ভাষার মৃত্যু : প্রসঙ্গ চাটগাঁইয়া ভাষা

45

মুশফিক হোসাইন

মানুষের একে অপরের সাথে ভাববিনিময় ও যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে ভাষার উদ্ভব। বিশে^র দেশে দেশে বিভিন্ন ভাষা প্রচলিত। আবার একটি দেশের একই ভাষা অঞ্চল ভেদে উচ্চারণ ও টানের পার্থক্য বদলে যেতে পারে। একই ভূখÐের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ও উপভাষা প্রচলিত থাকতে পারে। ভাষা তার পরিবেশেরই সৃষ্টি। তাই কেন্দ্রিয় ভাষা ও প্রান্তীয় ভাষা সব সময় এক হয় না। বাংলাদেশে অনেকগুলি নৃ-গোষ্ঠির বসবাস। তাদের ভাষাও আছে অনেকগুলো। এরিমধ্যে অনেক ভাষা, উপভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে অথবা মৃত্যু হয়ে গেছে।
ভাষার অস্তিত্ব জনগোষ্ঠির মুখে মুখে কথন প্রক্রিয়ায়। ভাষা সেই জনগোষ্ঠির প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত হয়ে বেঁচে থাকে। একটি জনগোষ্ঠি ভালো ভাবে বেঁচে থাকার জন্য স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় থাকা যেমন শর্ত তেমনি ভাষা বেঁচে থাকার শর্ত হচ্ছে জীবন যাপনের প্রতিক্ষেত্রে এর নিত্য ব্যবহার ও চর্চা। কোন জনগোষ্ঠি যদি তাদের ব্যবহৃত ভাষার প্রতি উদাসীন বা অন্যমনযোগী হয়ে নিয়মিত ভাষার ব্যবহার কমিয়ে দেয় তবে সে ভাষা মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ে। পৃথিবীতে প্রচলিত বহু ভাষা বর্তমানে কেউ আর ব্যবহার করে না। বলা যায় যে ভাষাগুলো মৃত।
ভাষা কেন মারা যায়, কিভাবে মারা যায় ? এসব পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভাষার মৃত্যুর জন্য অনেকগুলো কারণ জড়িত থাকে। মোটা দাগে কারণগুলো হলো ; প্রথমত : কোন জনগোষ্ঠির ভাষা ব্যবহারে অনীহা, অনিচ্ছা অথবা কথক না থাকা। দ্বিতীয়ত : রাজনৈতিক কারণে, যেমন যুদ্ধবিগ্রহ, আধিপত্য বিস্তার ও উপনিবেশ। তৃতীয়ত : প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্লাবন ও ভুমিকম্প ইত্যাদি। চতুর্থত : শক্তিশালী ভাষা বা ঘাতক ভাষার প্রচÐ প্রভাব ইত্যাদি। পঞ্চমত : প্রবাসে অবস্থান বা ভাষা ব্যবহারের সুযোগ না থাকা বা জীবন যাপনের ধারণ পাল্টে যাওয়া ইত্যাদি। এসকল কারণে ভাষার মৃত্যু হতে পারে ।
একটি ভাষায় কতোজন মানুষ কথা বলবে তার নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা নেই। ভাষার প্রাণ হলো কথক। একটি ভাষায় স্বল্প সংখ্যক মানুষ কথা বললেও সে ভাষা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে টিকে থাকতে পারে। ভাষার মৃত্যু তার দুর্বলতায় নয়। ভাষার জীবন মানে কথক ও সমাজের সম্পর্ককে বোঝায়। দীর্ঘদিন কোন ভাষা কথক প্রক্রিয়ায় না থাকলে তা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। কালের প্রবাহে পৃথিবীর সকল ভাষা বিতরণের মধ্যে টিকে থাকে। বাংলা ভাষাও