ভাষার বিকৃতি রোধে চাই বাংলা ভাষার শুদ্ধ প্রচলন

47

রতন কুমার তুরী

একমাত্র ভাষাই হচ্ছে কোন একটি অঞ্চল এবং দেশের মানুষের ভাব বিনিময়ের প্রধান শক্তিশালি মাধ্যম। পুরো পৃথিবীজুড়ে প্রায় ৬ হাজারেরও বেশি ভাষা রয়েছে। তার মধ্যে বাংলা ভাষাটির অবস্থান ৫ম। বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সহ আসাম, ত্রিপুরার কিছু মানুষও বাংলা ভাষায় কথা বলে।
আমাদের বাংলা ভাষাটির রয়েছে অজ¯্র লিখিত সাহিত্য, ছড়া, কবিতা, গল্প, নাটকসহ অসংখ্য ভাব সম্পদ। একেবারে প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা ভাষা চর্চা হয়ে আসলেও তা মধ্য যুগে এসে বিস্তৃতি লাভ করে। এসময় কবি আলাওল তার মেধাকে কাজে লাগিয়ে সাহিত্যের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়। তখন বাংলা ভাষায় সংস্কৃত ভাষার অনেক কিছু ঢুকে পড়লেও তা কালের বিবর্তনে অনেকটাই বাদ যায়। পরবর্তীতে ফরাসি, আরবি, উর্দুসহ আরো কিছু ভাষা বাংলা ভাষায় ঢুকে পড়ে তবে এসব ভাষা বাংলা ভাষায় তেমন একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। ইংরেজ আমলে বৃটিশ বেনিয়ার দল এ অঞ্চলে প্রায় দুই শতাব্দীর মতো অবস্থান করায় বাংলা ভাষায় ইংরেজি কিছু শব্দ খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করে। তাছাড়া ইংরেজি ভাষাটি আন্তর্জাতিক ভাষা হওয়ায় এ ভাষাটি অসংখ্য বাংলা ভাষাভাষীর মানুষ প্রতিনিয়তই চর্চা করে চলেছে। প্রকৃতপক্ষে বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের মধ্যে বিশেষ করে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশ নামের দেশটির ব্যাপক সংখ্যক জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বাঙালিদের রীতিমতো সংগ্রাম এবং রক্ত দিতে হয়েছিল। তৎকালীন পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী বাংলা ভাষায় কথা বললেও শাসক গোষ্ঠী কখনও পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেয়নি। বরং তারা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকেও উর্দু ভাষায় কথা বলতে এবং লিখতে বাধ্য করার আইন করলে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষেররা গর্জে ওঠে অবশেষে পূর্বপাকিস্তানের দামাল ছেলেরা মায়ের ভাষায় কথা বলতে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক দলের মুখোমুখি হয় এবং সালাম, রফিক, বরকতের বুকের রক্তে অর্জন করে নেয় বাংলা ভাষাকে। পৃথিবীর ইতিহাসে নিজ মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রাণ দিতে হয়েছে এমন নজির নেই। সেই যে ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য সালাম, রফিক, বরকতের প্রাণ দেয়া পরবর্তীতে এই অনুপ্রেরণাই বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল। দিনটি ছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা মেডিকেলের সামনে দিয়ে মিছিল করে যাচ্ছিল, মিছিল লক্ষ করে অতর্কিত হামলা করে বসে পাকিস্তানি বাহিনী এতে সালাম, রফিক, বরকত তৎক্ষনাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এর প্রতিবাদে সারা পূর্বপাকিস্তানের মানুষ উত্থাল হয়ে ওঠে। অবশেষে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। বাঙালিদের ভাষার জন্য আত্মা বলিদানের ইতিহাস উপলব্ধি করে জাতিসঙ্ঘের ইউনেস্কো বাংলা ভাষার জন্য ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি প্রাণ বিসর্জন দেয়া শহিদদের স্মৃতিকে অ¤øান করে রাখার জন্য ‘২১ ফেব্রæয়ারি’ কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যা এখন প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে পালন করা হয়। ভাষার জন্য এমন বিরল স্বীকৃতি পৃথিবীর কোনো ভাষার নেই। দুঃখ জনক হলেও সত্যি যে, বাংলা ভাষার এমন গৌরব জনক ইতিহাস থাকা সত্তে¡ও আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই বাংলা ভাষার ব্যবহারকে বড় বেশি অবজ্ঞা করা হয়। এখনও আদালত সমূহে পুরোপুরি বাংলা ভাষার প্রচলন সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের ¯্রাম, নগর, শহরে এখন অহরহ নিজেদের মাতৃভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে ইংরেজিতে সাইন বোর্ড ঝুলানো দেখা যায়। অথচ নিয়ম অনুযায়ী ইংরেজি লেখার পাশাপাশি বাংলা লেখার নিয়ম রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বাংলা ভাষা হচ্ছে একটি সমৃদ্ধশালি ভাষা এই ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। বাংলা ভাষার অসংখ্য সাহিত্যিক রয়েছেন যারা রীতিমতো পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। অনেক সময় এমন ভাষাকে নিজ দেশে উপেক্ষিত হতে দেখে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ হিসেবে নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। আমরা বলছিনা সব ভাষা বাদ দিয়ে একমাত্র বাংলাকে নিয়ে মগ্ন থাকতে আমরা বলতে চাই শেখা এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য সব ভাষায় দক্ষতা অর্জন জরুরি তবে তা নিজের মাতৃভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে নয়। আমরা সর্বপ্রথম আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের সকল ক্ষেত্রে আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে ব্যবহার করতে সচেষ্ট হওয়া দরকার। বাংলা এবং ইংরেজিকে মিশিয়ে কথা বলা আজকের দিনে অনেকেই আধুনিকতা মনে করে কিন্তু এতে আমাদের মাতৃভাষাটাকে বিকৃত রূপে উপস্থাপন করা হচ্ছে তা আমাদের সকলের বোঝা উচিত। এমন বাংলা ইংরেজি মেশানো ভাষা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে বিকৃত ভাষা ছাড়া আর কিছুই উপহার দিতে পারছেনা। তাই বাংলা, ইংরেজি মেশানো ভাষা ব্যবহার আমাদের আজই পরিহার করা উচিৎ। মূলত যে কোনো ভাষা যত বেশি মৌখিক কিংবা প্রায়োগিক ব্যবহার হবে সে ভাষা তত বেশি উৎকর্ষতা অর্জন করবে এবং সেই ভাষা পৃথিবীতে টিকে থাকবেও বেশি। ভাষার ব্যবহারে যদি কোনো জাতি যথেষ্ট সতর্ক হয়ে তাদের নিজেদের ভাষা ব্যবহার করে তাহলে সে ভাষা দিনে দিনে বেশ সমৃদ্ধশালি হয়ে ওঠে। কোনো ভাষাকে সার্বজনিন করতে হলে সে ভাষাকে বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে দিতে হবে। আর ভাষা বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পরলে সে ভাষা পৃথিবী থেকে সহজে বিলুপ্ত হয়না। অনেক সময় ফেব্রæয়ারি মাস আসলেই বাংলা ভাষাকে নিয়ে অনেক লেখা লেখি হয়, বিদগ্ধজনেরা বাংলা ভাষার প্রচলন যেনো সর্ব ক্ষেত্রে ঘটে সেদিকে সরকার এবং জনগণকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেয় কিন্তু ফেব্রæয়ারি চলে গেলেই ভাষা নিয়ে তেমন আর আলোচনা সমালোচনা লক্ষ করা যায়না ফলে বাংলা ভাষার সর্বক্ষেত্রে ব্যবহারটা উপেক্ষিতই থেকে যায়।
আমাদের প্রত্যেকের মনে রাখা উচিত ভাষার ব্যবহার কিংবা প্রয়োগে যদি আমরা সবাই সচেতন না হই, তাহলে তা সকল ক্ষেত্রে ব্যবহার প্রায় অসম্ভব, কারণ আইন কিংবা বল প্রয়োগ করে কোনো ভাষার ব্যবহারকে বাধ্যতা মূলক করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আমাদের মাতৃভাষাকে সকল স্তরে প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তাছাড়া ভাষার বিকৃতি রোধ করতে হলে বাংলা ভাষাকে সবাই অন্তর দিয়ে ভালোবেসে সবজায়গায় তার শুদ্ধ প্রয়োগ করতে হবে। তাই আসুন ভাষার মাস ফেব্রæয়ারিতে আমরা সবাই বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত করতে বাংলা ভাষার শুদ্ধ প্রচলন আন্দোলন গড়ে তুলি এবং নিজেদের মাতৃভাষাকে বিশ্বের দরবারে একটি স্বাতন্ত্র্য ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করি।
লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক