ব্যাংক পরিচালনায় কমছে পারিবারিক কর্তৃত্ব

24

ঢাকা প্রতিনিধি

মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন পেয়েছে ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন-২০২৩। এতে ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদে পারিবারিক কর্তৃত্ব কমানো হয়েছে। কোনও ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একটি পরিবারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ তিনজন পরিচালক হতে পারবেন। আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনী কার্যকর হলে পরিচালনা পর্ষদে পরিবারের কর্তৃত্ব হ্রাস পাবে বলে জানা গেছে। এছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখন থেকে প্রতি আসনে একজন করে রিটার্নিং অফিসার রাখার প্রস্তাব দিয়ে ‘নির্বাচনি আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)’ সংশোধনের খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
গতকাল মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মন্ত্রিসভা কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠক। জানা গেছে, মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে অনুমোদন পেয়েছে ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন-২০২৩। নতুন এই সংশোধিত আইনে সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। দুর্বল ব্যাংকের অবসায়ন বা অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার বিষয়টি আইনে থাকছে। নতুন ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়ায় ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা’র সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যিনি নিজের বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে, নামে-বেনামে বা অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে সামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও তা পরিশোধ করবেন না, তাকেই বলা হবে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। জানা গেছে, ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদে পারিবারিক কর্তৃত্ব কমানো হয়েছে। কোনও ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একটি পরিবারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ তিন জন পরিচালক হতে পারবেন। বিদ্যমান আইনে সর্বোচ্চ চার জন পরিচালক নিযুক্ত হতে পারছেন। আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনী কার্যকর হলে পরিচালনা পর্ষদে পরিবারের কর্তৃত্ব হ্রাস পাবে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ খেলাপি হলে তিনি ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না। ঋণের অর্থ পরিশোধ করলেও তিনি পরবর্তী পাঁচ বছর আর পরিচালক হতে পারবেন না।
অনুমোদন পাওয়া আইনে ঋণ খেলাপিরা দেশের বাইরে যেতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন লাগবে। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি হলে ৫০ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা জরিমানা। জরিমানা দিতে ব্যর্থ হলে প্রতিদিন এক লাখ করে জরিমানা দিতে হবে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন-২০২৩ এ অধিকার ছাড়া কোনও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ‘ব্যাংক’ শব্দ ব্যবহারের অপরাধে সর্বোচ্চ ৭ বছর বা ৫০ লাখ টাকা দন্ড বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা রাষ্ট্রীয় কোনও সম্মাননা ও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না এমন বিধানও অন্তর্ভুক্ত আছে। সব ধরনের প্রক্রিয়া শেষে আইনের খসড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে অনুমোদনের পর তা এ বছরই সংসদে উপস্থাপিত হবে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সংশোধনীর খসড়া আইনটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য (ভেটিং) আইন মন্ত্রণালয়ে যাবে। আইনে বলা হয়েছে, ব্যাংক খাতে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি বিষয়ে নতুন ধারা যোগ হচ্ছে আইনে। ব্যাংক খাতে এত দিন ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি বলতে আলাদা করে কাউকে চিহ্নিত করা হতো না। তাই এর ফলে ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা রাষ্ট্রীয় কোনও সম্মাননা বা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে দাওয়াত পাবেন না। তারা কোনও পেশাজীবী, ব্যবসায়িক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক সংগঠনের কোনও পদেও থাকতে পারবেন না।
সংশোধিত আইনের খসড়ায় বলা হয়, কোনও ব্যাংকের পর্ষদে পরিচালক হিসাবে অন্য কোনও ব্যাংকের পরিচালক নিযুক্ত হতে পারবেন না। তবে এটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এছাড়া ব্যাংকের পরিচালক হওয়া ব্যক্তির স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনও প্রতিষ্ঠানের অপর ব্যক্তি একই ব্যাংকে পরিচালক হতে পারবে না। পরিচালনা পর্ষদে কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের একাধিক ব্যক্তিকে পরিচালক হিসাবে নিযুক্ত করা যাবে না।
সূত্র জানায়, গত ৩১ বছরে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন হয়েছে সাতবার। এর মধ্যে এক পরিবার থেকে চারজন এবং টানা ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকার সুযোগ দিয়ে করা হয়েছিল সর্বশেষ সংশোধন। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে স¤প্রতি বৈঠককালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এ ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছে।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া শর্ত অনুযায়ী সরকার ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন ২০২৩ নতুন করে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন পাওয়া ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি শনাক্তকরণ প্রসঙ্গে খসড়া আইনে বলা হয়েছে, প্রতিটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশক্রমে একটি কমিটি গঠন করবে। ওই কমিটি ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ শনাক্ত এবং চূড়ান্ত করবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতার তালিকা প্রতিটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠাবে। এ তালিকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশ করতে পারবে। আর চূড়ান্তভাবে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর অভিযুক্ত ব্যক্তি ৩০ দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আপিল করতে পারবেন। তবে এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। সেখানে আরও বলা হয়, ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা হিসাবে শনাক্ত হলে তার ওপর গাড়ি-বাড়ি, জমি রেজিস্ট্রেশন এবং বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকবে। এছাড়া যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মগুলো অধিদফতর থেকে কোম্পানির নিবন্ধন এবং ট্রেড লাইসেন্স নিতে পারবে না।
এছাড়া সামাজিক, পেশাজীবী, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক সংগঠনের কোনও পদে থাকতে পারবেন না। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পর সর্বোচ্চ ৫ বছরের মধ্যে কোনও ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না।
আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনও ব্যাংকের পরিচালক ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলে ওই ব্যাংকের পরিচালক পদ হারাবেন। কোনও ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ বা অগ্রিম নিয়ে ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধে ব্যর্থ হলেও পরিচালকের পদ থাকবে না।
এ প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার বিভাগ) মাহমুদুল হোসাইন খান জানিয়েছেন, মন্ত্রিপরিষদ সভার বৈঠকে অনুমোদনের পরে আইনটি মতামতের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে যাবে। আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে এটি আবারও মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদন নিয়ে সংসদে যাবে। এটি একটি প্রক্রিয়া।
আরপিও সংশোধনীতে মন্ত্রিসভার অনুমোদন : জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বর্তমানে প্রতি জেলায় একজন করে রিটার্নিং কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেন। তবে এখন থেকে প্রতি আসনে একজন করে রিটার্নিং অফিসার রাখার প্রস্তাব দিয়ে ‘নির্বাচনি আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)’ সংশোধনের খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
গতকাল মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মন্ত্রিসভা কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সংস্কার ও সমন্বয়) মো. মাহমুদুল হাসান।
তিনি বলেন, ‘এটা নীতিগত অনুমোদন হলো। আরও যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ক্যাবিনেটে আনা হবে। আইনটি হবে, এটাই শুধু অনুমোদন হলো। বাকি সব প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে, যেগুলো পরবর্তী সময়ে ক্যাবিনেটে উত্থাপন করা হবে।’
আরপিও’র সংশোধনী প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, নির্বাচনের সময় গণমাধ্যমকর্মী এবং পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে কোনও অসদাচরণ করলে সর্বোচ্চ সাত বছর এবং সর্বনিম্ন দুই বছর কারাদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
সচিব জানান, আরপিও সংশোধনীতে আরও প্রস্তাব করা হয়েছে মনোনয়ন পত্রের সঙ্গে এখন থেকে টিন সার্টিফিকেটের সঙ্গে ইউটিলিটি বিল দিতে হবে। বিদ্যমান নিয়মে ভোটের সাত দিন আগে প্রার্থীদের টিন এবং ইউটিলিটি বিল জমা দিতে হতো। নতুন করে আইনে তা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।