ভাষা নদীকে আমরা দূষিত করছি প্রতিদিন

50

অধ্যাপক আয়েশা পারভীন চৌধুরী

২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৯০টি রাষ্ট্রে মাতৃভাষার দাবিতে সংগ্রামরত পূর্ব বাংলার দামাল ছেলেদের কথা সবাই জানে। আজও যারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নিজের ভাষাকে অপমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সংগ্রামরত, তাঁরা বার বার স্মরণ করবে পূর্ব বাংলার ছাত্র জনতার সংগ্রামী চেতনা। প্রতি বছরেই সারা দেশব্যাপী বিভিন্ন আয়োজনে ২১শে ফেব্রুয়ারি পালিত হয়। আয়োজন ছোট হোক, বড় হোক, ক্ষুদ্র পরিসরে হোক, ব্যাপক পরিসরে হোক অথবা ঘরোয়া পরিবেশেও ভাষা দিবস পালিত হয়। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা লাভ করে বিশ্বব্যাপী এই দিবসটি পালন করা হয়। সুদূড় প্রবাসের বাঙালী ভাই-বোনদের সাথে বিদেশী ভাই-বোনরা একাত্ম হয়ে আন্তর্জাতিক মর্যাদাপূর্ণ এই দিবসটি পালন করে। কারণ এই দিবস বিশ^ব্যাপী নিপিড়িত মানুষের কথা বলে, তাদের অধিকারের কথা বলে এবং মানুষ হিসেবে মর্যাদা লাভের কথা বলে। তাই ভাষা দিবসটি প্রতিবাদের প্রতীক, প্রতিরোধের প্রতীক, সংগ্রামের প্রতীক, প্রতিকী একটি দিবস। সব দেশের সব জাতি ও উপজাতির নিজস্ব ভাষা আছে। কিন্তু এই দিনটিতে সব ভাষা-ভাষি মানুষ বাংলা ভাষাকে শ্রদ্ধা জানায়। সাদা-কালো পোষাকেসবাই শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের সম্মান জানান। এই সাদা-কালো পোষাক যেমন শোক প্রকাশের প্রতীক তেমনি প্রতিবাদের প্রতীক। ১৯৭১ সালের মার্চেও সাদা-কালো পতাকার মাধ্যমে প্রতিবাদ জানানো হয়। একদিকে লাল-সবুজের পতাকা অন্য দিকে সাদা-কালো পতাকা দিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে প্রতিবাদ জানানো হয়, বর্তমান সময়ে সারা দেশের প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানে ইংরেজী ভাষা ব্যবহার হচ্ছে। অনেক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দাপ্তরিক কাজও চলছে ইংরেজীতে। এছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার বিকৃতি ঘটছে। শুধুমাত্র ফেব্রæয়ারি মাসেই বাংলা ভাষার চর্চ্চার প্রতি গুরুত্ব দিলেই ভাষা চর্চ্চা সফল হবে না ১৯৫২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখে ভাষা আন্দোলন হয় বলেই এই দিবসটিকে প্রতিকী হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু ভাষা চর্চ্চা প্রাত্যাহিক জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে চালিয়ে যাওয়া উচিৎ। প্রতিটি ক্ষণ, দিন, মাস অর্থ্যাৎ সারা বছর ধরেই আমাদের বাংলার চর্চ্চা চালিয়ে যেতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে ভাষাকে নদীর সাথে তুলনা করে নদী দূষণ রোধে যেমন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে তেমনি ভাষাকে নানাবিদ দূষণ থেকে মুক্ত করার অঙ্গিকার নেওয়া হচ্ছে। নদী যখন স্বাভাবিক নিয়মে তার গতি পথে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং দূষিত হয় তখনই সেই নদীর গতিপথে বেড়ে ওঠা জীবন প্রবাহ বিঘ্নিত ও দূষিত হয়। বেশ কয়েক বছর থেকে আমাদের দেশের বড় বড় নদীগুলো দিন দিন মরা নদীতে পরিণত হচ্ছে। জীবনের সকল উপাদানগুলো দূষিত হতে হতে নদীতে কোন ধরনের জীবন ধারণের উপাদান পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের মাতৃভাষাও দিনের পর দিন বিকৃত ও অশুদ্ধ ব্যবহারে মৃত ভাষায় পরিণত হতে চলছে। ভাষায় সুন্দর, সাবলীল, ছন্দময় ও জীবনময় বৈশিষ্ট্যগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। এখন আমাদের কানে সেই অপব্যবহারগুলো তেমন বাজে না। আমরা যেন অপব্যবহারে অভ্যস্থ হতে হতে জীবনমুখী ভাষা থেকে জীবনবিমুখ ভাষায় পরিণত হচ্ছে। সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম তাঁর এক লেখায় বলেছেন, ভাষাকে নদীর সাথে তুলনা করি। কিন্তু আমাদের এই ভাষা নদীকে আমরা যে দূষিত করছি প্রতিদিন, তাই নিয়ে কি ভাবি? একটি দূষিত নদী যখন সমুদ্রে গিয়ে পড়ে, সমুদ্রও তো বিপদগ্রস্থ হয়, তাহলে বাংলা ভাষার দূষিত নদী ভাষা সমুদ্রে পড়ে কী অবদান রাখবে? ভাষা হচ্ছে সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যম। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বাহন। শিল্পকর্ম ও অগ্রগতির ধারক। পৃথিবীর ছয় (৬) হাজার মাতৃভাষা দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। ভাষা বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এ ব্যাপারে জরুরি পদক্ষেপ না নিলে আগামী শতাব্দীতে প্রায় ৯০ শতাংশ ভাষা হারিয়ে যাবে। অনেক বিস্ময়কর নিদর্শনের মধ্যে ভাষা একটি অন্যতম বিশেষ নিদর্শন। মাতৃভাষার ব্যবহারে মানুষ তার প্রাত্যাহিক জীবনের কর্মকান্ড অতি সহজেই সম্পাদন করতে সক্ষম হয়। তাই মাতৃভাষাতেই আমাদের সকলের সাথে কথোপথন সহজ হয়। ফলে জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে কর্মসম্পাদন ও যোগাযোগ আপন গতিতে চলতে থাকে। এই সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ রয়েছে, ‘‘তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে ভাব প্রকাশ করতে (ভাষা) শিখিয়েছেন।’’ নিজেদের জানা-অজানা, ধ্যাণ-ধারণা অন্যের মাঝে বিলিয়ে দিতে প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। আর মাতৃভাষাতেই সকল প্রকার সহজ ও কঠিন মনোভাব প্রকাশ করা যতটুকু সহজ হয় অন্য ভাষাতে তার চেয়ে অনেক বেশী কঠিন।
সেই ছোট কাল থেকে দেখে এসেছি শহীদ মিনারের পাদদেশে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে সেই সকাল থেকেই ফুল হাতে খালি পায়ে শহীদ মিনারের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন স্রোত। কখনো কখনো নিজেও সেই স্রোতের সাথে একাত্ম হতাম। এখনো দেখি স্কুল পড়ুয়া ছোট-ছোট ছেলে-মেয়েরা খালি পায়ে শহীদ মিনারে যায়। তাদের হাতে থাকে ফুল, পাতা, পতাকা। বিভিন্ন স্কুলের ড্রেস বিভিন্ন রংয়ের হয়ে থাকে। কিন্ত সেই ছেলে-মেয়েদের মনের রং কিন্তু সাদা-কালোতে প্রতিবাদী থাকে। আর যারা বড় থাকে তারা সাদা-কালো রংয়ের পোষাকে শহীদ মিনারে যায়। এখানে উল্লেখ্য, আমাদের অনেকেই আছে যারা ২১শে ফেব্রুয়ারীতে লাল অথবা কড়া রংয়ের পোষাকে শহীদ মিনারে যায়। হয়ত কর্তব্যের জন্যই শহীদ মিনারে গিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে হয়। কিন্ত আসলেই কি তারা বাংলা-বাঙালী-বাংলাদেশকে মেনে নিতে পেরেছে? শহীদ মিনারের কথা বলতে হলে আরো একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় উল্লেখ করতে হয়। বাংলাদেশের সম্মানিত প্রবাসী ও অভিবাসিরা যেখানে গিয়েছে সেখানেই শহীদ মিনার বানিয়েছে। হয়ত ইট-পাথরের বিশাল আকারের শহীদ মিনার বানাতে পারে নাই, তবে ২১শে ফেব্রুয়ারিতে মাটির তৈরী, কাগজের তৈরী, কাঠের তৈরী, ককসিটের তৈরী, কাপড়ের তৈরী শহীদ মিনারগুলো আমাদের গর্ব।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘‘সভাপতির অভিভাষণ’’ প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘‘আমরা যেমন মাতৃক্রোড়ে জন্মেছি, তেমনি মাতৃভাষার ক্রোড়ে আমাদের জন্ম, এই উভয় জননীই আমাদের পক্ষে সজীব ও অপরিহার্য।’’এই সজীব ও অপরিহার্য জননীরা যেমন সন্তানকে পরিচর্যা করে বড় করে তোলেন, তেমনি তাঁদের পরিচর্যা করা সন্তানের প্রধান কর্তব্য। মাকে বাঁচানোর মতো মাতৃভাষাকে বাঁচানো তার প্রধান দায়িত্ব। আর যে কোনো ভাষার ঠেকসই অস্তিত্ব নিশ্চিত করার পূর্বশর্ত হলো তার লেখ্য রূপকে পোক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করা। বাংলা যেহেতু আমাদের মাতৃভাষা এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া মাতৃভাষা এই ভাষার লেখ্য ও কথ্য রূপকে চর্চ্চার মাধ্যমে এগিয়ে নিতে হবে। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতার ফলে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা ও যোগাযোগ মাধ্যমে ইংরেজীকে অনেক গুরুত্ব দিয়ে আসছে। তাছাড়া চাকুরী ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ইংরেজী পারদর্শীদের প্রাধান্য দিতে দেখা যায়। যেহেতু ইংরেজী আন্তর্জাতিক যোগাযোগের একটি অন্যতম মাধ্যম তাই ইংরেজীকে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সাজাতে হবে। তাই বলে নিজেদের মাতৃভাষাকে পিছনে ফেলে নয়। শুধুমাত্র ভাষা কেন্দ্রীক চেতনা নয়, সকল প্রকার অজ্ঞতা, গোঁরামি, ধর্ম, নৈতিকতার বিরুদ্ধে ২১ চেতনার প্রতীক। একটি দেশ ও সে দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-ইতিহাস-ধর্মনিরপেক্ষতা-সার্বভৌম ও স্বাধীনতার প্রতীক। একুশ বাঙালির চেতনার স্মারক, জাতীয়তাবাদের প্রেরনা, জাতির দৃঢ়তার প্রতীক। একুশ আমাদের আত্মপরিচয়ের ঠিকানা। ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ফেব্রুয়ারি ছিল ঊপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ এবং জাতীয় চেতনার প্রথম উন্মেষ। বাঙালি জাতি পায় মাতৃভাষার মর্যাদা এবং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেরণা। দুশো বছরের ইংরেজ শাসনের পর অত্যাচারী পাকিস্তানী শাসকের অত্যাচার নির্যাতন শোষণের বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলন ছিল আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। নিজ দেশে নিজের ভাষায় মনের ভাব প্রকাশের বাধা এদেশের মানুষ মেনে নিতে পারে নাই বলে দিন দিন প্রতিবাদের তীব্রতা বেড়েই চলছিল। অবশেষে ১৯৫২ এর ২১শে ফেব্রæয়ারি তৎকালীন সরকারের সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করে বাংলার দামাল ছেলেরা প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিল, রক্ত দিয়েছিল। রক্ত রাঙ্গানো সেই প্রতিকী সকালটি এখনো শান্ত ফাগুনের সকালে প্রতিবাদের ঝড় তোলে। একুশে ফেব্রæয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করলেও প্রথম রাষ্ট্রভাষা দিবস পালিত হয় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। সেই মোতাবেক ১৯৪৯ সালে দ্বিতীয়, ৫০ সালে তৃতীয় এবং ৫১ সালে চতুর্থবারের মতো রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হয়। পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন ঘটায় একুশ, একুশ থেকে সৃষ্টি হয় ২১ দফা। এই একুশ দফা ছিল একটি ঐতিহাসিক দলিল। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ধাপে ধাপে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরিণত হয়। ২১শের রক্ত ভেজা রাজপথ ধরে ৭১ এর দেশব্যাপী রক্তগঙ্গা, অশ্রুগঙ্গা ও আত্ম-বিসর্জনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যের উদয় হয়। এখানে উল্লেখ্য, ছোট বয়সে যে দেশপ্রেমের শিক্ষা ও আদর্শ লালন করে শিক্ষা জীবন শেষ করেছে তাদের অনেকেই বাস্তবতার ঘাত-প্রতিঘাতে ন্যায়-অন্যায়ের দ্বন্দ্বে ও হিংসা-প্রতিহিংসার সেই আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে দেশদ্রোহী কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়। শহীদ মিনার এখন শুধু এদেশের নয়, হয়ে উঠেছে সারা বিশ্বের নতুন নতুন সংগ্রামের আত্মদানের স্মারক, বিজয়ের প্রতীক, অনুপ্রেরণার উৎস। পাকিস্তানের শৃঙ্খল ভাঙতে বাঙালীর চেতনায় প্রথম চলে আসে ৫২ এর ভাষা আন্দোলন। এ কারণেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে শহীদ মিনার গড়ে ওঠে। প্রতিটি শহীদ মিনার যেন ভাষা শহিদদের অগ্নিশিখা, প্রজ¦লিত একটি প্রতিবাদী স্মারক। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে ভাষা সৈনিক ও ভাষা যোদ্ধাদের স্মরণে এবং শ্রদ্ধায় অমর করে রাখার জন্য শহীদ মিনার তৈরী করা হয়।

লেখক : কলামিস্ট, অধ্যাপক