মানুষ বিকিকিনির হাট জমজমাট

35

তৈয়ব চৌধুরী, রাউজান

যুগ যুগ ধরে রাউজানের ঐতিহ্যবাহি ফকিরহাটে চলে আসছে মানুষ বিক্রির হাট। চলতি আমন চাষকে কেন্দ্র করে জমে উঠেছে বিক্রির হাট। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার ফকিরহাট বাজারের ডাক বাংলো এলাকায় বেশ কিছু মানুষের ভিড়। তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে কাজের সন্ধানে আসা মানুষ। ফকির হাটে সপ্তাহে দু’দিন রবিবার ও বৃহস্পতিবার সকাল ১০ থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শ্রমজীবী মানুষের হাট বসে এখানে। তারা হাটে আসে কাজের ডাকে। আবার আরেক শ্রেণীর মানুষ আসে তাদের কাজে ডেকে নিতে। চলতে থাকে দর কষাকষি। একবার বাড়ে, আরেকবার কমে।
এখানকার স্থানীয়রা তাদের বলে কাজের মানুষ। হাটের দিন ৭০ বছরের বৃদ্ধ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের শ্রমজীবী মানুষ তাদের এলাকায় কোনো কাজ না থাকায় দলে দলে ছুটে আসেন উপজেলার ফকিরহাট বাজারে কাজের সন্ধানে। উপজেলা ও ফটিকছড়ি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে আসা কৃষকরা কাজের জন্য শ্রমজীবীদের এখান থেকে দরদাম করে নিয়ে যায়। এসব মানুষ শ্রম বিক্রি করতে এ হাটে জড়ো হন। প্রায় শত বছর ধরে এখানে ভিড় করছেন কাজের সন্ধানে আসা মৌসুমী শ্রমিকরা।
জমি চাষ, ধান রোপণসহ নানা কাজে শ্রমিকদের দরদাম করে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাজ করতে শর্তসাপেক্ষে নিয়ে যায় জমির মালিক, গৃহস্থরা। স্বাধীনতার পর থেকে বাগেরহাট, কিশোরগঞ্জ, রংপুর, নেত্রকোণা, বরিশাল, হাতিয়া, স›দ্বীপ, মোল্লারহাট, নোয়াখালী, বাঁশবাড়িয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তারা ছুটে আসেন এ হাটে। দাঁড়িয়ে থাকেন কাজের ডাকের আশায়। এছাড়াও উপজেলার পথের হাট, নাতোয়ান বাগিচা, রমজান আলী হাট, জগন্নাথ হাট সহ সাধারণ বাজারেও সারা বছরজুড়ে চলে শ্রম বিকিকিনি। তবে ধানকাটা, ইরি-বোরো রোপা মৌসুমের সময় বেচাকেনার ধুম পড়ে যায়। ৪, ৮ ও ১০ জনের গ্রæপে ভাগ হয়ে দল বেঁধে জড়ো হন শ্রমিকরা। দর কষাকষি পর, সবকিছু ঠিকঠাক হলে ক্রেতার সঙ্গে তারা চলে যান। বাজারে ক্রেতার সংখ্যা বাড়লে শ্রমের দাম বেড়ে যায়।
হাটে আসা বেশ কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, তারা এখানে এসেছেন পেটের দায়ে, নিজেদের শ্রম বিক্রিতে। শ্রমিকরা জানান, এলাকায় কাজকর্ম নেই, অভাবে দিন কাটাতে হয় পরিবার-পরিজন নিয়ে। তাই কাজের সন্ধানে প্রিয় গ্রাম, পরিবার-পরিজন ছেড়ে অন্য জায়গায় কাজ খুঁজতে হয়। থাকতে হয় কৃষকের বাড়িতে। গৃহস্থ বাড়িতে তিন বেলা খাবার জোটে। প্রতিদিন ৭/৮ শত টাকা করে পারিশ্রমিক জোটে। তারা ধান কাটার মৌসুম শেষে বাড়ি ফেরেন। প্রতি মৌসুমে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা বাড়িতে পাঠাতে পারেন।
কৃষি শ্রমিক কবিরসহ আরও কয়েকজন জানান, কোনোমতে যাতায়াত খরচ জোগাড় করে এসেছেন তারা। বাজার মসজিদে আশ্রয় নিয়েছেন। মুড়ি-চিড়া খেয়ে কোনো মতে বেঁচে আছেন। রবি ও বৃহস্পতিবার হাট বসে।
এসএসসি পাস কাদের মোল্লার সঙ্গে কথা হয়। ১০ দিন আগে হাটের দিন এসেছিলেন সাগরসহ ৫ জন। প্রথমদিনেই বাগোয়ানের এক লোক তাদের কিনে নেন। প্রতিদিন ৭০০ টাকাসহ তিনবেলা খাবার পাচ্ছেন তারা। তবে খাটতে হয় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ক্রেতাদের সঙ্গেও কথা হয়।
হলদিয়া থেকে আসা কৃষক মাহাবুবুল আলম জানান, এলাকায় কাজের লোক পাওয়া যায় না। প্রতি মৌসুমে তিনি এ হাট থেকে চাহিদা মতো শ্রমিক নিয়ে কাজ করান। তবে এবার শ্রমের দাম একটু বেশি বলে জানান। এভাবেই ঐতিহ্যবাহি ফকিরহাট বাজার এখন শ্রম বিক্রির জমজমাট হাট হয়ে উঠেছে।