মায়ের দু’টি অমূল্য কথা

38

শীতের সকাল। গ্রামে শীত বেশি। শহরে মানুষে মানুষে গাদাগাদি তাই অতো শীত মালুম হয় না। লকডাউনের আগে আমি সারাটা জীবন শহরে কাটিয়েছি। কখনো আমাকে গ্রামে ফিরতে হবে, চাষে হাত লাগাতে হবে কল্পনা করিনি। আমরা যখন খুব ছোট আমার আম্মা দুইটি কথা বেশি বেশি বলতেন, ১. পড়ালেখার পাশাপাশি ঘর-গেরস্তের কাজ করতে শিখো। ২. পড়ালেখা করার সাথে ছোট-খাটো একটা চাকরি-বাকরি করলে ভালো। দুইটির কোনটায় আমাদের বুঝে আসতো না। দ্বিতীয় কথাটি বুঝতে পারি পড়াশোনা শেষ করে মাত্রই যখন অল ফার্স্ট ক্লাসের গৌরব মাথায় নিয়ে চাকুরি খুঁজতে নামি তখন। চাকরির বাজারে ঢুকে দেখি অফিস পিয়ন থেকে অফিসের ম্যানেজার সব চাকরিতে বাস্তব অভিজ্ঞতা লাগে । পাঁচ বছরের কোন কোন ক্ষেত্রে আরো কম বেশি আছে। সদ্য স্নাতক পাস করা ছেলেটি কি করে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা পাবে! কিন্তু কথাটি অফিসের কর্তাদের বুঝার সময় ছিলো না। তাদের সার্ভিস দরকার। আপনার আমার ফার্স্ট ক্লাস আর থার্ড ক্লাসে তাদের কি আসে যায়! তাদের সার্ভিস দরকার। প্রফিট দরকার, বেনিফিট দরকার। ফার্স্ট ক্লাস মাথা দরকার, ফার্স্ট ক্লাস রেজাল্ট দরকার নেই। অথচ ফার্স্ট ক্লাসের জন্য আমাদের কি অহংকার। ফার্স্ট ক্লাসের ছেলেরা সেকেন্ড ক্লাসের ছেলেদের দেখে নাক মুচড়াতো, কপালে ভাঁজ ফেলতো। থার্ড ক্লাসকে পাশেই ঘেঁষতে দিতো না। আহারে ফার্স্ট ক্লাস! তখনি বুঝতে পারি মায়ের কথার মূল্য। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে রাতের পর রাত জেগে পড়াশোনা করতাম। ভাবতাম পড়াশোনা শেষে বুঝি একখানা ভালো চাকরি জুটানো খুব মুশকিল হবে না। বাস্তবতা দেখতে গিয়ে হোঁচট খেলাম। তারপর শুরু হলো চাকরির তদবির। যখন পড়াশোনায় ছিলাম তখন গ্রামের কত বড় ভাই, কাকা-মামা পিঠ চাপড়ে বলতেন সাবাশ। পড়াশোনাটা ভালো করে শেষ করে আমার কাছে সার্টিফিকেটটা নিয়ে দেখা করো। যখন তাদের আশায় পড়াশোনা শেষ করে তাদের দুয়ারে গেলাম তারা শোনালো ‘অভিজ্ঞতা আছে! আসলে বুঝোই তো এই যুগে পড়ালেখা এক জিনিস কাজের অভিজ্ঞতা আরেক জিনিস। তাই আসলে অভিজ্ঞতা ছাড়া পারছি না ভাই আসতে পারো।’ অনেক অফিস ঘুরে কয়েক ডজন জুতা ক্ষয় করে একটা কেরানির চাকরি জুটাতে পেরেছিলাম। জানুয়ারিতে যোগ দিয়ে মার্চে বিদায়। করোনার থাবায়। চাকরির ভরসায় নতুন বউ এনেছিলাম ঘরে। এখনো বিয়ের মেহেদি যায়নি হাত থেকে তার মধ্যেই এই দুর্দশা। কি যে করি! তল্পিতল্পা গুটিয়ে গ্রামের বাপ দাদার ভিটেয় আশ্রয় নিলাম। প্রথম মাসটা কাটলো যেনোতেনো। তারপর তো আর চলে না। তখন আমাদের গাঁয়ে ফসল কাটার ধুম পড়েছে। সাতশো টাকা রোজ। কম কিন্তু না। আমি যদি হাতের কাজ জানতাম তাহলে আজ কাজে লাগতো। তখন আমার মায়ের প্রথম কথাটা আমার মাথায় ঘুরছিলো। দুবেলার আহার এক সময় এক বেলা হলো । তারপর এক বেলার খাবার আধ বেলা। বউয়ের ঘ্যানঘ্যানানি প্যানপ্যানানিতে অতিষ্ঠ জীবন। জীবনটা বেদনা। কেউ দেয় না একটু সান্ত্বনা। একদিন বউয়ের কথা মতন ওর স্বর্ণ বেচে একটা মাছের খামার করি। খুব কষ্ট হচ্ছিল নিজেকে কাপুরুষ মনে হচ্ছিল। কখনো বউয়ের গয়না বেচার মতন দুর্দিন আসবে কল্পনা করিনি। দুই বিঘার একটা পুকুর লিজ নিয়ে নিলাম পাঁচ বছরের জন্য। পঞ্চাশ হাজার টাকায়। সেখানে মেরামত বাবদ আরো ত্রিশ হাজার টাকা খরচা হলো। বাজার থেকে চড়া সুদে মাছের পোনা কিনে নিলাম। ছয় মাস পর যখন পুকুরে জাল ফেললাম । খুবই হতাশ হলাম। কুধুৃ কপাল চাপড়ে যাচ্ছিলাম। আসলে তখন কপাল চাপড়েও লাভ নেই। বউয়ের শখের স্বর্ণালংকারও খাওয়া হয়েছে। মায়ের বাপের বাড়ির এক টুকরো জমি ছিল সেটাও বেচে দিয়েছিলাম। আর কোথাও কিচ্ছু নেই বেচার। কি করি! কি করি! তখন ভাবতে ভাবতে অস্থির । আমার বউ আমাদের বাসায় থাকতে শখ করে একুরিয়ামের মাছ নিয়েছিল ড্রইং রুমে সাজিয়ে রাখবে বলে। এখন তো আর শখের কিছুই নেই। ও তাই মাছগুলো হেঁয়ালি করে চাষের পুকুরে ফেলে দিল। মাস না যেতে আমার পুকুর ভরে গেলো লাল নীল একুরিয়ামের মাছে। আমরা দুইজনই অবাক! ওয়াও! দারুণ খবর। একুরিয়ামের দোকানে যোগাযোগ করে মাছগুলো বেচতে লাগলাম চড়া দামে। আমাদের টাকা এখন অভাব নেই। সুদিন বুঝি ফিরছে। সবার আগে আমি বউয়ের স্বর্ণালংকারগুলো ফিরিয়ে দিলাম। তারপর আরো কিছু টাকা দিয়ে আরো সাত বিঘা পুকুর লিজ নিলাম। সেখানেও এই মাছের চাষ করতে লাগলাম। সেখানেও লাভে লাভ। আমার বউয়ের মাথায় বুদ্ধি এলো একটা । সে নিজেই একটা একুরিয়ামের দোকান খুলে বসলো। এখন বাইরে বেচার পাশাপাশি আমাদের দোকানেও বেচতে লাগলাম। বাইরের চেয়ে দোকানে দ্বিগুন লাভ হলো। অনলাইনে শপ খুললে কেমন হয় বউকে বললাম। ও বললো বেশ তো। অনলাইনে আমরা একটা শপ খুললাম। অনলাইনে প্রথমে কম চলতো। পরে এক সময় অনলাইন শপ বন্ধ করে দেবো এমন সিদ্ধান্তে চলে এসেছিলাম প্রায়। তখন জার্মান প্রবাসি একজন জানতে চাইলেন আমরা জার্মানে এই মাছ দিতে পারব কিনা। আমার বউ সাহস করে রাজি হলো। এখন শুধু দেশে না ইউরোপেও আমাদের ব্যবসা চলে। আমরা চাইলে শহরে একটা বিশাল ফ্ল্যাট কিনতে পারি। তবে কিনছি না। গ্রামই আমাদের জন্য পয়া। আসল ঠিকানা। তাই গ্রামেই আমাদের ভাগ্য খুলেছে।
সকাল বেলা শীত খুব অনুভূত হয়। সেই কাক ডাকা ভোরে আমরা দুইজন কাজে লেগে পরি। কাজের লোক আছে সত্তর জনের মতন। তারা যেরকম নাস্তা খায় আমরাও ঠিক তাই খাই। তাদের যেরকম এপ্রোন আমাদেরও সেরকম। আমাদের এখানে যারা কাজ করে তাদের সবাই পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করছে। সবাই তরুণ। সবাই খুব উদ্যমি। আমাদের এমন একটি টিম আছে বলেই হয়তো আমরা এগিয়েছি। কিংবা কিছুটা ভাগ্য। কিংবা প্রকৃতির কৃপায়। শীতের পর বসন্ত আসে।
তবে মায়ের দু‘টি কথা অমূল্য।