মায়াহীন আলোভোরে মমতা

18

 

মমতা ও মমতা, মম , ম-ম , কই গেলি? ছেমড়ি যে কই যায়! মরতে গেলি । মম ও-মম। বুড়ি ডেকে চলেছে থেমে থেমে। দাওয়ায় বসে এতোক্ষণ বাইরের দিকে চেয়ে ছিল মমতা। বুড়ির ডাক ঠিকই কানে গেছে তার। বুড়ির ওপর মাঝেমাঝে খুবই বিরক্ত হয় মমতা।বুড়ির একটা চোখ অনেক আগেই নষ্ট।ঐ চোখে দিনরাত সমান। আরেকটায় খুব একটা ভালো দেখে না। ঝাপসা ঝাপসা। অভ্যাসবশত অনেক কাজ করতে পারে বুড়ি। বয়স তো কম হলো না আর। খানিক থেমে আবার ডাকলো মম ও মম । কে আছিস রে একটু ধর দেখি।
মমতা বিরক্ত হয়ে উঠে গিয়ে বুড়িকে ঘরে নিতে নিতে ঘ্যান ঘ্যান করে বলে তোমার জন্য কাজকাম কিছুই তো করতে পারি না। এতো চেঁচাও কেন? এক জায়গায় বসলে কী হয়?
খানিক আগেও আকাশে মেঘ ছিল। দমকা বাতাসও ছিল খুব। এখন পাতাগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে।
বই হাতে জানালার পাশে বসে আছে মমতা। পড়ায় মন নেই আজ। সকাল থেকেই মনটা আলুথালু হয়ে আছে। ভীষণ এলোমেলো। বাইরের দিকে চেয়ে আছ সে। কালো মেঘে ছেঁয়ে আছে আকাশ। আবার কি বৃষ্টি নামবে তাহলে? জানালার পাশেই একটি ফুলগাছ। বেশ সুন্দর গন্ধ ছড়ায় হাওয়া পেলে। পাখি বসে । খড়কুটো, ঘাস, পাতা, ডাল যা পারে নিয়ে আসে। ঘর বানিয়ে ফেললো একদিন দেখতে দেখতে। মা পাখি বসে আছে চুপ করে সে ঘরে।
মমতার মায়ের কথা মনে পড়লো। এখন আর মায়ের মুখ মনে করতে পারে না। তাকে রেখে মা কোথায় যে গেল আর খোঁজ নিলো না কেউ। শুনেছিল বিদেশ গেছে। পেটে থাকতেই সাপের কামড়ে বাপ মারা গেল। বুড়িই তার সব। তার আপন। আর একটু বড় হয়ে দেখেছেন মাষ্টারকে,তার স্যার । সজল স্যার।
ঘরের কাজকর্ম খুব দ্রুত সেড়ে নেয় মমতা। গা গোসল ধুয়ে সে পরিপাটি হয়ে টেবিলে বসে অপেক্ষা করে স্যারের জন্যে। সজল স্যার তার খুব দেখভাল করে। বছরের বই, খাতা কলম সব জোগাড় করে নিয়ে আসে। মাঝেমধ্যে বিস্কিট, চকলেটও নিয়ে আসে। এটা সেটা থাকেই প্রায় সময়ে। খুব আদর করে স্যার। স্যারকে খুব ভাল লাগে। উনি না থাকলে অনেক কিছুই জানা যেতো না। যা অর্জন সব স্যারের কাছে রপ্ত করেছে।
বড় হতে হতে স্যারের আদর ভালোবাসা বেশ বুঝতে পারে প্রথম প্রথম একটু লজ্জাও পেতো। স্যার বলতেন এমন লজ্জা তো থাকেই। এসব তেমন কিছুই না। টুংটাং সাইকেলের শব্দে সোজা হয়ে বসে মমতা। এতো ঝড় বাদলেও স্যার এসেছেন দেখে খুশির ঝলক চোখেমুখে। টেবিলের এলোমেলো বইগুলো গুছিয়ে নেয়। চুলগুলো আরেকবার হাত দিয়ে ঠিকক করে নেয়। নিজের দিকে একবার তাকালো। মমতার বুকের ভিতর ইচ্ছেবুড়ি খেলা করছে। যেন ভিতরে ইচ্ছাগুলো ছুটাছুটি করছে। তোলপার হয়ে যাচ্ছে সেখানে। স্যারের সামনে কেমন যেন লাগছে আজ। বাইরে পাগলপারা হাওয়া। আর সে সাথে ঝমঝম বৃষ্টি। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দে মনে হয় আকাশটাকে ছিদ্র করে দিয়েছে কেউ। থেকে থেকে মিশমিশে অন্ধকারে বিজলিরেখা দেখা দিচ্ছে। এর আলো চোখে বেশ লাগছিল। পরক্ষণেই কানে লাগা শব্দ।
