মায়ের বিস্ময়কর আশীর্বাদ

27

 

‘মা’ হচ্ছে কার চিহ্ন যুক্ত একটি মাত্র বর্ণ বা অক্ষর, যা একটি শব্দও বটে। কিন্তু একটি মাত্র শব্দের সাথে, লক্ষ লক্ষ শব্দ যুক্ত করেও মা শব্দটির বিশালতার সাথে তুলনা করা যায়না। মর্মস্পর্শী সুমধুর এই মা শব্দটিতে রয়েছে অফুরন্ত ভালোবাসা অনিঃশেষ আশীর্বাদ। কোন মায়ের এমন আশীর্বাদের কথা দেখে বা লেখে বর্ণনা করার বিষয় নয়, অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে অনুভব করতে হয় অনুধাবন করে নিতে হয়। তারপরেও আমার প্রয়াত মায়ের বিস্ময়কর এক আর্শীবাদ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আকারে উপস্থাপনের চেষ্টা করব। কারণ এমন বাস্তবতা জেনে অনেক অবাধ্য অবোধ সন্তানের, মায়ের ভালোবাসা ও দুর্লভ আশীর্বাদ সম্পর্কে উপলব্ধি করার সক্ষমতা অর্জিত হবে। সেইদিন বিস্ময়কর অবিশ্বাস্য মায়ের আর্শীবাদটুকু পেয়ে, আমিও চরম সত্য উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়েছি যে, মা জীবিত থাকুক আর নাই থাকুক, মায়ের আশীর্বাদ সর্বদাই চলমান। গত বেশ কয়েক বছর আগের কথা। সুনির্দিষ্ট তারিখ এই মুহূর্তে মনে নাই, তবে মনে আছে জনপ্রিয় ইসলামী চিন্তাবিদ মওলানা শাইখ নুরুল ইসলাম ফারুকী হত্যার কারণে সেই দিন ইসলামি ফ্রন্ট ও বাংলাদেশ আহলে সুন্নাত কর্তৃক সকাল থেকে ২৪ ঘন্টার হরতাল ঘোষণা করা হয়েছিল। এখানে তাদের অনেক সমমনা সংগঠন সমর্থন দেয়ায় এই হরতাল আরো জোরালো হয় এবং শতভাগ সফলতা পায়। দেশে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে, শত শত হরতালের অভিজ্ঞতা আমার এবং আমাদের রয়েছে। আবার হরতালে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট বা চান্দগাঁও আবাসিক থেকে বোয়ালখালীর চরণদ্বীপ পর্যন্ত ১০/১২ কিলোমিটার পথ হেঁটে পাড়ি দিয়ে যাবার অভিজ্ঞতাও রয়েছে। ঘন ঘন হরতালের কারণে বন্ধু বান্ধবদের সাথে গল্প করে দীর্ঘপথ হাঁটার একপ্রকার সক্ষমতা অর্জন করেছি বলা যেতে পারে। অন্যান্য হরতালে রিক্সা বা সীমিত আকারে যানবাহন চলাচল থাকলেও ইচ্ছাকৃত ভাবে বন্ধুদের সাথে নিয়ে, হেঁটে গল্পে আনন্দে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছি। কিন্তু ঐদিন একত্রিত হওয়া বহু ইসলামি ঐক্য জোট সমর্থিত হরতালে, চান্দগাঁও আবাসিক থেকে পূর্বকালুরঘাট পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছি বাধ্য হয়ে। কারণ একটি সাইকেল পর্যন্ত চলতে দেয়া হয়নি। এমনকি অনেক জায়গায় মানুষ হেঁটে চলাফেরায় পর্যন্ত বাধা দেয়া হয়েছিল। এমনিতে সেইদিন আমার জ্বড় ছিল আবার সঙ্গী কাউকে না পেয়ে হাঁটতে হয়েছিল একা। বিভিন্ন সময় হরতালে দেখেছি পুলিশের ব্যাপক সক্রিয়তা। কিন্তু এই হরতালে পথে ঘাটে মাঠে পুলিশের কোন প্রকার তৎপরতা না থাকায় বা কোন ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় অনেকে এটাকে ‘সরকারি হরতাল’ অর্থাৎ সরকার সমর্থিত হরতাল হিসাবে আখ্যায়িত করেছিল!
যাই হোক যে কথা বলছিলাম, ঐদিন কিছুটা অসুস্থ থাকার সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে হেঁটে গিয়েছিলাম, অন্ততপক্ষে আসার সময় গাড়িতে করে বাসায় ফিরতে পারবো বলে। সকল প্রকার কঠিন হরতালেও বিকাল হলে বা সন্ধ্যার পরে সীমিত আকারে গাড়ি চলতে দেখা গেছে। কিন্তু সেদিন দেখি প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, তারপরেও কোন প্রকার যানবাহন নেই। যদিও শেষবেলায় মাঝে মধ্যে দুই চাকার দুয়েকটা সাইকেল, মোটর সাইকেল দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু তিন-চার জন করে সহযাত্রী। তাই আমি যাবার মত কোন প্রকার গাড়ি না পেয়ে, হেঁটে কালুরঘাট টোল অফিস পর্যন্ত যাবার চেষ্টা করি। কিছুদূর যাবার পর ব্যর্থ হয়ে একটি গাছের নিচে বসে পড়লাম। জ্বরের কারণে হাত পা কেমন জানি ভেঙ্গে পড়ছিল। তখন দিনের হাল্কা আলো থাকার সত্ত্বেও চোখে কেমন জানি কালো অন্ধকার দেখছিলাম। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করলাম, কেউ যদি সাইকেলে করে যায়, তাকে অনুরোধ করে হলেও পিছনে উঠে কিছু পথ এগিয়ে যেতে পারবো ভেবে। কিন্তু দুয়েকটা দুই চাকার গাড়ি দেখা গেলেও গাড়িতে কমপক্ষে তিন জন করে মানুষ যাচ্ছে!
এই অবস্থায় চরম হুতাশাগ্রস্ত হয়ে দুনিয়াকে দূবির্ষহ মনে হচ্ছিল। এমন সময় হঠাৎ আমার প্রয়াত মা স্মরণে এলো। ভাবলাম, এমন অসুস্থ আর হেঁটে যাওয়া কথা, মা জীবিত থাকলে পাশে বসে এই চরম সমস্যার কথা বলতে পারতাম। মা থাকলে শত স্নেহমমতা জড়ানো শব্দে, আবেগ আপ্লুত কন্ঠে কত না দুঃখ প্রকাশ করতো, কতনা আদর যত্ন করতো। এই অবস্থায় একেক করে অতীতের সকল স্মৃতি মনে পড়ছিল। উল্লেখ্য আমার মা বিশ্রামে বা অবসরে থাকলে মাকে জড়িয়ে আমাদের কথা বলার অভ্যাস ছিল এবং মায়ের স্নেহমমতার পরশ পেতে মন ব্যাকুল হত। এই দিকে ‘মা’ না থাকার বিষয়টি অনুভব করে দুফোটা অশ্রু কপোলে গড়িয়ে পড়ল। এমন সময় হঠাৎ শুনতে পাই পকেটে মোবাইলফোনের রিং বাজার শব্দ। মোবাইল পকেট থেকে নিয়ে দেখি, সারোয়াতলী পিসি সেন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক কামরুল হাসান ভাই রিং দিয়েছে। কামরুল ভাইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার সত্ত্বেও সেই সময় শারীরিক মানসিক অশান্তির কারণে বিরক্তবোধ করে কল রিসিভ করলাম না। কারণ এর আগেও কয়েকজন মোবাইলে কথা বলেছে, তারা হয় দাপ্তরিক বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত চেয়েছে, না হয় হরতালের অবসরে খোশ গল্প করতে চেয়েছে। এই অবস্থায় দেখি কামরুল ভাইয়ের পুনরায় রিং! অসুস্থতা ও অশান্তির কারণে অনিচ্ছার সত্ত্বে রিসিভ করলাম। অপর প্রান্ত থেকে কামরুল ভাইয়ের জিজ্ঞাসা ‘দাদা, আপনি কোথায়?’ আমি বললাম ‘কি জন্যে?’ উনি বললেন, ‘আগে বলেন না ভাই কোথায়?’ আমি বললাম, ‘সমস্যায় আছি, কোন প্রকার গাড়ি পাচ্ছিনা পূর্বকালুরঘাট বাদাম তলে বসে আছি।’
উনি বললেন, ‘অপেক্ষা করেন ৫ মিনিটের মধ্যে আসতেছি এক সাথে যাব’ এই বলে সংযোগ কেটে দিলেন। এদিকে আমি অবাক হয়ে গভীর ভাবাবেগে মগ্ন, তা কি করে সম্ভব? তাহলে কি আমার মাকে স্মরণ করার সাথে সাথে আমার যাবার ব্যবস্থা হয়ে গেল! কামরুল হাসান ভাইতো আগে কোন দিন কোন সময় আমাকে এইভাবে ডেকে নেয়নি; কিংবা একই সাথে যাওয়া আসার নজীরও নাই। তাঁর বাড়ি নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলায়। আমার বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলায়। তাই তিনি শৈশব কৈশোরের বন্ধু নন; আবার তাঁর ছেলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস ইন্টার্নশিপ করছে আর আমার মেয়ে স্কুলে, অর্থাৎ আমরা সমবয়সীও নয়। এছাড়া আজকে এমন যাতায়ত সমস্যার মধ্যে তাঁর সাথে কেউ না কেউ থাকার কথা, কারণ উনার সাথে অনেকের সম্পর্ক বা বন্ধুত্ব আছে। এভাবে বিভিন্ন কল্পনাজল্পনার সময়, মিনিট দশেক এর মধ্যে তিনি মোটর সাইকেল নিয়ে চলে এলেন। হ্যান্ডশেক করেছি বটে, কিন্তু কেমন আছেন বা কুশল বিনিময় না করে সরাসরি জানতে চাইলাম, ‘আপনি কেন আমাকে হঠাৎ করে এইভাবে ডেকে নিচ্ছেন আজ, আগে তো কোন দিন নেননি?’ তিনি বললেন, ‘আগে গাড়িতে উঠেন তারপর বলছি’ এইদিকে আমি গাড়িতে উঠলাম আর তিনি বললেন, ‘আজ তো একটি গাড়িও চলছেনা, কানুনগোপাড়া আসার পর হঠাৎ আপনার কথা মনে পড়ল, ভাবছিলাম আপনি যদি এখানে আসেন, এত্ত বড় হরতালে বাসায় যাবেন কি করে? সাথে সাথে গাড়ি থামিয়ে রিং দিলাম।’ উনার কথা শুনার পর আমিও আজকে এমন সমস্যা আর আমার মাকে স্মরণ করার বিষয় উল্লেখ করলাম। তিনিও খানিক বিস্মিত হলেন এবং বলেন, ‘আশ্চর্য ব্যাপার! আমার গাড়ি করে রহিমউল্লাহ সাহেব আসতে চেয়েছিল, কিন্তু তাকে বলেছি গাড়ির চাকার সমস্যা আছে, তাই দুজন যাওয়া যাবেনা। অথচ আপনাকে কেনই বা ডেকে নিলাম বুঝে উঠতে পারছিনা!’
অবশেষে বিভিন্ন কথা বলতে বলতে আর শুনতে শুনতে একেবারে বাসার সামনে পৌঁছে গেলাম, অতঃপর তিনি নামিয়ে দিয়ে নিজের বাসায় চলে গেলেন। এই হচ্ছে সেই দিন আমার প্রয়াত মায়ের আশীর্বাদ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার মায়ের আশীর্বাদে সেই দিন এমন কঠিন সমস্যার সমাধান হয়েছে। উল্লেখ্য জীবিত অবস্থায় আমার মা আমাকে খুবই ভালোবাসতেন, অতিমাত্রায় পছন্দ করতেন। বুঝে নিলাম প্রয়াত অবস্থায়ও মা’র ভালোবাসা স্নেহমমতা এক রত্তিও কমেনি।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট