মাহবুব তালুকদার না সমস্যা ইসির ?

34

আসহাব আরমান

বর্তমান ইসির অধীনে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচন নিয়ে নানা মত, প্রতিক্রিয়া এসেছে রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন মহল থেকে। খোদ নির্বাচন কমিশিনার তরফ থেকেও বিভিন্ন মত ব্যক্ত করা হয়েছে। বিরোধী দলের অভিযোগ বর্তমান ইসির অধীনে নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি। ফলে ইসি ও নির্বাচনের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে মানুষ। ভোটাররা হচ্ছে নির্বাচনবিমুখ। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারও বিভিন্ন সময়ে তার নিজস্ব মতামত তুলে ধরেছেন। সম্প্রতি তিনি ইসি ও গোটা নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন। তার জবাবে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
গত রোববার নির্বাচন কমিশন ভবনে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের কাছে মাহবুব তালুকাদার বলেছেন নির্বাচন কমিশন (ইসি) এখন জটিল অসুখে আক্রান্ত। মেডিকেল বোর্ড গঠনের কোনো বিকল্প নেই। এই রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় গণতন্ত্রের অবস্থা সংকটাপন্ন। একক ডাক্তারের পক্ষে তাকে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে মেডিকেল বোর্ড গঠনের কোনো বিকল্প নেই। মৃত্যুপথযাত্রী গণতন্ত্রকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো একান্ত অপরিহার্য। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা গণতন্ত্রহীন নির্বাচন চাই কি না।
এ সময় সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিভিন্ন উপ-নির্বাচনে জনগণের নির্বচানবিমুখতা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, ৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম নগরের ১৬ নম্বর চকবাজার ওয়ার্ডের উপ-নির্বাচনে জামানত হারিয়েও একজন প্রার্থী কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। স্বভাবতই ওই নির্বাচনে ২১ জন প্রার্থীর সবাই জামানত হারিয়েছেন। এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যা বিশ্বে নজিরবিহীন। জনগণের নির্বাচনবিমুখতার বিষয়টি বিশ্লেষণ করে দেখা প্রয়োজন। ভোটার সংখ্যা বৃদ্ধির সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তবে এর প্রতিবন্ধকতা দূর না হলে কাক্সিক্ষত ফল লাভ হবে না।
আগামী নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে বিভিন্ন জনের তর্ক-বিতর্ক এখন তুঙ্গে। গত ৫০ বছরে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন নিয়োগের আইন প্রণয়ন করা হয়নি। এটা বাধ্যতাম‚লক হলেও সব ক্ষমতাসীন সরকার এটা লঙ্ঘন করেছে। সার্বজনীন ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা, জনগণের ক্ষমতায়ন ও গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা থাকলে এই আইন করা অনস্বীকার্য।
এদিকে মাহবুব তালুকদারের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, অবাক লাগে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের কমিশনার মাহবুব তালুকদার একটি দলের হয়ে যেভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন; তাতে মনে হয় ইসি নয়- তিনি নিজেই জটিল ও কঠিন মানসিক রোগে আক্রান্ত। বর্তমান ইসির মূল সমস্যা হচ্ছেন তিনি নিজেই।
অন্যদিকে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন ঢাকায় এক সেমিনার শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনাররাই বলছেন, তারা নিজেরা ভেঙে পড়েছেন। মাহবুব তালুকদার তো সবার সামনে বলেছেন। আরেকজন বলেছেন দেশের নির্বাচন যেভাবে হয়েছে ইউনিয়নে যেন সেভাবে না হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার তো কয়েকবার বলেছেন, আমি কী করব? ভোটকেন্দ্রে ভোটার আনা আমার কাজ নয়।
তিনি বলেন, কোনো দেশই বলবে না নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠু হয়েছে। যদি কোনো দেশের নাগরিকরা মনে করেন ৭০ ভাগ ভোট নিজেরা নিজেদের মনোনীত জায়গায় দিতে পরেছেন সেটাকে আমরা বলি সুষ্ঠু নির্বাচন। তবে নির্বাচন কমিশন একা সুষ্ঠু নির্বাচন করাতে পারবে এটা দুনিয়ার কেউ বলতে পারবে না। আমাদের দেশে বিচার বিভাগও নির্বাচন কমিশনকে সাপোর্ট করতে পারছে না। নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেওয়ার জন্য। কিন্তু গত দুই নির্বাচনে ইসির কর্মকান্ড ভোটাররা হতাশ হয়েছে।
এ বিষয়ে মতামত জানতে চট্টগ্রামের ৩ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে যোগগেযাগ হয়। সুজন চট্টগ্রামের সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চোধুরী পূর্বদেশকে বলেন, চকবাজারের নির্বাচন সারাদেশের নির্বাচনের চিত্রই বর্ণনা করে। চকবাজারে ৩২ হাজারের ভোটারের মধ্যে মাত্র ৭৮৯ ভোট পেয়ে কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়া নির্বাচন ব্যবস্থার জন্য বড় হুমকি।সাধারণ জনগণের মধ্যে এখন নির্বাচন নিয়ে অবিশ্বাস, অনাস্থা, ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণত পদে থেকে সবাই সত্য স্বীকার করেন না। কিন্তু এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। সম্প্রতি দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে দেওয়া তার বক্তব্য প্রশংসার দাবি রাখে। তিনি সাহসের সাথে সত্য স্বীকার করেছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজের জায়গায় থেকেই মন্তব্য করেছেন।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন পূর্বদেশকে বলেন, মাহবুব তালুকদারের পরিচয় ওনি নির্বাচন কমিশনার। নিজে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় নিয়োগ প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে সাধু বনে যাওযার সুযোগ নেই। তিনি নিজের বেলায় আইনজীবী পরের বেলায় বিচারক। নির্বাচন কমিশন যদি জটিল রোগে আক্রান্ত হয়, ওনি নিজেও আক্রান্ত। তাই প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসার আগে ওনার চিকিৎসা করা দরকার।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর পূর্বদেশকে বলেন, নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের বক্তব্য প্রশংসার দাবি রাখে। সাংবাবিধানিক পদে থেকে অনিয়মের বিরুদ্ধে বলার সাহস সবার থাকে না। আজকে সারাদেশে নির্বাচনের নামে প্রহসন চলছে। ভোটার ভোট দিতে পারছেন না। জনগণ এসব প্রহসনের নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কিন্ত এসব নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতার চেয়ারে বসে থাকতে নিজেদের মনগড়া বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে বর্তমান কমিশনের বিদায়বেলায় নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আলোচনা, মতামত ও প্রস্তাব দিচ্ছে বিভিন্ন মহল। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রশ্নবিদ্ধ কার্যক্রমে নির্বাচনের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে মানুষ। এ অবস্থায় আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলে সৎ, যোগ্য, নিরপেক্ষ ও সাহসী নেতৃত্ব নির্বাচন সম্ভব হবে না। গ্রহণযোগ্য ইসি গঠনে সংবিধান অনুযায়ী আইন পাস করতে হবে। আইনি প্রক্রিয়াতে যোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে ইসি গঠন সম্ভব।
তাদের মতে, যেসব দল নির্বাচনে অংশ নেবে তাদের মতামতের ভিত্তিতে নিরপেক্ষ ইসি বাছাই করা উচিত। সরকারকে নিরপেক্ষ ইসি গঠন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ, দেশে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক, সেটা দেশের সবারই প্রত্যাশা।