ভাষা আন্দোলন ও চট্টগ্রামে ভাষার লড়াই

111

জামাল উদ্দিন

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যেই বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে ১৯৪৮ সালের প্রথমদিকে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। মূলত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে এর সূচনা হলেও ক্রমে এটি একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়। দুই পর্বে বিভক্ত এই আন্দোলন ১৯৪৮ সালে অনেকটা শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং শুধু বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম হলেও ১৯৫২ সালের আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে। শুধু শিক্ষিত শ্রেণী নয়, বরং সমগ্র বাঙালি জাতির মধ্যে এর প্রভাব পড়ে। এ পর্যায়ে শুধু ভাষার বৈষম্য নয়, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বাঙালির প্রতি বৈষম্য পরিস্ফুটিত করে। এর ফলে ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতিকে একক রাজনৈতিক মঞ্চে নিয়ে আসে এবং নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেতন করে তোলে। এভাবে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ, নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি, উদার দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা, সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলন বাঙালিকে নতুন পরিমÐলে নিয়ে যায়। বাঙালি জাতির পরবর্তীকালে সংগঠিত প্রতিটি আন্দোলনে প্রেরণা আসে ভাষা আন্দোলন থেকে। ভাষা আন্দোলনের শিক্ষাই বাঙালি জাতিকে স্বাধিকার আন্দোলনে দীক্ষিত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রামে প্রেরণা যোগায়। সুতরাং বলা যায় যে, ভাষা আন্দোলনের ফলেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে, প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা।
’৪৭ হতে ’৫৮ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রকে অনুসরণ করে চট্টগ্রামে একের পর এক সংগঠন জন্ম নিলেও এ সময়ে আন্দোলনের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম পিছিয়ে ছিল। ৪৮ সালে চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলন হয়নি। প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম একবার সভা করতে এসে এখানে নাজেহাল হয়েছিলেন। তিনি অবশ্য আবদুস সবুর, মজিবর রহমান রুমি, এ কে মান্নান, মাহবুবুর রহমান প্রমুখের সহযোগিতা পেয়েছিলেন।
চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলনের শুরু হয়েছে ঢাকায় গোলাগুলির পর। তবে এর আগে ৪৭ সালের শেষ দিকে জে এম সেন হলে এ কে খানের সভাপতিত্বে এক সভায় মন্ত্রীরা বক্তব্য দিতে এলে সেখানে ভাষার প্রশ্নে লিখিত প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী, আবু তাহের, অনঙ্গ সেন, আরতি দত্ত। মন্ত্রীরা অবশ্য এ প্রশ্নকে এড়িয়ে গেছেন। এর আগে ৪৭ সালে ২৫ আগস্ট আবুল ফজলের সভাপতিত্বে এক সভায় নুরুল আমিন, হামিদুল হক চৌধুরী, হাবিবুল্লাহ বাহার, মোহন মিয়া, কমরেড মুজাফফর আহমেদ ভাষণ দেন। এগুলোতে ভাষার প্রশ্নে কোন বক্তব্য ছিল না।
