মহান মুক্তিযুদ্ধ ও আমার মা

20

 

ঊনিশশো একাত্তর। বাংলাদেশের জন্ম সাল। মহাকাব্যিক ঘটনাবহুল এ বছরটি বিশ্বসভ্যতার বিবর্তনের কালিক দিনপঞ্জীতে লোহিত আখরে উৎকীর্ণ ও প্রোজ্জ্বল হয়ে আছে। মহাকালের জঠর থেকে আমাদের এ মাতৃভূমির স্বাধীন ভূখÐ হিসেবে জন্মলাভ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা এ জন্যেই যে, এত অল্পসময়ে এত রক্তপাত, এত আত্মত্যাগ, এত সম্ভ্রমহানি, এত আখ্যান উপাখ্যান পৃথিবীর আর কোনো দেশের জন্মলাভে ঘটেনি ও রচিত হয়নি। বাংলাদেশের প্রতিটি জনপদে মহান মুক্তিযুদ্ধকালে ঘটে গেছে অজ¯্র ঘটনা। প্রতিটি ঘটনায় এদেশের পিতা-ভ্রাতা, মা-বোনদের স্বদেশপ্রেমনিষিক্ত বীরত্বগাঁথা যতদিন এ পৃথিবী থাকবে ততদিন উক্ত হবে, গীত হবে তাঁদের কাব্যময় কীর্তিকাহিনী। আমার সৌভাগ্য, আমার স্নেহময়ী মা মরহুমা শামসুন্নাহার বেগম চৌধুরী এদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠতে পেরেছেন তাঁর সহজাত দেশপ্রেম ও মানবতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের মাধ্যমে।
বীরপ্রসবিনী, বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত অনেক কীর্তিমানের জন্মস্থান বরমা ইউনিয়নে, হিমালয়ের দক্ষিণপূর্ব শৈলশ্রেণী থেকে নির্গত জলধারাপুষ্ট খর¯্রােতা সাঙ্গুনদী (শংখ) বিধৌত জনপদে আমাদের পৈত্রিক বাড়ী। শীতে শীর্ণা, বর্ষায় প্রমত্তা এ নদী ও এর অববাহিকা-উপকূল মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের বিচরণ ও এর তীরবর্তী আমাদের বাড়ীতে আশ্রয়গ্রহণে প্রভূত সহায়তা করেছে। সাঙ্গু (শংখ) নদীর তীর ঘেঁষে চট্টগ্রাম জেলার বিখ্যাত জমিদার রহমত খান চৌধুরী’র (যার নামে চট্টগ্রাম মহানগরীর রহমতগঞ্জ এলাকার নামকরণ হয়েছিল) সরাসরি বংশধর আমার দাদা পৈত্রিক সূত্রে জমিদার মরহুম আহমদ মিয়া খান চৌধুরী ও আমার বাবা জামাল আহমেদ খান চৌধুরী’র সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এ বাড়ী। অপরদিকে আমার মাতৃক‚লে আমার নানা মরহুম মফজল আহমেদ চৌধুরী ছিলেন তৎকালীন কক্সবাজার মহকুমার এসডিও (মহকুমা কর্মকর্তা)। আমার বাবা মরহুম জামাল আহমেদ খান চৌধুরী ছিলেন আমাদের এলাকার সর্বপ্রথম বিএ পাস, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ যিনি তৎকালীন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলায় বিএ জামাল নামে সুবিদিত ছিলেন। আমার মা মরহুমা শামসুন্নাহার বেগম চৌধুরী (জন্ম ১৯৪৮, মৃত্যু ২১ মার্চ ২০২০) অত্যন্ত বিদুষী মহিলা ছিলেন। আমার বাবা ও মা নিজ নিজ উত্তরাধিকার সূত্রে জমিদার বংশের হওয়া সত্বেও সাজাত্যবোধে ও মানবতায় ছিলেন বিরলপ্রজ।
১৯৭১ এর মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তা দ্রæত বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত অকুতোভয় মানুষগুলো নিজ জীবনকে তুচ্ছ করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় দোসরদের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে আমাদের এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা দিনের বেলায় বিভিন্ন ছদ্মবেশে ও রাত্রিতে সংগোপনে নৌকা নিয়ে আমাদের নদীতীরবর্তী বাড়িতে আশ্রয় নিতেন। আমার মা প্রায় প্রতিরাতে শংখ নদী বেয়ে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না করে খাওয়াতেন। আর আমার দাদী জমিদার বাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে থেকে পাহারা দিতেন, সে সময় বাইরে থেকে কেউ আসছে কিনা দেখে সতর্ক করার জন্য। আমাদের বাড়ী যেহেতু দাপুটে জমিদার বাড়ী ছিল, রাজাকাররা বাড়ীতে প্রকাশ্যে ঢুকতে সাহস পেত না।
অঝোর বর্ষায় কুলপ্লাবী শংখ নদীর মত্ত গ্রোত বয়ে যেতো আমাদের বাড়ীর প্রান্ত ছুঁয়ে। প্রচন্ড ঝড়ো বাতাস, বর্ষণকে সাথে নিয়ে যখন রাত্রি জুড়ে শুরু করতো ধ্বংসের মাতম, যুদ্ধের বিভীষিকাময় দিনগুলোতে পুরো জনপদে যখন মৃত্যু আতংক তাড়া করে ফিরতো, তখনও মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিলে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও আমার নির্ভীক মা পরম নিষ্ঠায় তাঁদের আশ্রয় ও আহার যুগিয়ে গেছেন সংগোপনে। শুধু তাই নয়, অসুস্থ, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ঔষধ-পথ্যও সরবরাহ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রায় পুরো সময় জুড়ে। চারদিকে মৃত্যু, হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, আর্তনাদ-আহাজারির মধ্যে দিন যায়, রাত নামে শ্বাপদ সরীসৃপের মত ধীরপায়ে। রাতের অন্ধকার ভেদ করে দূরে কোথাও কোথাও দেখা যেতো আগুনের লেলিহান শিখা। নিস্তব্দতাকে খান খান করে দিয়ে কাছে দূরে শোনা যেতো গুলির শব্দ। মাঝে মাঝে বোমারু বিমানের গর্জন দ্রæত মিলিয়ে যেতো। আমাদের বাড়ীর পাশের শংখ নদী থেকে ভেসে আসতো নৌকার দাঁড়ের সাবধানী আওয়াজ। অমনি আমার মায়ের শ্রবণেন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠতো। দক্ষিণের জানালা দিয়ে দেখতেন ওরা আসছে কিনা। বুঝতে পারলেই হারিকেনের একপাশ ঢেকে দিতেন যাতে মুক্তিযোদ্ধাদের আগমন আলোতে দেখা না যায়। আমাদের বাড়ীর দ্বিতীয় তলায় আশ্রয় নিয়েছিলেন এলাকার প্রায় বিশটি হিন্দু পরিবার। তাঁদের জন্য আমার মা ব্যবহারযোগ্য সমস্ত কাঁথা-কম্বল-বালিশ, বাসনকোষণ থেকে প্রায় সবকিছু অকাতরে দিয়ে দিয়েছিলেন। সকলকে পরম ধৈর্য্য ও দরদী অন্তরে আমাদের পরিবারভুক্ত করে রেখেছিলেন। আমার বাবা তখন পটিয়ায় শিক্ষকতা করতেন। মা একাই তখন সব সামাল দিতেন। আজ বুঝতে পারি, আমার মা দেশের জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁর সীমাবদ্ধ পরিসরে থেকেও কত বড় অবদান রেখেছিলেন।
অমোঘ ঋতুচক্রের নানান বৈশিষ্ট্য, আনুক‚ল্য-প্রতিক‚লতার ভিতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ এগিয়ে চলে। আমার বাবার ভাই (চাচা) শামসুল ইসলাম খান চৌধুরী তখন সেনাবাহিনীতে কর্মরত। সেখান থেকেই তিনি বিদ্রোহ করেন এবং সামরিক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি চট্টগ্রামে মিলিটারী শামসু নামে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও স্বাধীনতা বিরোধীদের জন্য ত্রাস। একদিকে আমাদের বাড়ী ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ও উদ্বাস্তু এলাকাবাসীর আশ্রয়স্থল, অপরদিেেক আমার চাচার মুক্তিযুদ্ধে যোগদান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমার মায়ের ক্রমবর্ধমান সহায়তা, সব মিলিয়ে আমাদের বাড়ীটি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয়েছিল। এর মধ্যেও আমার মা অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে সবকিছু সামাল দিয়ে যুদ্ধজয়ের সংবাদের দিন গুনছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে আমার মা ছিলেন কমবয়েসী রূপবতী গৃহবধূ। যুগপৎভাবে তিনি ছিলেন প্রত্যুৎপন্নমতী, সাহসী ও তেজোদীপ্ত। সত্যিকার অর্থেই আমার মা ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়চিত্তের লড়াকু দেশপ্রেমিক।
ক্রমশ: মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ তার পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, আমাদের বাড়ীটি স্বাধীনতবিরোধীদের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠছিল। মুক্তিযোদ্ধারা যখন বিজয়ের প্রায় দ্বারপ্রান্তে, তখনই অবশেষে আমাদের বাড়ী আক্রান্ত হল। হানাদার বাহিনীর ছত্রছায়ায় আলবদর, রাজাকার ও সুবিধাবাদী স্বাধীনতাবিরোধীরা আমাদের বাড়ীতে নির্বিচার লুটতরাজ চালালো, আমাদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বাড়ীটি ছত্রভঙ্গ করে সব নিয়ে গেলো। আমার মায়ের গলায় ধারালো ছুরি ধরে জবাই করে ফেলার হুমকী দিয়ে তাঁর কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ও পরিচয় সম্পর্কে বারবার জানতে চাইলো। সে এক বিভৎস ও মর্মান্তিক দৃশ্য। তারা ক্রমাগত নৃশংস হয়ে উঠছিল। কিন্তু আমার মা তাদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে অসাধারণ দৃঢ়তার সাথে কোনোরূপ তথ্য দেয়া থেকে বিরত থেকেছিলেন। নিশ্চিত মৃত্যুকে সামনে নিয়ে, জীবনকে তুচ্ছ করে তিনি সেদিন তাদের মোকাবেলা করেছিলেন। অন্যথায় মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতো। এমনকি তাদের নির্বিচার হত্যার শিকারও হতে হতো। বাংলাদেশ এখন স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করছে। এমন মাহেন্দ্রক্ষণে গর্বে আমার বুক ফুলে উঠে যখন আমি আমার মায়ের কথা ভাবি। আমার কাছে তখন আমার মা আর আমার দেশ একই সরলরেখায় এসে দাঁড়ায়।
লেখক: ব্যাংকার, প্রাবন্ধিক