ভাষার মাসে ভাষার মর্যাদা রক্ষায় দীপ্ত শপথ হউক

52

ডা. বরুণ কুমার আচার্য

বাংলাভাষা রক্ষার্থে বাঙালির আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত পৃথিবীর বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসেও একটি বিরল ঘটনা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি বাঙালিরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে মায়ের ভাষা, বাংলাভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। আজ সেই রক্তঝরা অমর একুশে ভাষা শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। দিনটি আমাদের জন্য বেদনা স্মৃতির এবং গর্বেরও। কালের পরিক্রমায় এ দিনটি আজ গোটা বিশ্ববাসীর জন্যই মাতৃভাষাকে সম্মান জানানোর উপলক্ষ। ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই আমরা ১৯৭১ সালে পেয়েছি আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বাধীনতা, পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র, আমাদের প্রত্যাশিত বাংলাদেশ। ভাষা মানুষের সাংস্কৃতিক বিকাশের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ভাষার উদ্ভব ও তার বিকাশের পরিপূর্ণতা আমাদের মানব সভ্যতায় বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। তাই সভ্যতার ক্রমবিকাশে ভাষাকে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। দ্বিজাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হলে আমাদের এ ভূখন্ড পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পূর্ব-পাকিস্তান হিসেবে পরিচিতি পায়। কিন্তু দুঃখজনক যে, পূর্ব-পাকিস্তানের গণমানুষের ভাষা বাংলা হলেও পাকিস্তানি স্বৈরশাসক এ অংশের ভাষা ঊর্দু করার ষড়যন্ত্র করে। যার ফলে মুখের ভাষা রক্ষায় গর্জে ওঠে বাঙালি। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীতে বাংলাদেশের বাঙালিরাই একমাত্র জাতি যারা আপন মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়েছে এবং বুকের রক্ত ঝরিয়েছে। ভাষা আন্দোলনের সময় একুশের মহান চেতনায় ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’ ¯েøাগানটিই বেশি ধ্বনিত হতো। এ দিনটির তাৎপর্যও তাই একুশের চেতনায় নিহিত। মহান একুশের চেতনাকে ধারণ করেই বাংলাদেশ একটি আত্মমর্যাদাশীল কল্যাণকামী অসা¤প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে এগিয়ে চলেছে।
ভাষা শহীদদের আত্মদানের মূল্যায়নও আমরা করছি এর মধ্য দিয়ে। ভাষার জন্য বাংলার দামাল সন্তানদের আত্মত্যাগ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। এদিন ইউনেস্কো ২১ ফেব্রæয়ারি দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করে। এর মধ্য দিয়ে একুশে ফেব্রæয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এখন বিশ্বের দেশে দেশে পালিত হয়। প্রতিবছর ভাষার মাসের প্রথম দিনের বড় আকর্ষণ একুশে গ্রন্থমেলা। এবার মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে গ্রন্থমেলা ফেব্রæয়ারির পরিবর্তে ১৭ মার্চ শুরু হবে। চলবে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। তবে বইমেলা না হলেও ফেব্রæয়ারি মাসজুড়ে সাহিত্য-সংস্কৃতিপ্রিয় বাঙালির বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এ মাসে আয়োজন করেছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের। করোনাভাইরাসের কারণে এসব অনুষ্ঠানের বেশিরভাগই অনুষ্ঠিত হবে ভার্চুয়ালি।
৬৯ বছর আগে ১৯৫২ সালে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে রাজপথে প্রাণ উৎসর্গকারী শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোই সব আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য। পাশাপাশি, এসব আয়োজনের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা হয় ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও তাৎপর্য।
মাতৃভাষার জন্য বুকের রক্ত দেওয়ার এমন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। আর সেই বিরল আত্মদানের স্বীকৃতিও মিলেছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা পৃথিবীতেই একুশে ফেব্রæয়ারিকে পালন করা হবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হচ্ছে সেই শহীদদের, যাঁরা ঢাকার রাজপথে ভাষার জন্য তাঁদের জীবন দিয়ে গেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এমন এক গর্বিত অহংকারের উত্তরাধিকারী হয়েও আমরা আজ পর্যন্ত আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বত্র বাংলার প্রচলন নিশ্চিত করতে পারিনি। ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নিচ্ছি। ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, এরপর ১৯৯৪ সালে বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম করেছে, অথচ আমরা বাংলা লিখছি যে যার ইচ্ছামতো। প্রাণপ্রিয় বাংলা ভাষাকে প্রকৃত মর্যাদা দিতে আমাদের এই স্বেচ্ছাচারিতা থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। বাংলা ভাষাকে ভালোবাসতে হবে। বৈশ্বিক প্রয়োজনে আমাদের ইংরেজি বা অন্যান্য ভাষাও শিখতে হবে। একই সঙ্গে মাতৃভাষার চর্চাকেও গুরুত্ব দিতে হবে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়াতে হবে। জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞানীরাও বাংলায় তাঁদের গবেষণাপত্র ও অন্যান্য রচনা উপস্থাপন করেছেন। অথচ এখন অনেকে ‘বাংলায় লিখতে পারি না’ বলে একধরনের বিকৃত গর্ব বোধ করে থাকেন, যা তাঁদের মানসিক দৈন্যকেই প্রকাশ করে।
বাঙালির জাতীয় বিকাশ ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে একুশের চেতনা নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। ভাষার জন্য আত্মদান শুধু ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন ও অঙ্গীকারের মধ্যেও নিহিত। সুতরাং আমরা মনে করি, এ ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আমাদের সচেষ্ট থাকতে হবে। মাতৃভাষার চর্চার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। ইতিহাসে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা রয়েছে। বাংলা ভাষার পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি বিকাশের পথও প্রশস্ত করতে আমাদের উদ্যোগী হতে হবে। আমরা লক্ষ্য করেছি, যে ভাষার জন্য বাঙালিরা আত্মত্যাগ করেছেন আমাদের প্রাণপ্রিয় সে মাতৃভাষা বাংলা আজও সর্বস্তরে চালু করা সম্ভব হয়নি। সরকারিভাবে রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলেও দাফতরিক কাজে বাংলাভাষার ব্যবহারিক চিত্রটি হতাশাজনক। বাংলা ভাষার চেয়ে দাফতরিক ভাষা হিসেবে ইংরেজিকেই এখনো প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। আমাদের দেশের উচ্চ আদালতে এখনো পর্যন্ত বাংলাভাষা চালু হয়নি। দেশের উচ্চবিত্ত পরিবারের অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে তাদের শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজিকে বেছে নিতে দেখা যাচ্ছে। যা কিছুটা হলেও উদ্বেগের। আমরা মনে করি, ইংরেজি শিক্ষারও প্রয়োজন রয়েছে তবে তা হতে হবে মাতৃভাষার ভিত্তি পাকাপোক্ত করার পর। আমাদের মনে রাখতে হবে, সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু করা সম্ভব না হলে শুধু আনুষ্ঠানিকতা এবং সভা-সেমিনারে বক্তব্য প্রদানের মধ্যদিয়ে বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষা করা সম্ভব নয়। কারণ এ বিষয়ে অনেক কথা হয়েছে কিন্তু আজ পর্যন্ত এর কোনো সুফল লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। আমরা মনে করি, প্রশাসনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর ব্যাপারে উদাসীনতা কিংবা কালক্ষেপণ সমীচীন নয়। ২১ ফেব্রুয়ারিকে ইউনেসকো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দিয়েছে। আমাদের মহান ভাষা শহীদ দিবস বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে, যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য গর্বের। কিন্তু আমরা আমাদের ভাষা রক্ষায় কী করছি সেটাই বিবেচ্য।
ভাষার সুষ্ঠু পরিচর্যার অভাবে ইতোমধ্যে পৃথিবী থেকে অনেক ভাষা বিলুপ্ত হয়েছে। অনস্বীকার্য যে, ভাষা রক্ষায় ভাষা পরিচর্যার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া যায় না। সুতরাং বাংলাভাষার সঠিক পরিচর্যা এখন সময়ের দাবি। এ বিষয়ে জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত। আমরা মনে করি যে গভীর শ্রদ্ধায় আমরা শহীদদের স্মরণ করি তার পাশাপাশি একুশের এ মহান চেতনার প্রতি যেন কোনো অবমাননা না হয় সে বিষয়টি কে নিশ্চিত করতে হবে। আর তা হতে হবে বাংলাভাষার সুষ্ঠু পরিচর্যার মাধ্যমে। তাই সকলের তরে আহবান ভাষার মাসে আমাদের চেতনাকে শাণিত করতে হবে, মাতৃভাষার প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা জাগিয়ে তুলতে হবে, বাঙালিত্বকে আলিঙ্গন করতে হবে। কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়, প্রাত্যহিক জীবনে তার প্রয়োগ ঘটাতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকেও আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আধুনিকতার নামে ভিনদেশী ভাষার আগ্রাসনে যেন নিজের মায়ের ভাষাকে হারিয়ে না ফেলি তা খেয়াল রাখতে হবে । আর ভাষার এই মাসে দীপ্ত শপথ নিতে হবে আমরা যেন মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সচেষ্ট হই ।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও মরমী গবেষক