৪৮ সালের মার্চে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দামপাড়া পুলিশ লাইনে ভাষণ দিতে এসে উর্দুর পক্ষে কথা বললেও তার প্রতিবাদ হয়েছে বলে জানা যায়নি। এ সভা পরিচালনা করেছিলেন আহমদ সগীর চৌধুরী। এ কে খান তাতে ভাষণ দিয়েছিলেন। জিন্নাহ ‘চট্টগ্রামকে সুন্দর নগরী করার প্রতিশ্রæতি দিয়ে বাংলার স্বার্থবিরোধী রাজনৈতিক বক্তব্য অত্যন্ত নির্বিঘেœ দিয়েছিলেন।
৫০ সালে মন্ত্রী ফজলুর রহমান চট্টগ্রাম কলেজে এসে আরবিতে বাংলা লেখার প্রস্তাব দিয়ে বক্তব্য রাখলে ছাত্ররা তাঁকে উদ্দেশ্য করে এক খোলা চিঠি দেয়। এ খোলা চিঠিতে বেশিরভাগ দাবিই ছিল ছাত্রদের শিক্ষা সম্পর্কিত। বিভিন্ন ব্যাপার নিয়ে মন্ত্রীর সাথে গোলমালের দরুণ ঋড়ৎপব ঞ.ঈ. দেয়া হয়েছিল ফরমানউল্লাহ খান ও শামসুদ্দিন মোহাম্মদ ইসহাককে। এ ঘটনার সাথে আরো জড়িত ছিলেন ড. মাহফুজুল হক, এজহারুল হক, আবদুল্লাহ আল হারুণসহ আরো অনেকে।
বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের যে কয়েকজন ব্যক্তিত্ব সোচ্চার ছিলেন তাঁদের অন্যতম ছিলেন জুলফিকার আলী, মওলানা আলতাফ হোসেন। এরা বাংলার বদলে আরবিকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ছিলেন, আরবি হরফে বাংলা চালুর পক্ষে জনমত সংগ্রহ করার চেষ্টা করতেন ও এ লক্ষে ‘হরফুল কোরান’ নামে একটি পত্রিকা বের করতেন। এতে আরবি ভাষায় কিভাবে বাংলা লেখা যায়Ñতা বোঝান হত। অধ্যক্ষ রেজাউল করিমও আরবির পক্ষে ছিলেন। ’৫০ সালের পর হতে চট্টগ্রামে ‘তমদ্দুন মজলিসের’ কর্মীরা বিভিন্ন স্থানে বৈঠক করে বাংলা ভাষার পক্ষে কথা বলতে চেষ্টা করেন। তবে তা কর্মী-পর্যায়েই সীমিত ছিল।
’৫২ সালের ৪ ফেব্রæয়ারি ভাষা আন্দোলনের জন্য প্রদেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘটের দিনে চট্টগ্রামে একটা সর্বদলীয় কমিটি হয় মাহবুব উল আলম চৌধুরীকে আহবায়ক করে। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন এম. এ. আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, শেখ মোজাফফর আহমদ, সুচরিত চৌধুরী, এ. কে. এম. আবদুল মান্নান, হাফেজ মোহাম্মদ শরীফ, এম. এ. হক, আবদুস সাত্তার প্রমুখ। ঢাকায় গুলির সংবাদ আসার পরপরই চট্টগ্রামের স্কুল কলেজ হতে স্বতঃস্ফ‚র্ত মিছিল বের হয়। এ সব মিছিলে কোন কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ছিল না। মহিলারাও মিছিল বের করে। খাস্তগীর গার্লস স্কুলের মেয়েরা দেয়াল টপকিয়ে এসে মিছিলে যোগ দেয়। চট্টগ্রামে সভা মিছিল ধর্মঘট শহর হতে গ্রামীণ পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং ৫ মার্চ পর্যন্ত তা চলে।
মেডিকেল স্কুল, চট্টগ্রাম কলেজ, মুসলিম হাই স্কুল, মিউনিসিপ্যাল হাই স্কুল, স্যার আশুতোষ কলেজসহ চট্টগ্রাম শহর ও গ্রামের প্রায় প্রতিটি স্কুল, কলেজ ও বিভিন্ন থানা এলাকায় গুলি ও ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে মিছিল, সভা-সমিতি অনুষ্ঠিত হয়। জেলা পর্যায়ে ২১ ফেব্রæয়ারি গুলির সংবাদের পরপরই বামপন্থী কর্মীরা ত্বরিৎ আলোচনায় বসেন। সেখান থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে চৌধুরী হারুনুর রশিদ, সুচরিত চৌধুরী, গোপাল বিশ্বাস, রুহুল আমিন নিজামী, ফকির আহমদ লালদিঘির ময়দানে চলে যান। সেখানে সেদিন দোকান কর্মচারী সমিতির সম্মেলন চলছিল। সে সম্মেলনে চৌধুরী হারুন ছিলেন আমন্ত্রিত বক্তা। তিনি তাঁর বক্তব্যে ঢাকার গুলির সংবাদ জানান ও জনতাকে এর প্রতিবাদে মিছিল করতে আহŸান জানালে উপস্থিত জনতা সাথে সাথে মিছিলে নেমে পড়ে। পরে আরো ব্যাপক জনগণ যোগদানের ফলে এটা বিশাল বিক্ষোভ মিছিলে পরিণত হয়। মিছিল শেষে এতে বক্তব্য দেন খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। এর পুরোভাগে ছিলেন ডা. নুরুল আজিম, ডা. সৈয়দ, মোহর আলী চৌধুরী, ডা. এম এ মান্নান, ডা. শামসুল আলম প্রমুখ। সভায় মাহবুব উল আলম চৌধুরী অসুস্থ অবস্থায় ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ নামে একটি কবিতা লিখে পাঠালে সভায় তা পড়ে শোনান হয়। মিছিল শেষে সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ অফিসে ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি’র এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। মাহবুব উল আলম চৌধুরী অসুস্থ থাকায় সে সভায় সভাপতিত্ব করেন জনাব জহুর আহমদ চৌধুরী। বক্তব্য দেন এম এ আজিজ, ডা. আনোয়ার হোসেন, ছালামত আলী খান। এ সভায় ২২ ও ২৩ ফেব্রæয়ারি হরতাল ও ২৪ ফেব্রæয়ারি লালদিঘিতে জনসভার কর্মসূচি নেয়া হয়। ২২ ও ২৩ ফেব্রæয়ারি আংশিক হরতাল হয়েছিল বলে জানা যায়। তবে সরকার নীরব ছিল। চট্টগ্রামে লিফলেট, পোস্টারিং হয় ব্যাপকভাবে। শহরের মাঝে ২২ ফেব্রæয়ারি প্রচÐ বিক্ষোভ হয় রেলে। পাহাড়তলী রেলের লোকোশেডের কর্মচারীরা ধর্মঘট করার ফলে রেল অচল হয়ে পড়ে। ২৩ ও ২৪ ফেব্রæয়ারি রেল বন্ধ থাকে। পরে এম এ আজিজ, আজিজুর রহমান শ্রমিকদের বুঝিয়ে রেল চালুর ব্যবস্থা নেন।
২৪ ফেব্রæয়ারি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে লালদিঘিতে এক ছাত্র জনসভা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন মুসলিম লীগ নেতা রফিউদ্দিন আহমদ সিদ্দিকী। ভাষণ দেন অপর মুসলিম লীগ নেতা এ কে খান। ফজলুল কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে সে সভা পÐ করার চেষ্টা হয়। চৌধুরী নিজেও বক্তাদের একজন ছিলেন। বর্ণনাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, ৫২ সালের ফেব্রæয়ারিতে দলমত নির্বিশেষে সরকারি ও বিরোধী সবদলই গুলির প্রতিবাদ জানিয়েছে। ফজলুল কাদের চৌধুরীর সভা ভাঙার কারণ ছিল এ কে খানের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত রেষারেষি। ঢাকাতে গুলি হওয়ার পর চট্টগ্রাম শহর, হাটহাজারী, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, মিরসরাই, সাতকানিয়া, বোয়ালখালী, কক্সবাজার, পটিয়া, আনোয়ারাসহ চট্টগ্রামের সব থানার স্কুল-কলেজ হতে ছাত্ররা স্বতঃস্ফ‚র্ত মিছিল বের করে। কোন রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর অথবা সংগ্রাম পরিষদের কোন ধরনের নিয়ন্ত্রণ এসব মিছিলে ছিল না। এসব মিছিলের প্রধান কারণ ছিল ছাত্রহত্যা। ভাষার ব্যাপারটার চাইতে তখন মিছিলকারীদের কাছে এটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
