।
অন্যদিকে, ইরানের কৃত্রিম উপগ্রহ প্রকল্পে উদার সহায়তা দিচ্ছে রাশিয়া। খাদ্যশস্য কেনার ক্ষেত্রে দিচ্ছে অগ্রাধিকার।
মস্কো, তেহরান ও বেইজিং একে-অন্যের লড়াইয়ে লড়তে চায় না বটে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রযুক্তি ও আর্থিক শক্তিতে বলীয়ান পরাশক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে হলে ‘সংখ্যাতেই শক্তি’ এই পরীক্ষিত সত্যকে মেনে চলছে। বিশ্বের একাধিক প্রান্তে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে তারা যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিকে ব্যতিব্যস্ত রাখতে পারে।
এবার ইউক্রেন ইস্যুতেও ‘বন্ধু’ রাশিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছে চীন। এরই মধ্যে চীন ইউক্রেনে রুশ হামলার নিন্দা জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। উল্টো যুক্তরাষ্ট্রকেই উত্তেজনার আগুনে ঘি ঢালার জন্য দুষছে চীন। এছাড়া দুপক্ষকেই ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছে এশিয়ার পরমাণু শক্তিধর দেশটি।

লেখক : সাংবাদিক