তাই। এই উপমহাদেশে এক সময় ফরাসী ভাষা ছিল দাপ্তরিক ভাষা। রাজনৈতিক ও সামাজিক পট পরিবর্তনের ফলে ফরাসী, আরবী, পর্তুগীজ, উর্দু ও ইংরেজি সহ অন্যান্য ভাষার শব্দাবলী বাংলা ভাষায় পাকাপোক্ত আসন গেড়ে বসে। সত্যিকার অর্থে ভাষার কোন ভৌতগত অস্থিত্ব থাকে না। মানুষের মনই হলো ভাষার আবাসভূমি। ভাষা কোন স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তা নয়। ভাষাভাষি মানুষ বেঁচে থাকলে ভাষা বাঁচে। ভাষার সাথে মানুষের যেমন নিবিড় সম্পর্ক তেমনি সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ও বিদ্যমান।
সুমেরীয় ও মিসরীয়দের মতো প্রাচীন বেশ কয়েকটি ভাষা কয়েক শতাব্দি আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কোন ভাষা বিলুপ্ত হয়ে সেই ভাষা আর ফিরে পাওয়া যায় না। যদি না সেই ভাষার লিখিত কোন দলিল থাকে। ভাষা বিজ্ঞানিরা আশংকা করছেন, আগামীতে কথা না বলার কারণে আরও শত শত ভাষা হারিয়ে যেতে পারে। এসব ভাষাভাষিরা নিজেদের ভাষা ত্যাগ করবে। সে স্থান পূরণ করবে ইংরেজি, ম্যান্ডারিন ও স্প্যানিশভাষা সমূহ। প্রযুক্তি এ সম্ভাবনাকে আরও ত্বরান্বিত করছে। আগামী শতাব্দিতে কথা বলা হয় এমন ভাষার ৯০ শতাংশ বিলীন হলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। চ্যাট জিপিটি, রিং ও বার্ডের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভাষার জন্য হুমকি হয়ে দেখা যেতে পারে।
পৃথিবীতে ৩০০ মিলিয়ন মানুষের নিজস্ব ভাষা আছে। ৩৭ মিলিয়ন মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। সেই মাপকাঠিতে বাংলাভাষা সপ্তম স্থানে আছে। আর আমাদের চাটগাঁইয়া ভাষা অষ্টম স্থানে আছে। গবেষকরা মনে করেন চর্যাপদ রচনার সময়ের ভাষাগুলো এবং চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা একই পরিবারের সদস্যভুক্ত। বৌদ্ধগান ও দোহার ভাষাকে যে যুক্তিতে অসমীয় ভাষা বলে দাবি করা যায় সে যুক্তিতে চর্যাপদের ভাষার উপর চট্টগ্রামের ভাষার দাবি মেনে নিতে হয়। বাংলার শাসক পাল বংশের রাজা ছিলেন বৌদ্ধ। পরবর্তীকালে সেন বংশের রাজারা এসে বৌদ্ধদের উপর নির্যাতন চালায়। ভারতের বুকে শঙ্করার্যের প্রচারে বৌদ্ধজাতি যখন নিশ্চিহ্ন হল। তখন চট্টলাই মায়ের মতো বুক পেতে দিল। তাই ভারতের বৌদ্ধ ধর্মের শেষ আশ্রয়স্থল চট্টলা। আর চট্টগ্রামের এই বৌদ্ধ চর্যাকারদের হাত ধরে চাটগাঁইয়া ভাষা ও বাংলাভাষার গোড়াপত্তন (অমল বড়–য়া, বাংলা ভাষা: চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা থেকেই যার গোড়াপত্তন-দৈনিক পূর্বদেশ ২১/২/২৩)