সজল স্যার ভিজে একাকার হয়ে আছে। গামছা এগিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মমতা। নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম। থেমে থেমে বাজ পড়ার শব্দে সম্ভিৎ ফিরে আসে। বোঝানোর চেষ্টা করলো নিজেকে। কিন্তু পারে না। একসময় স্যার নিজেই হাত বাড়ায় প্রেমে আকুল মমতা কোন বাধা দিতে পারে না। চোখে মুখে সম্মতির চিহৃ তার।
চারপাশে যেন বেজে উঠলো সুখের সানাই। টুকরো টুকরো সুরগুলো সে চোখে, মুখে, বুকে, ললাটে মেখে নিল। যেন নুুন বউ।
সেই কোন সকাল থেকে পথের দু’ধারে মাঠ-ঘাট, ঝোপ, জঙ্গল থেকে ঘ্যানর ঘ্যানর করছে একগাদা কোলাব্যাঙ। ওদের মনে খুব ফুর্তি। থপ থপ লাফাচ্ছে। হাওয়াও বইছে এলোমেলো । তাল, নারকেল, সুপারি— গাছগুলো নিজেদের মধ্যে কোলাকুলিতে ব্যস্ত। পাখিগুলো গায়ে গা লাগিয়ে চুপটি করে আছে। ছপাৎ-ছপ জলের ওপর ছোটাছুটি করে ছেলেগুলো গামছা হাতে মাছ ধরছে। বর্ষার সময় পুকুর, নালা, খালবিল উপচে যায় বলে অনেক মাছ এ’দিক ও’দিক পালায়। বেশ কিছুদিন ধরে বুড়ি মমতার হাবভাব কিছুটা টের পাচ্ছিল । কিন্তু গা করেনি। আলগাভাবে দু ‘একবার জানতে চেয়েছিল। মমতা এড়িয়ে গেছে। বুড়ি আর ঘাটে নি। অভাবের সংসারে যা হয়। মানুষ কত খারাপ কথা বলে বেড়ায়। কিছু ঘটে আবার কিছু হাওয়াই বেড়ায়। এইটাই হয়।
জানালায় দূরের দৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে আসে চোখ। অনেক দূরের পথ সরু হয়ে দেখা যায় । মফস্বলের বড় পথ পেরিয়ে মাইলের পর মাইল পার হয়ে এই অজ পাড়াগায়ে ঢুকতে হয়। আশেপাশের গাছপালার রং যেই মুহূর্তে গাঢ় সবুজ হয়ে যাবে, সেই মুহূর্তে একটু থমকে তারপর ঘন সবুজ বন, ঝোপঝাড়, গাছগাছালি পার হয়ে , ক্ষেতের আইল ডিঙিয়ে-ই আসতে হয় তাদের বাড়ি। বৃষ্টির কাদাপানিতে বিচ্ছিরি কান্ড। হাঁটু পানিতে বিল ছপছপ করছে। দেখে মনে হয় জলের উপর এক টুকরো বাড়ি। জানালার ধারে বসেই রইল মমতা। আগেরদিন রাতে যে বৃষ্টিটা শুরু হয়েছে তার পরির্বুন দেখা যায় না। আনমনে উল্টে যায় একের পর এক পৃষ্ঠা। শরীরের ভাব বুঝতে পারছে না। স্যার যদি না আসেন আর! কথাটা স্যারকে বলতেই স্যারের মুখের যে মলিনুা দেখতে পেলো ভয়ে চুপসে গিয়েছে সে। আর বলে গেলো ওসব কিছু না। সব ঠিক হয়ে যাবে দুশ্চিন্তাটা সেদিন কেটেছিল ঠিক , ভয় কাটেনি।
কিছুই আর ঠিক হলো না। নিজের পাওনা বুঝে নিল মমতা। সজল স্যার শেষ চিঠি লিখেছিল ‘ভালো থাকিস’। মাত্র দুটো শব্দ আর কিচ্ছু না। এই লেখাগুলোর প্রতি কী অসম্ভব টান যেন অক্ষরগুলো সঙ্গে জন্মান্তরের সম্পর্ক। একটা কাঠিন্যের খোলসে নিজেকে ঢেকে রেখেছিল এতোদিন। বের হতে গিয়েও পারে না সে। স্যার এদিকটায় আসা কমিয়ে দিয়েছে। সপ্তাহে বা দু’ সপ্তাহে একবার হয়তো আসেন । তাও কম। ভেতরটা কেবলি মোচর দিচ্ছে। অস্পুষ্ট শব্দ বুক ছিড়ে বেরিয়ে আসছে। সাইকেলের টুংটাং শব্দ শুনে আবার প্রাণ ফিরে পায়। লজ্জার দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে খুব।মমতার চোখেমুখে সেই-ই নেশা।
