মানবতার কবি নজরুল

293

 

‘গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।’ (সাম্যবাদী- কাজী নজরুল ইসলাম)
সাম্যের কবি, মানবতার কবি, প্রেমের কবি, বিদ্রোহের কবি, রণতূর্যবাদক কবি, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। স্বল্পায়ু সক্রিয় জীবনের সীমিত পরিসরে নজরুল বহুমুখী প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন। তাঁর বর্ণিল বিষয়ে বিচিত্র লেখনীর মূল্যায়ন সময়সাপেক্ষ। এখানে কেবল তাঁর অসা¤প্রদায়িক মানবিক চেতনার দিকে একটু পলক বুলিয়ে নিতে চেষ্টা করবো।
আক্ষরিক অর্থেই অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদে প্রবলভাবে আস্থাশীল ছিলেন এই মহান কবি। তাঁর পুরো জীবনের আরাধনা ছিলো সত্য ও সুন্দর। তাই প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে তিনি বলতে পেরেছেন-
‘সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম। যে কূলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি।’ (প্রতিভাষণ: নজরুল ১৯২৯)”
তাঁর মন ও মননে কখনওই স্থান পায়নি সাম্প্রদায়িকতা। তিনি বিশ্বাস করেননি ধর্মের কারণে বিদ্বেষ ও রিরংসা। কখনও প্রশ্রয় দেননি কোন সংর্কীণতার পরিচয়কে। নারী-পুরুষ, ধনী-নির্ধন কোন ভেদাভেদ তাঁর কাছে বড় হয়ে উঠেনি মানুষের চেয়ে।
ধর্মীয় ভেদাভেদ, লৈঙ্গিক বৈষম্য, সামাজিক অসমতা, বর্ণবাদসহ সব অনাচারের বিরুদ্ধে তাঁর কলম ছিলো সদা গতিশীল।
নজরুল সুনির্দিষ্ট কোনো ধর্ম, দর্শন কিংবা জীবন চর্চায় স্থির থাকতে পারেননি দীর্ঘকাল; তবুও সকল ধর্মের সার্বজনীন মূল্যের প্রতি ছিল তাঁর প্রগাঢ় আস্থা। আর এই আস্থা তাঁকে হিন্দু কিংবা মুসলমানের কবি না করে, করেছে বাংলা ও বাঙালির কবি। করেছে মানুষের কবি, মানবতার কবি। তাই তো মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সকল সংগ্রামে এবং পরমত সহিষ্ণুতা প্রতিষ্ঠা ও ধর্মীয় সম্প্রীতি সাধনায় তাঁর কবিতা ও গান অসাম্প্রদায়িক মানুষকে যুগে যুগে যোগায় অসীম প্রেরণা।
তিনি দরদ ভরে নিজ ধর্মের জন্য যেমন লিখেছেন ইসলামি গান-গজল, হামদ-না’ত। আবার হিন্দুধর্ম মতে বিশ্বাসীদের জন্য কীর্তন-শ্যামাসঙ্গীত লিখতেও আবেগের এতটুকু কমতি ছিলো না তাঁর।
তিনিই লিখেছেন—
“তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে।
মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে।
যেন ঊষার কোলে রাঙ্গা রবি দোলে।”
(জুলফিকার)
এবং,
“পুণ্য পথের এসব যাত্রীরা নিষ্পাপ,
ধর্মেরী বর্মে সু-রক্ষিত দিল সাফ!
নহে এরা শঙ্কিত বজ্র নিপাতেও
কান্ডারী আহমদ, তরী ভরা পাথেয়।”
(খেয়াপারের তরণী)
আবার নজরুল লিখেছেন—
‘আমার কালো মেয়ের পায়ের নীচে
দেখে যা আলোর নাচন
মায়ের রূপ দেখে দেয় বুক পেতে শিব
যার হাতে মরণ বাঁচন
আমার কালো মেয়ের আঁধার কোলে
শিশু রবি শশী দোলে
মায়ের একটুখানি রূপের ঝলক
ঐ স্নিগ্ধ বিরাট নীল গগন।’ (বনগীতি)
এমনকি নজরুল তাঁর কাব্য উপমায় নিজের মাঝে যিশুখি “ষ্টের সম্মানের মহিমার পরশ বুলিয়ে নিতেও ভুলেননি।
লিখেছেন –
“হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান,
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান।”
(দারিদ্র্য)
কবি নজরুল সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের দিকে আঙুল তুলেছেন। তাঁর কবিতায় তিনি নারী-পুরুষের উর্ধ্বে এসে ঘোষণা করেছেন মানবতার বিজয়। দ্বিধাহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন-
“সাম্যের গান গাই/ আমার চক্ষে পুরুষ রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই।”
(নারী)
হিন্দু-মুসলমান মিলনের কথা যদিও গুরু নানক থেকে সাধক লালন সাঁই পর্যন্ত অনেকে বলেছেন। কিন্তু নজরুলের মতো জীবনে মননে অমন গভীরভাবে কেউ কি আর বলতে পেরেছে বলে আমাদের অজানা। নজরুলের মত সাম্প্রদায়িকতা ও ভেদবুদ্ধির বিরুদ্ধে সেই রকম করে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারেননি কেউ।
নজরুলের কবিতা, গান, কিংবা গদ্য লেখা কোনটাতে নেই মানুষের মহিমা ঘোষণা?
সব ধর্মের মহিমা ঘোষণা করে মেকি জাতপাতের বিরুদ্ধে তাঁর
“জাতের বজ্জাতি” কবিতায় তিনি উল্লেখ করেন:
“জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াৎ করছে জুয়া
ছুঁলেই তোর জাত যাবে?
জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া
……
জানিস নাকি ধর্ম সে যে বর্মসম সহনশীল
তাই কি ভাই ভাঙতে পারে ছোঁওয়া-ছুঁয়ির ছোট্ট ঢিল?
যে জাত-ধর্ম ঠুনকো এত
আজ না হয় কাল ভাঙবে সে তো।
যাক না সে জাত জাহান্নামে রইবে মানুষ নাই পরোয়া”
সকল সাম্প্রদায়িকতার প্রতি তাঁর ছিলো তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণামিশ্রিত অভিব্যক্তি।
তিনি উচ্চারণ করেছেন-
“মাদীগুলোর আদিদোষ ঐ অহিংসা বোল নাকি নাকি/খাঁড়ায় কেটে করমা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি/হান তরবার, আন মা সমর, অমর হবার মন্ত্রশেখা/মাদীগুলোকে কর মা পুরুষ, রক্ত দেমা, রক্ত দেখা।”
(আনন্দময়ীর আগমনে, নজরুল রচনাবলী, প্রথম খন্ড, পৃ:৩৩০)”
মানবজীবনের মৌলিক নীতিবাদের সাথে মহাত্মা গান্ধীর (মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী) অহিংস তত্তে¡র মিল থাকার কারণেই তিনি এ তত্ত্ব দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে নজরুলের প্রথম সাক্ষাত হয় হুগলিতে পরে ফরিদপুরে। তার অব্যবহিত পরে ১৯২১ সালে নজরুল গান্ধীর রাজনীতির একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবেও যুক্ত হন। এ সময় তিনি লিখেন: ‘এ কোন পাগল পথিক ছুটে এলো বন্দিনী মার আঙ্গিনায়।/ত্রিশ কোটি ভাই মরণ-হরণ গান গেয়ে তাঁর সঙ্গে যায়/অধীন দেশের বাঁধন বেদন/কে এলো রে করতে ছেদন? (পাগল পথিক, বিষের বাঁশি, নজরুল রচনাবলী, প্রথম খন্ড, বাংলা একাডেমি ১৯৮০ পৃ: ৯৬)”
নজরুল কেবল সাহিত্য রচনায়ই নয়, জীবনচর্চায়ও ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তাঁর সন্তানদের নাম রাখার বিষয়টিতেও তিনি অসাম্প্রদায়িক মনের পরিচয় দেন। নজরুল তাঁর চারজন সন্তানের নাম রেখেছিলেন হিন্দু মুসলমানের মিলিত ঐতিহ্য ও পুরানের আলোকে। তাঁর প্রথম সন্তানের নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণ মুহাম্মদ। বাকিদের নামকরণ করা হয়; অরিন্দম খালেদ, কাজী সব্যসাচী, কাজী অনিরুদ্ধ।
নজরুলের সাহিত্য সাধনা ও রাজনীতি বলতে গেলে পুরো জীবনদর্শনজুড়ে কেবল মানবতা ও মানুষের জয়গান। তাই তাঁর অন্তিম ফরিয়াদ –
“রবি শশী তারা প্রভাত-সন্ধ্যা তোমার আদেশ কহে-
‘এই দিবা রাতি আকাশ বাতাস নহে একা কারো নহে।
এই ধরণীর যাহা সম্বল,-
বাসে-ভরা ফুল, রসে-ভরা ফল,
সু-স্নিগ্ধ মাটি, সুধাসম জল, পাখির কণ্ঠে গান,-
সকলের এতে সম অধিকার, এই তাঁর ফরমান!’
ভগবান! ভগবান!