মহান সাধক স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরী

820

 

বাঁশখালীর ছায়া সুনিবিড় শান্ত সুশীতল বাণী গ্রাম। এ গ্রামে জন্ম নিয়েছেন স্বর্ণযুগের রূপকার শিবকল্পতরু শ্রীমৎ স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরী মহারাজ। পিতার নাম প্রতাপ মিত্র চৌধুরী এবং মাতার নাম শচী দেবী। তাঁদের কোল আলো করে ৪ জ্যেষ্ঠ, ১৩১১ বাংলা, ১৯ মে ১৯০৩ সালে এই ধরাধামে এলেন মানবমুক্তির দিশারী স্বর্ণযুগের দ্র্রষ্টা জ্যোর্তিময় ফুটফুটে এক দেবশিশু। গুরুর নির্দেশমতো বাবা এই শিশুর নাম রাখলেন ‘অদ্বৈত’।
গ্রামের স্কুলে তাঁর শিক্ষাজীবন গুরু। বাণীগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ের তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৯২৩ সালে বাণীগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অদ্বৈত চৌধুরী সংস্কৃত ও গণিত বিষয়ে লেটার মার্কস নিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। উক্ত বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় শিবকল্প মহাযোগী শ্রীমৎ স্বামী জগদানন্দ পুরী মহারাজ একদিন তাঁদের বাড়িতে আসেন এবং তাঁকে সৎ মন্ত্রে দীক্ষা প্রদান করেন।
মানবজীবনকে সুন্দর করতে হলে দীক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। যুগে যুগে আসা মহামানবেরাও গুরুর নিকট থেকে দীক্ষা গ্রহণ করেছেন। দীক্ষা দক্ষতা অর্জনের কৌশল শিখায়। তাই স্বামীজিও পরাবিদ্যা আত্মস্থ এবং লোকশিক্ষার জন্য নিজে দীক্ষা নিয়েছিলেন। সংস্কৃত ভাষায়ও স্বামীজির অগাধ পান্ডিত্য ছিল। সংস্কৃতে পান্ডিত্য অর্জনের পাশাপাশি পৈতৃক কবিরাজি পেশায় তিনি যশ-খ্যাতির স্বাক্ষর রাখেন। পিতার সাথে কাজে মনোনিবেশ করলেও মানুষের দৈহিক উন্নতির পাশাপাশি মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রতিবিধান কল্পে তিনি বাড়িতে গড়ে তোলেন আর্যচতুষ্পাঠী। এছাড়া নিয়মিত রাত্রির অন্ধকার ভেদ করে লোকালয় থেকে তিনি চলে যেতেন গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকার জন্য নির্জন অরণ্যে। এইভাবে গুরু প্রদত্ত নির্দেশনা অনুসরণ করে সাধনায় অদ্বৈত হয়ে উঠেন শিবকল্পতরু শ্রীমৎ স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরী। সাধনার মাধ্যমে লাভ করলেন অমৃতকুম্ভ। আধ্যাত্মিক শক্তিকে হৃদয়ে জাগ্রত করে মায়ার বন্ধন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দূরে বহু দূরে ফেলে দিলেন। বিবাহবন্ধনে আর আবদ্ধ হলেন না। দিকে দিকে স্বামীজীর লীলার কথা ছড়িয়ে পড়লো। স্বামীজী হয়ে উঠলেন সবার প্রাণের আরাধ্য দেবতা।
একসময় স্বামীজী তাঁর অনুজপ্রতীম শ্রীমৎ স্বামী অচ্যুতানন্দ পুরীর উপর সংসারের সমস্ত দায়িত্ব অর্পণ করে চলে যান তীর্থ পরিভ্রমণে। সারা ভারতবর্ষের সমস্ত তীর্থ ভ্রমণ সমাপণান্তে ১৯৫০ সালে জঙ্গল কোকদন্ডীর পরিত্যক্ত পাহাড়ি ভূমিতে স্বামীজী ঋষিধাম প্রতিষ্ঠার কাজে মনোনিবেশ করেন যা আজ মহাতীর্থে পরিণত। অসংখ্য ভক্তের পদচারণায় মুখরিত এটি একটি সুরম্য তপোবন। ১৯৫৪ সালে প্রিয় মাতৃভূমির ভক্ত জনগণের কথা চিন্তা করে ঋষির আদর্শ সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে ভক্তদের আর্থিক ও শারীরিক কষ্ট লাঘবে এবং পরমাত্মিক উন্নতি বিধানকল্পে প্রবর্তন করেন ঋষিকুম্ভ ও কুম্ভমেলা। এ আয়োজনে প্রতি তিন বছর পর পর অংশগ্রহণ করেন দেশ-বিদেশের সাধু ভক্তরা। আধ্যাত্মিক সাধনায় ব্রতী হয়ে ভক্তরা লাভ করেন অমৃতের সন্ধান। স্বামীজী থাকাকালীন সময়ে প্রতিষ্ঠিত ঋষিকুম্ভের মাঙ্গলিক আয়োজন এবং তাঁর মানবহিতৈষী মহৎ কর্মকান্ডে মুগ্ধ হয়ে চট্টগ্রামের নন্দনকাননস্থ তুলসী দাস আখেড়ার মোহন্ত শ্রী জয়রাম দাস মানবতার নিত্য সাধক স্বামী অদ্বৈতানন্দকে ১৯৬১ সালে ওই আখেড়ার মোহন্তের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। পরবর্তীতে স্বামীজি এর নাম রাখলেন তুলসীধাম যা আজো অদ্বৈত-অচ্যুত ভক্তদের কাছে মহাপবিত্র তীর্থক্ষেত্র হিসেবে প্রণম্য তপোবন।
লোকহিতার্থে স্বামীজীর অমর গ্রন্থগুলো আজো আধ্যাত্মিক পথের সুগভীর নির্দেশনা প্রদান করে। তিনি সাক্ষাত মাতৃদর্শনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন দশমহাবিদ্যা গ্রন্থে। তাঁর প্রণীত গীতায় গুরুশিষ্য, পার্থিব শিবলিঙ্গ রহস্য, শালগ্রাম তত্ত্ব, ধর্ম প্রবেশিকা, উপাসনা পদ্ধতি গ্রন্থসমূহ সাধন জগতের অমূল্য সম্পদ।