মনাম এর বৈঠকখানা ধার,কিস্তি ও করোনাকাল !

31

মনসুর নাদিম

মেহেরজান কাজের বুয়া হারুর মাকে একটি এন জি ও’র সমিতি হইতে কিছু টাকা ঋণ লইয়া দিয়াছিল করোনা কালের মাসখানিক আগে। ঠিকঠাক চলিতেছিল। মাগার করোনা কালের মাঝখানে আসিয়া বেচারি আর কুলাইয়া উঠিতে পারিতেছিল না। আমাকে এই কথা দুই বেগমের একজনও বলেনাই। আচানক আমার বাড়ির গেইটে সমিতির লোক নজরে পড়িলে আমি তাজ্জব হইয়া গেলাম। এতদিন হারুর মা সমিতির অফিসে গিয়া কিস্তি দিয়া আসিত বলিয়া আমার নজরে পড়েনাই। এখন কিস্তি না পৌঁছায় বাড়ির গেটে আসিয়া হাজির। এই নব্য কাবুলিওয়ালারা মানুষের সংকট, করোনা, অভাব কিছুই বুঝে না। সমাজের বিত্তশালীরা যদি মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তদেরকে মুক্তহস্তে বিনা সুদে কর্জ এ হাসনা দিতে আরম্ভ করিত, তবে অভাবগ্রস্ত মানুষ এই নব্য কাবুলিওয়ালাদের নিকট হইতে চড়া সুদে ঋণ নিতেন না। অথচ ধনী আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশি অভাবগ্রস্ত অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াইলে সমাজে সুদের ব্যবসা হ্রাস পাইত বলিয়া আমার ধারণা। ইহাতে দুইটা পুণ্য হইবে-১. কর্জ এ হাসনার মাধ্যমে একজন গরিব অভাবগ্রস্তের উপকার হইল। ২. তাহাদেরকে সুদের ব্যবসা হইতে বিরত রাখিয়া সুদের কারবারিদের নিরুৎসাহিত করা হইবে। লেকিন আফসোস ! আজকাল নব্য কাবুলি ওয়ালাদেরকে পুরস্কৃত করা হয়, এওয়ার্ড দেওয়া হয়। যাহা হোক, করোনা কালে কম-বেশি সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে। মাজাভাঙা মধ্যবিত্তের অবস্থা দুমড়ানো মোচড়ানো। এখনো মানুষ কোমর সোজা করিয়া খাড়া হইতে পারেনাই। মাগার কর্জদার ঠিক মালেকুল মওতের মতো সময়মত চৌকাঠে হাজির। কী আর করা মানুষ অসহায়। এই অবস্থার পরিবর্তন তাহারাই করিতে পারেন, যাহাদের অঢেল সম্পদ রহিয়াছে। যেইসব প্রচারবিলাসীরা বিখ্যাত হইবার জন্য এইখানে সেইখানে দান করিয়া থাকেন, কেহ কেহ আবার দিনে গরিবের সম্বল চুরি করিয়া রাত্রে কম্বল বিতরণ করিয়া থাকেন। ঠিক বিশ্বের মোড়ল মুল্লুকগুলির মত। যাহারা একহাতে ত্রাণ দেয় অন্য হাতে প্রাণ নেয়। মোদ্দা কথা হইল, সমাজে মনুষ্যত্ব হারিয়া গেলে দুর্গতি বাড়িয়া যায়। কবি বলিয়াছেন-‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর, মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক মানুষেতেই সুরাসুর’। ধার এমন একটা জিনিস, যাহা রাজা-বাদশাহ হইতে আরম্ভ করিয়া দ্বীনহীন কাঙালেরও প্রয়োজন পড়িয়া থাকে। পৃথিবীতে এহেন কোন ব্যক্তি তালাশ করিয়া পাওয়া যাইবেনা যিনি জীবনে একবারও ধার গ্রহণ করেননি। এই ধারের ওপর অনেক গল্প, কবিতা ছড়া আছে। বিশিষ্ট রম্য লেখক প্রফেসর আসহাব উদ্দীন ধারের ওপর গোটা একটা বইই