শহর ও জেলা পর্যায়ে এ আন্দোলনে আরো জড়িত ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার আজিজ, ড. মাহফুজ, চৌধুরী শাহাবুদ্দিন খালেদ, রেল শ্রমিক নেতা মুসলেহউদ্দিন, নুরুামান, কৃষ্ণ গোপাল সেন, শামসুদ্দিন আহমদ, মফিজুল ইসলাম, সুধাংশু ভট্টাচার্য, সর্দার শামসুদ্দিন, মণীন্দ্র মহাজন, সুনীল মহাজন, ডা. সরেস দে, গোপাল বিশ্বাস, আমির হোসেন দোভাষ, আবদুল কাদের, কবি আবদুস সালাম, দৌলতুর রহমান, আবদুল­াহ আল হারুন, লুৎফুর রহমান, আহমেদুর রহমান আজমী, শহীদ সাবের, পল্লব দাশগুপ্ত, ননী ধর, এনামুল হক, ডা. অজিত চৌধুরী, এন জি মাহমুদ কামাল, এ কে এম আবদুল মান্নান, এম ছিদ্দিক, ইসহাক মিয়া, মনিরুজ্জামান, হাফেজ মো. শরীফ, ডা. আয়ুব আলীসহ অনেকে।
গুলির প্রতিবাদে মিউনিসিপ্যাল স্কুলে সভা করেন জহুর আহমদ চৌধুরী, তোহফতুন্নেছা আজিম, এস এম শামসুল ইসলাম প্রমুখ। পাহাড়তলীতে ডা. মোহাম্মদ আলী, আবু নাসের, ইউছুফ জামাল, এনামুল হক, কাসেম আলী, রহিমা খাতুন, আবদুল বাকি, এয়ার মোহাম্মদ, আবু জাকের, মফিজুর রহমান, তফাজ্জল আলী, সাবু মিয়া, তোফাজ্জল আলী (২), মফিজুর রহমান নানা কর্মসূচির সাথে জড়িত ছিলেন। রাউজান থানাতেও গুলির প্রতিবাদে মিছিল হয়েছে ডা. নুরুল ইসলাম, রাজমোহন শর্মা, আবদুল হাই, মনির আহমদ, মাঈনুদ্দিন, মুছা প্রমুখের নেতৃত্বে। চকরিয়াতে স্কুল-কলেজ ধর্মঘটসহ গুলির বিরুদ্ধে মিছিল হয়েছে এস কে শামসুল হুদা, আবদুল মালেক মাস্টারের নেতৃত্বে। মিরসরাইতে এ টি এম শামসুদ্দিন, সীতাকুÐে ডা. কাফি খান, ড. রশিদ আল ফারুকী, আনোয়ারায় আবু বকর সিদ্দিকী, ছাত্র সংগঠনের আবদুল মোতালেব, আবদুচ ছোবান ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করার চেষ্টা করেছেন।
হাটহাজারীতে এম এ ওহাব সক্রিয় ছিলেন। সাতকানিয়াতে মো. ইবরাহিমের নেতৃত্বে মিছিল হয়। ৫২ সালে বোয়ালখালীর স্যার আশুতোষ কলেজের অধ্যাপক নির্মল সেন, প্রফেসর নুরুল ইসলাম চৌধুরী, অংশুমান হোর, প্রফেসর কায়কোবাদ, প্রফেসর বদরুল হায়দার চৌধুরী ভাষা আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা রাখেন। তাঁদের সাথে ছাত্রদের মাঝ হতে ছিলেন ডা. শহীদুল্লাহ, আবুল বাশার, গোলাম রহমান, নুরুল ইসলাম প্রমুখ। তৎকালীন সময়ে স্যার আশুতোষ কলেজ দক্ষিণাঞ্চলে ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ছিল।