চাটগাঁইয়া ভাষার উৎপত্তি যেভাবেই হোক, তা ঐতিহাসিকদের গবেষণার বিষয়। চাটগাঁইয়ারা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। প্রত্যেক নেটিভরা যার যার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে চায়। জনশ্রæতি ও বাস্তবতা হল প্রতি পনের মাইল অন্তর চাটগাঁইয়া ভাষার টান ও লয়গত পার্থক্য বিদ্যমান। আবার দক্ষিণ, উত্তর ও শহরে চট্টগ্রামের চাটগাঁইয়া ভাষার মধ্যেও উচ্চারণগত ভিন্নতা লক্ষনীয়। চট্টগ্রামের হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের ভাষা চাটগাঁইয়া হলেও সেখানে উচ্চারণগত পার্থক্য আছে। সমাজের সর্বস্তরে চাটগাঁইয়া ভাষার প্রচলন থাকলেও বর্তমানে উচ্চবিত্তের ঘরে ততটা ব্যবহারিক নয়। চট্টগ্রামী ভাষার অভিধান ও অন্যান্য বিষয় ভিত্তিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যে। আছে কালজয়ী কবিতা গল্প ও উপন্যাস। সেই দিক থেকে চাটগাঁইয়া ভাষা সমৃদ্ধ হলেও চাটগাঁর ভাষার নিজস্ব কোন বর্ণমালা নেই। বাংলা বর্ণমালায় চাটগামী ভাষার লিখিত রূপ দেখা যায় তা প্রশ্নবিদ্ধ। এক একজন এক এক ঢং বাংলা বর্ণমালায় চট্টগ্রামী ভাষা লিখে থাকেন। উদাহরণত ক কে হ উচ্চারণ করা। কথা কে ‘হতা’ লিখা। অঞ্চলভেদে ও সম্প্রদায় ভেদে উচ্চারণে ভিন্নতা থাকায় তা সার্বজনীন নয়। আবার চট্টগ্রামী ভাষায় এমন শব্দ আছে, যা বাংলা ভাষায় প্রকাশ্য সম্ভব নয়। উদাহরণত : সুদবুদ বা গম বা পইর ইত্যাদি। পইর তিন অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন ভিক্ষুক, পুকুর, ভুলে যাওয়া। এ ধরনের অনেক সমার্থক শব্দ আছে। যা যথাযথ বর্ণমালা ছাড়া প্রকাশ দূরুহ। সবচেয়ে বড় শংকার বিষয় হলো বাংলা ও ইংরেজি ভাষার চাপে চট্টগ্রামী ভাষা কোণঠাসা হচ্ছে। পঞ্চাশ/ ষাট বছর আগে চট্টগ্রামী সমাজের সকলপরিবারের প্রধান ভাষা ছিল চাটগাঁইয়া। হালে ততটা দেখা যায় না। অন্যদিকে যেসব পরিবারের সদস্যরা পেশাগত কারণে বা অন্যত্র বসবাসের কারণে মাতৃভাষায় চর্চা করতে সক্ষম হচ্ছে না অথবা একটি শ্রেণি আছে যারা সমাজে প্রতিপত্তি ও অন্যকারণে মাতৃভাষা ছেড়ে অন্য ভাষার প্রতি বেশি আসক্ত। বিশেষ করে ইংরেজি। এ সকল কারণে চট্টগ্রামী ভাষা মৃত্যুর দিকে কি এগিয়ে যাবে ?
কথকই হল ভাষার প্রাণ। শুমারে চাটগাঁইয়া জনগোষ্ঠি বাড়লেও কথকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে ‘ঘাতক’ ভাষা প্রবল প্রতিপত্তি নিয়ে চট্টগ্রামী ভাষার স্থান দখল করে নিচ্ছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামী বর্ণমালা না থাকার কারণে ভাষার বিকৃত চর্চা অতিমাত্রায় হচ্ছে। কথকের অভাব এবং বিকৃত চর্চার ফলে চাটগাঁইয়া ভাষার মধুররূপটি ক্রমান্নয়ে হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রশ্ন হলো বর্ণমালার অভাবে কি চাটগাঁইয়া ভাষার মৃত্যু হবে ? চট্টগ্রামী ভাষার বর্ণমালা তৈরীর বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের আশু পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।

লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব)