মহান মে দিবস মেহনতি শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার আদায়ে সকলকে আন্তরিক হতে হবে

14

আজ পহেলা মে। মহান মে দিবস ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। বিশ্বের কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদয়ের দিন আজ। এ মহান দিবসে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের শত কোটি শ্রমিকদের জানাই শুভেচ্ছা। আজ থেকে ১৩৫ বছর আগে ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা তাদের উপযুক্ত মজুরি আর দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলো, মে দিবস সেই ঘটনার রক্তাক্ত স্মৃতিবহ দিন। সে সময়ে শিল্পোন্নত দেশগুলোতে শ্রমিকদের ১৬ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। এভাবে কাজ করে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়ত। তাই দৈনিক ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনে শিকাগো শহরে ১লা মে শ্রমিকরা ধর্মঘট আহবান করে। প্রায় তিন লাখ মেহনতি শ্রমিক ওই সমাবেশে অংশ নেয়। সেদিন আন্দোলনরত শ্রমিকদের রুখতে পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। এতে পুলিশের গুলিতে ১০-১২ জন নিরস্ত্র শ্রমিক নিহত হন, আহত ও গ্রেফতার হন আরো কয়েকহাজার শ্রমিক। পরবর্তীতে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে গ্রেফতারকৃত শ্রমিকদের মধ্য থেকে অ্যালবার্ট পার্সনস, আগস্ট স্পাইস, জর্জ এঞ্জেল, অ্যাডলফ ফিশার নামক ৪ জন শ্রমিক নেতাকে আন্দোলনে অংশ নেয়ার অপরাধে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। কারাগারে বন্দিদশায় শ্রমিক নেতা লুই লিংগ আত্মহত্যা করেন। এতে শ্রমিকদের বিক্ষোভ আরো প্রকট আকারে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার। পরবর্তী চার বছর পর ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে কে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৮৯০ সাল থেকে অনেক দেশে দিনটি শ্রমিকশ্রেণি কর্তৃক উদযাপিত হয়ে আসছে। রাশিয়া এবং পরবর্তীকালে আরও কয়েকটি দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হবার পর মে দিবস এক বিশেষ তাৎপর্য অর্জন করে। জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক শাখা হিসেবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (International Labour Organisation, ILO) প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের অধিকারসমূহ স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে মহান মে দিবস পালিত হয়। স্বাধীনতার পর মে দিবস সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভ করে। জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার পহেলা মে’কে মহান মে দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং রাষ্ট্রীয় ভাবে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করেন।
বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার একটি মধ্যম আয়ের দেশ। এই দেশে শ্রমঘন শিল্পের প্রসার ঘটেছে। বিশেষত গার্মেন্ট শিল্পে ব্যাপক শ্রমিকরা কাজ করে। সেখানে ব্যাপক সংখ্যক নারী শ্রমিকরা কাজ করছে। আমরা দেখি প্রায়শ সেসব শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। যা কিছুতেই কাম্য হতে পারে। আমাদের দেশের শিল্প মালিকদের আন্তর্জাতিক শ্রম যেমন মেনে চলতে হবে তেমনি শ্রমিকের ন্যায় সঙ্গত মুজুরি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই মহান মে দিবস পালনের প্রকৃত সার্থকতা অর্জিত হবে।
ঐতিহাসিক মে দিবসের তাৎপর্যপূর্ণ অবদান আজকের শ্রমিক শ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে তারা মহান মে দিবসের চেতনায় ঐকবদ্ধ হতে পারে। মে দিবসে সকল শ্রমজীবী মানুষ তাদের ঐক্যের বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করার মাধ্যমে উন্নয়নমুখী পরিবর্তনের ধারায় এগিয়ে যাবে এই প্রত্যাশা আমাদের। তবে গতছরসহ পরপর দুই বছর বৈশি^ক করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশসহ বিশে^র কোটি শ্রমিক নানা সংকটে দিনাতিপাত করছে। মহামারির ভয়াল থাবা থেকে বাঁচতে লকডাউন, কার্ফিও ও সাধারণ ছুটি ইত্যাদির কারণে আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে শ্রমিক। বাংলাদেশে গত তিন সপ্তাহের লকডাউনের ফলে পোশাক ও কারখানার শ্রমিকদের একটি অংশের শ্রম ও আয় সচল থাকলেও হাজারো গণমাধ্যম কর্মী, গণপরিবহন, দোকান কর্মচারি, রেস্টুরেন্ট ও হোটেল শ্রমিক, রিকশা ও অটো রিকশা শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিকসহ দিনমজুরদের অলস ও বেকার সময় কাটাতে হচ্ছে। এসময় তাদের দু’বেলা খাবার যোগাড় করাও দায় হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় সরকার, শ্রমিক ইউনিয়ন, মালিক কর্তৃপক্ষ ও সামর্থবানদের উচিৎ যাদের ঘামদিয়ে এ দেশ উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় প্রবাহমান, তাদের প্রতি সদয় হওয়া, তাদের আর্থিক সহায়তায় এগিয়ে আসা। আজকের মে দিবসকে সফল করতে আসুন আমরা শ্রমিকদেও মর্যাদা ও ন্যায্য অধিকার আদায়ে সচেতন হই। জয় হোক মেহনতি মানুষের।