ভাষা আন্দোলনের পর ফেব্রæয়ারিতে ছাত্রদের নিয়ে ‘ভাষা সংগ্রাম কমিটি’ হয়। এ ভাষা সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেন ফজলুল্লাহ খান, আবদুস সালাম, মাওলানা আহমেদুর রহমান আজমী, আবদুল্লাহ আল হারুন, আজিজুল ইসলাম, ডা. এ টি এম মুছা, এম এ হালিম, এমদাদুল ইসলাম। ভাষা আন্দোলনের পর ফেব্রæয়ারির শেষদিকে এসে এম এ আজিজ গ্রেফতার হন। ভাষা আন্দোলনের সময় লিফলেট ছাপাবার অপরাধে পুলিশ কোহিনুর ইলেট্রিক প্রেসে হানা দেয়। প্রেসের ম্যানেজার দবির উদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয়। চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বলা চলে, এখানে আন্দোলন হয়েছে গ্রামীণ পর্যায়ে পর্যন্ত। এ আন্দোলনের মাধ্যমেই প্রথম ছাত্র-যুবকরা ব্যাপকভাবে সরকারবিরোধী সভা মিছিল করতে সক্ষম হয়। মুসলিম লীগবিরোধী বা সরকারবিরোধী এ ছোট মিছিলগুলোর রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। লিয়াকত আলী খান ৫০ সালে চট্টগ্রাম এলে তিনি এ ব্যাপারে মুসলিম লীগেরই এক অংশের প্রশ্নের সম্মুখীন হন। সার্কিট হাউজে বেসিক প্রিন্সিপাল কমিটি রিপোর্ট (ইচঈ) নিয়ে এম এ আজিমের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের এক অংশ ৩টি বিষয় কেন্দ্রে রেখে বাকি বিষয়গুলো প্রদেশে দেয়ার দাবি জানান।
লিয়াকত আলী খানের সভায় চৌধুরী হারুনুর রশিদ, মাহবুব উল আলম চৌধুরী, মুসলেহউদ্দিন, নুরুজ্জামান প্রমুখের নেতৃত্বে লিফলেট বিলির চেষ্টা হয়। এ রিপোর্টের বিরুদ্ধে স্কুল কলেজ হতে ছোট ছোট মিছিল সভাস্থলে যায়। রেল শ্রমিক নেতা মাহবুবুল হক শ্রমিকদের নিয়ে এ রিপোর্টের বিরুদ্ধে মিছিল করেন। চট্টগ্রাম রেলওয়ে ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে এখানে দীর্ঘদিন শ্রমিকদের মাঝে অসন্তোষ বিরাজ করছিল। ৪৮ সালের ৮ মার্চ রেল ধর্মঘট ব্যর্থ করতে সরকার ১৪৪ ধারা জারী করে। শ্রমিকদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে এ ধর্মঘট ব্যর্থ করে দেয় সরকার। চট্টগ্রাম কটন মিলে শ্রমিক আন্দোলনের দায়ে এ সালে গ্রেফতার করা হয় সতীশ ভদ্র ও রাধা গোবিন্দকে। ৫২ সালে আবার রেল ধর্মঘটের প্রস্তুতির প্রেক্ষিতে ৫২ সালের মার্চে চৌধুরী হারুনুর রশিদকে গ্রেফতার করা হয়। ২২ এপ্রিল গ্রেফতার হন কৃষ্ণ গোপাল সেন, সুনীল মহাজন, ননীধর, জ্যোতির্ময় দত্ত, রাখাল দাস, সাতকড়ি দত্ত প্রমুখ বামপন্থী নেতা। ৫২ সালের দিকে কেলিশহর, কধুরখিল, রাউজানের কোয়েপাড়া, মিরসরাই, ফটিকছড়ির বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু কৃষক আন্দোলন হয় আবদুস সাত্তার, নগেন দে, পূর্ণেন্দু কানুনগো প্রমুখের নেতৃত্বে। চট্টগ্রাম জেলে ৪৯ দিনের জন্য হাঙ্গার স্ট্রাইক চলে চিরেন সরকার, হানি দত্ত, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, কালিপদ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে। অত্যাচারে জর্জরিত বামপন্থী কর্মীরা স্বাভাবিক পন্থায় কাজের সুযোগ না পেয়ে চট্টগ্রাম শহরে ৫০ সালের দিকে বেশকিছু ক্লাবের মাধ্যমে তাদের কাজ চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। এর মাঝে ছিল নন্দনকাননের ‘শক্তিসংঘ’, দেওয়ান বাজারের ‘অগ্রণী সংঘ’, ‘ঘাটফরহাদবেগ ক্লাব’, ‘মাদারবাড়ী ক্লাব’ উল্লেখযোগ্য।

লেখক : ইতিহাস গবেষক, লেখক ও সাংবাদিক