লিখিয়া ফেলিয়াছিলেন। শৈশবে আমরা পাঠ্যপুস্তকে ‘গনিমিয়া একজন কৃষক’ গল্পটি পড়িয়াছিলাম। ধার কেহ ঠেকাই পড়িয়া নেয়, কেহ শখ করিয়া নেয়। যাহারা শখ করিয়া নেয়, তাহাদের সংখ্যায় বেশিরভাগ ঋণখেলাপীদের অন্তর্ভুক্ত। যাহারা ঠেকাই পড়িয়া নেয় তাহারা পারত পক্ষে ধারের ধার দিয়াও যায়না। তাহারা জানে, ধার মানুষের মান-সম্মান শুধু ভোঁতা করেনা, ধারে ধার গ্রহিতার ব্যক্তিত্বের ধারও কমিয়া যায়। কিন্তু নিরুপায় হইলে মানুষ আর ব্যক্তিত্বের ধার দেখেনা। দেখে শুধু ধারটি পাইতেছে কিনা। ব্যক্তিত্বে যাহাদের ধার বেশি তাহারা আবার ধারের কথা সহজে মুখে আনিতে পারেনা। ধার নিয়া যাহারা বেকায়দায় পড়িয়া যায়, তাহাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। অনেক দোকানে ভদ্রতার সহিত লেখা থাকে‘বাকি চাহিয়া লজ্জা দেবেন না’। এখন কথা হইল যিনি নির্লজ্জের মতো এই নির্মম বাক্যটা লিখিতে পারিলেন, তাহাকে তো খানিকটা লজ্জা দেওয়া যাইতে পারে। হ্যাঁ, তাহাকে লজ্জা দেওয়া হয়। তবে আপনি কিংবা আমার মতো অসহায় ভদ্ররা না। তাহাদেরকে লজ্জা দেয় পাড়া-মহল্লার বখাটে ছেলেরা। এটা সেটা নিয়া নেয় আর ‘চির ঋণী’ হইয়া থাকে। একদা রবীন্দ্রনাথ তাহার ভাতিজাকে কহিলেন- বুঝলি দীনু, ঐ মাতাল হাঁদারামটা একবার আমার নিকট এক টাকা ধার চেয়েছিল। দীনু অবাক হইয়া কহিল – আপনি দিয়ে দিলেন অমনি টাকাটা ? ও যে একটা জোচ্চেুার। রবীন্দ্রনাথ কহিলেন-যাই বলিস, লোকটার শত দোষ থাকলেও একটা গুন কিন্তু আছে। সে তার কথা রেখেছিল। এখনো চির ঋণী হয়েই আছে। ব্যাংক হইতে যাহারা টাকা লইয়া আজ কোটিপতি, তাহাদের অনেকেই আজ ব্যাংকের নিকট ‘চির ঋণী’ হইয়া আছেন। ইহারা কোন বিপদে পড়া লোককে সহজে টাকা ধার দেয়না। ব্যাংক তাহাদেরকে বিশ্বাস করিলেও তাহারা ব্যাংকের বিশ্বাসকে চিরতরে দাফন করিয়া অন্য কাহাকেও বিশ্বাস করার মতো সাহস ও মানবিকতা কোনটাই দেখাইতে পারেনা। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। আমার বন্ধুদের অনেকেই আছেন যাহারা এই দলভুক্ত নন।তাহাদের আমি ভালোবাসি। সম্মান করি। তাহাদের অনেকের দ্বারা আমি একাধিকবার উপকৃত হইয়াছি। সকিনার বাপ প্রায়শই কহিয়া থাকেন-ব্যাংকের টাকা আর যজ্ঞের ধন, দুরাশার জট, নাহবে উত্তরণ’। মাগার এই কথা কে শুনিবে ! আজকাল মহল্লায় মহল্লায় নানা নামের এন জি ও সমিতি। যাহারা ঘরে ঘরে গিয়া ক্ষুদ্রঋণ দিতেছে। ইহাতে দরিদ্র মানুষেরা ঋণ লইয়া লাভবান হওয়ার সংখ্যার চাইতে ভোগান্তিতে পড়ার সংখ্যা বেশি। এক বৎসর করোনার প্রাদুর্ভাবে তামাম মুল্লুকের অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন একটা সন্তোষজনক নয়। কেহ কেহ বলিয়া থাকে করোনা এখন নাই। মাগার তাহারা কোন মতলবে ইহা বলিয়া থাকেন তাহা আমার বোধগম্য নয়। করোনা এখনো আছে। তবে দাপটটা কিছুটা কমিয়া আবারও বাড়ন্তের দিকে । প্রচন্ড করোনা ঝড়ে আগের পরিবেশ লন্ডভন্ড হইয়া তছনছ হইয়া গিয়াছে। তাহা এত তাড়াতাড়ি ঠিক হইয়া যাওয়ার মত চমৎকার দেখাইতে পারে তেমন যাদুর চেরাগ কাহারো হাতে আছে কী ? সবখানে শর্টকাট এর কথা ভাবিলে তো হইবেনা। এক লাফে গাছে চড়া যায়না। একদিনে কেহ বাপ হয়না। যদি অলৌকিক কিছু না ঘটে। এই অলৌকিক শব্দটা আসিতেই একটা গল্প মনে পড়িয়া গেল। গল্পটা হইল- ‘একবার রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের নিকট এক সাধু আসিয়া উত্তেজিত স্বরে কহিল, আমি ত্রিশ বছর সাধনা করে এখন হেঁটে নদী পার হতে পারি, আপনি কি সেটা পারেন ? পারলে করে দেখান দেখি ? স্মিত হাসিয়া রামকৃষ্ণ কহিলেন- যেখানে এক পয়সা দিলেই মাঝি আমাকে নদী পার করে দেয়, সেখানে এর জন্য ত্রিশ বছর সময় নষ্ট করার পক্ষপাতি আমি নই।‘’ সুতরাং কথার পীঠে কথা সাজাইয়া , বাক্যের সেতার বাজাইয়া , ছন্দে ছন্দে পরমানন্দে। সুকথনে সুবচনে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সমীকরণে, উপস্থাপনার দক্ষতা, বাক্য ব্যবহারে সক্ষমতা সারগর্ভ জ্ঞান সর্ব নানা আসনে সম্মোহনি ভাষণে অনেকেই আজ নিয়ে নব সাজ করে নানা সঞ্চালনা/ সম্পাদনা। সুপ্ত হৃদয়ের গুপ্ত বাসনা, ছদ্ম বেশে দলীয় ভাবনা। বোকার স্বর্গে, বুদ্ধিজীবীদের মর্গে ইহাদের নিবাস। ইহারা নিজেদের সিরাতুল মুস্তাকিমের অভিযাত্রী বাকীদের তীর্থযাত্রী ভাবিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করিয়া থাকে । আমি তাহাদের কপটতার শুভ্র বসনে নিষ্ঠার সাথে বিষ্ঠা লেপনে আদর্শবাদী সকল নওজোয়ান ও ঋণ প্রদান সংস্থাগুলির প্রতি মানবিক ও সমাজহিতৈষী স্বরূপ আচরণ কামনা করি।
আমার কড়া কথায় কেহ ব্যথিত হইবেন না। সমাজ ভালো থাকিলে পরিবেশ ভালো থাকিবে। পরিবেশ ভাল থাকিলে আমরা ভাল থাকিব। মেহেরজান আর গুলবদন সমিতির মানুষ দেখিয়া আমার ভয়ে লুকোচুরি খেলিতেছে। আমার সামনে বসা সমিতির লোকটা যেন নিজেই বিব্রতবোধ করিতেছেন। আমি তাহাকে বসাইয়া ভেতরে গেলাম। দুই বেগমের কেহই সামনে আসিতে হিম্মৎ করিতেছেনা। আমার বিনা এজাজতে এই ছুরতের কর্মে তাহারা মর্মে মর্মে চুর্ন বিচুর্ণ হইয়া শরমে মরমে অচেতন হইয়া আছে। হারুর মা কাঁচুমাচু চেহারায় আমাকে কহিল, চাচিদের কোন দোষ নাই। যাহা করিয়াছি আমিই করিয়াছি। আমি খামোশ হইয়া কামরা হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলে, গোলাম আলী মারফত কিস্তির টাকা পাঠাইয়া দিল। আমার বুঝিতে বাকি রহিল না এই কিস্তি আমার দুই বেগম তাহাদের সঞ্চিত অর্থ হইতে প্রদান করিয়াছে। কাবুলিওয়ালাকে বিদায় করিয়া আমি আজকের খবরের কাগজটা চোখের সামনে মেলিয়া ধরিলাম।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক