মাদকের ভয়াবহতা রোধ আইনের প্রয়োগ বাড়াতে হবে

9

 

মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন চলছে সারা দেশে। শুধু শহরেই নয়, প্রতিটি পর্যটন ও বিনোদনকেন্দ্র থেকে শুরু করে গ্রামে-গঞ্জেও ছড়িয়ে পড়েছে মাদক। তার বিষাক্ত ছোবল শেষ করে দিচ্ছে তারুণ্যের শক্তি ও সম্ভাবনা। সর্বনাশা মাদক ধ্বংস করে একটি মানুষের শরীর, মন, বিবেক ও তার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা পরিবারের সব স্বপ্ন এবং তার উজ্জ্বল ভবিষ্যত। শুধু পরিবারকে নয়, মাদকের কালো থাবা ধ্বংস করে একটি সমাজকে, একটি জাতিকে যা পরবর্তী প্রজন্মকেও হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। এরফলে তরুণরা অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ায় পিছিয়ে পড়ছে সমাজ। নেতৃত্বহারা হচ্ছে দেশ। বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন পথে, মাদক ঢুকে পড়ছে আমাদের সমাজে। আর ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের অবক্ষয়, প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির অসামঞ্জস্যতা, হতাশা এবং মূল্যবোধের অভাবের সুযোগ নিয়ে মাদক তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তরুণসমাজের প্রতি। সম্প্রতি কক্সবাজার সৈকতে বেড়াতে গিয়ে তিন তরুণের রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় উঠে এসেছে মাদকের সর্বনাশী আগ্রাসনের কথা।
বাংলাদেশ মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হলেও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে মাদকের সর্বাত্মক আগ্রাসনের শিকারে পরিণত হয়েছে। মাদকের স্বর্গরাজ্য গোল্ডেন ক্রিসেন্ট আমাদের দেশের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এবং আন্তর্জাতিক মাদকদ্রব্য উৎপাদনকারী অঞ্চল মিয়ানমার, লাওস এবং থাইল্যান্ডের সমন্বয়ে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত। এসব দেশ থেকে আন্তর্জাতিকভাবে মাদক পাচারের জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ট্রানজিট ব্যবহার করার কারণে মাদকের বিস্তার রোধ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি দীর্ঘসময় ধরে অতিমারি করোনা মহামারির সুযোগে সীমান্ত দিয়ে এসব দেশের মরণদ্রব্য মাদকের অবাধ প্রবেশের খবর দৈনিক পূর্বদেশসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আমরা মাদকমুক্ত একটি সমাজ প্রত্যাশা করি নিঃসন্দেহে। আশার কথা, বর্তমান সরকার মাদকের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর ও জিরো টলারেন্সের নীতি গ্রহণ করেছে। ২০১৮ সালে বর্তমান সরকার ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ স্লোগানকে সামনে রেখে যে অভিযান শুরু করেছিল, তা এখনও অব্যাহত আছে। এ অভিযানে দেশের আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাবাহিনীর যৌথ অংশগ্রহণ ছিল দৃশ্যমান এবং প্রশংসনীয়। প্রথমদিকে অভিযানে বেশ সফলতা দেখা মিললেও বর্তমানেও অভিযান অব্যাহত রয়েছে-এমনটি বক্তব্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে দেয়া হচ্ছে। তবে, দৃশ্যত এর কোন উল্লেখযোগ্য সফলতা দেখা যাচ্ছেনা। এ সুযোগ গ্রহণ করছে মাদক ব্যবসায়ী, পাচারকারী ও মাদকসেবীরা। আমরা জানি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় প্রত্যয় ছিল মাদকমুক্ত সমাজ ও দেশ গড়ার। তিনি কঠোর হুশিয়ারি দিয়েই মাদকবিরোদী অভিযানের নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমরা মনে করি, চলমান অভিযান আবারও কঠোর এবং গতিশীল হলে, দেশ মাদকমুক্ত হতে বেশি সময় লাগবেনা। তবে এর জন্য দরকার সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা।
বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, মানুষকে মাদকাসক্তির দিকে পরিচালিত করার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা, সামাজিক অস্থিরতা, উত্তেজনা, একঘেয়েমি, একাকিত্ব এবং পারিবারিক কাঠামো পরিবর্তনের পরিবেশে ব্যর্থতার সঙ্গে লড়াই করতে অক্ষমতা। তবে মাদকাসক্তদের সংখ্যা বৃদ্ধির মূল কারণ হলো মাদকের সহজলভ্যতা। দ্রুত নগরায়ণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ব্যাপক উন্নয়ন এবং ইন্টারনেট ও তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার, সামাজিক সচেতনতার অভাব ইত্যাদিও মাদকের সমস্যা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। পারিবারিক কলহ, ডিভোর্সের কারণে ভেঙে যাওয়া পরিবার, প্রেম ও চাকরিতে ব্যর্থতা থেকে হতাশার কারণেও মাদকাসক্তের হার বাড়ছে। বেশির ভাগ মাদক ব্যবহারকারী ‘পিয়ার প্রেশার’ বা বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়াকে প্রধান ‘পুল ফ্যাক্টর’ হিসেবে অভিযোগ করে থাকে। প্রথমবারের মতো মাদক গ্রহণের জন্য কৌতূহল অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে কাজ করে। এক্ষেত্রে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনকে আরো শক্তিশালী করার উদ্যোগের পাশাপাশি সৎসঙ্গ নির্বাচন করাটাই একজন উঠতি যুবকের জন্য বেশি প্রয়োজন। পরিবারের সদস্যরা সচেতন হলে, নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষা সঠিকভাবে দিতে পারলে মাদকাসক্তির সম্ভাবনা অনেকটা থাকবেনা। এছাড়া, খেলাধুলাসহ শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য বিভিন্ন প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে এখন থেকেই সব অভিভাবক তথা আমাদের সবাইকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।
মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশে প্রায় ৭.৫ মিলিয়ন মানুষ মাদকাসক্ত। সারা দেশে প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার মাদক ব্যবসায়ী তাঁদের ব্যবসা পরিচালনা করছেন, যাঁদের মধ্যে ২৭ হাজার ৩০০ জন মহিলা। ২০১৯ সালে গড়ে প্রতিদিন ১১৪ জন রোগী সরকারি ও বেসরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্রে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ১০৪ এবং ২০১৭ সালে ৬৯। এটাও অবাক করার মতো বিষয় যে ২০১৯ সালে মহিলা মাদকসেবীদের সংখ্যা চার গুণ বেড়েছে।