স্যার এসেই জানতে চাইলো কোন বিহিত হয়েছে কিনা। একটা ওষুধের পোটলা এগিয়ে দিয়ে বললো খেয়ে নিও। কাগজে সব লেখা আছে। কথার পিঠে কথা হয়। কথা কাাঁকাটি হয় দু’জনের। স্যার সোজা বলে দিলেন এসব সম্ভব নয় মোটেই। পাঁচ লোকে পাঁচ কথা শোনাবে। তার বিয়ে ঠিক করা আছে। আর কোনদিনও এ বাড়িতে আসবে না। এই শেষ আসা।
বাইরে প্রবল ঝড়। এসময় ঘর থেকে বের হাওয়া অসম্ভব। বাইরে আর মমতার ভিতরের ঝড় যেন একাকার। স্যারকে ধরে অঝোরে কাঁদলো। স্যারও কাঁদছে। এ যে অনেক বছরের মায়া জমানো মমতার সংসার। যাবার বেলায় একবারও পিছন ফিরে দেখলেন না। সাইকেলের টুংটাং শব্দ দূর দেখা ঝাপসায় মিলিয়ে গেল। একটা সম্পর্ক, এতোদিনের এতো মাখামাখি, এতো অপেক্ষা, সব এইখানেই শেষ!
সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারেনি মমতা। পোটলা নিয়ে বসে আছে। মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে আজ। তার ভিতরেও সে টের পাচ্ছে মায়ের আকুলতা।
ঠাঁয় বসে রইল দাওয়াই। আকাশ ভেঙে আবারও বৃষ্টি নেমেছে। চোখে মুখে বৃষ্টির ঝাপটা। দেখতে দেখতে পায়ের পাতা পানি ছুঁইছুঁই। নির্বাক যেন। এতো ঝড়ো হাওয়ায় একটুও কাঁপন ধরেনি। বিজলীর এতো আলোর ঝলকানিতেও সে শক্ত হয়ে আছে। এতো ঝড় যে খাল, বিল সব মিলেমিশে গেছে। উঠে দাঁড়ালো।
পোটলাটা সে বিলের জলে ফেলে দিয়েছে ।
রাত ফুরিয়েছে বটে কিন্তু আলো ফোটেনি ভালো করে।সারারাতের বৃষ্টির পর আলোর খেলা শুরু হলো। সে খেলায় আকাশ সিঁদুর রং মেখেছে। তার কিরণ গাছের পাতায়, বিলের জলে। পাখিগুলো খুব শব্দ করে ওড়াউড়ি করছে। ছোট ছোট পাখি অথচ গলায় খুব জোর। এদের কিচিরমিচির শব্দে মনে হচ্ছে পাওনা আদায়ের হিসেব চলছে ।
মমতা পেটের পিন্ডটাকে বাঁচাবার জন্য লড়াই করবে। তার স্যার তাকে শিখিয়েছিলেন বেঁচে থাকার প্রেরণা। স্যারের কথাটা আজ কাজে লাগাবে। মমতা ঘরে ঢুকে বুড়িকে এক নজর দেখে নিল। দাওয়া ছেড়ে কাদামাখা উঠোন পেড়িয়ে সে চলছে সামনের দিকে। কোন পথে যাচ্ছে জানে না। শুধু জানে এই বাড়ি, এই গ্রাম, শহর, দেশ ত্যাগ করতে হবে। যুদ্ধে যেমন সব ছেড়েছুঁড়ে গিয়ে মানুষ বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিল ঠিক সেভাবেই সে বাঁচবে। এটাও তার যুদ্ধ।
বুড়ির ঘুমঘোর ভালো করে কাটেনি। মনে হলো কে যেন ডাকছে তাকে। বুড়ি ডাক দেয় , মমতা ও মমতা। আর কতো ঘুম দিবি? শুনতে পাস না। ওঠ দেখি।
বুড়ি দরজা খুলে দাঁড়ালো। শোরগোলের শব্দগুলো ঠাওর করতে চেষ্টা করলো। রাতে ভীষণ ঝড় হয়েছে। অনেক ডাল ভেঙে পড়েছে। এতো চিল্লাচিল্লি, সর্বনাশ হয়নি তো ? বুড়ি বিড়বিড় করে ডাকে মম ও মম -।
কে যেন বলে গেলো উত্তরের পথে দেখেছে আলোভোরে।
বুড়ির হাতের লাঠিটা পড়ে গেল। গা ছেড়ে বসে পড়লো দাওয়ায়। শুধু অস্ফুটে বলে – মাষ্টার!