বেজে উঠুক গান, জেগে উঠুক প্রাণ

21

মিখাইল মোহাম্মদ রফিক

বেজে উঠুক গান, জেগে উঠুক প্রাণ শীর্ষক গণসংগীত। একটা সময় ছিলো যখন ফসল কেটে তা তোলা হতো জমির মালিকের বাড়িতে। তখন বর্গা-চাষীরা পেতো উৎপাদিত ফসলের তিন ভাগের এক ভাগ। আর দু ভাগই থাকতো জমির মালিকের। কিন্তু এই অন্যায্য ভাগ সম্পর্কে চাষীদের সচেতন করে তুলেছিলেন বামপন্থীরা। সেই সচেতন ও সংগঠিত চাষীরা দাবি করেন যে, ফসল তোলা হবে চাষীর বাড়িতে এবং বর্গাচাষী পাবেন ফসলের তিন ভাগের দু ভাগ। এই দাবিতে খুলনা থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা জুড়ে আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৬ সালের শেষ দিকে, ধান কাটার মৌসুমে। আর এ আন্দোলন শেষ হয় পরের বছরের প্রথম ভাগে। এই উপলক্ষে সলিল চৌধুরী লিখেছিলেন ‘হেই সামালো ধান হো’ গানটি। হেমাঙ্গ বিশ্বাসও সলিল চৌধুরীর মতো কাস্তে শান দেওয়ার আহŸান জানিয়ে ছিলেন তাঁর একটি গানে:
তোমার কাস্তেটারে দিও জোরে শান, কিষান ভাই রে
তোমার কাস্তেটারে দিও জোর শান
ফসল কাটার সময় হলে কাটবে সোনার ধান
দস্যু যদি লুটতে আসে কাটবে তাহার জান রে..। তেভাগা আন্দোলন ব্যাপক সাড়া জাগালেও, অল্পসময়ের মধ্যেই তা শেষ হয়ে গিয়েছিলো। এই দশকে বঙ্গদেশ সরকারের প্রধান মন্ত্রী ছিলেন প্রথমে এ কে ফজলুল হক, তারপর মুসলিম লীগ নেতা খাজা নাজিমুদ্দীন এবং তাঁর পর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি। কিন্তু ব্যবস্থাপক সভায় তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিলো না। তাই তাঁদের জোট বাঁধতে হয়েছিলো কোনো না কোনো অমুসলিম দলের সঙ্গে। এ সময়ে কোলকাতায় মাঝেমধ্যেই সা¤প্রদায়িক দাঙা হতো। মোট কথা, হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক চরম তিক্ত হয়ে ওঠে। মুসলিম লীগ সরকার প্রমাণ করতে চায় যে, হিন্দু ও মুসলমানদের পক্ষে একত্রে অথবা এক দেশে বাস করা অসম্ভব। মুসলমানদের চাই একটা স্বাধীন দেশ। যেন এই দাবির পক্ষে চ‚ড়ান্ত প্রমাণ দেওয়ার জন্যেই ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে কোলকাতায় এবং তারপর নোয়াখালিতে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে দারুণ রক্তক্ষয়ী দাঙা শুরু হয়। এবং এর ঠিক এক বছর পরে দেশবিভাগ হয় এবং পূর্ব পাকিস্তান নামে একটি স্বাধীন ভূখÐ তৈরি হয়। তারপর পূর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দুরা, বিশেষ করে শিক্ষিত হিন্দুরা, দেশত্যাগ করতে আরম্ভ করে। দেশত্যাগের গতি বৃদ্ধি পায় ১৯৫০ সালের রক্তক্ষয়ী দাঙার পর। এক-তরফা এই দাঙা ছিলো কার্যত হিন্দু-খেদাও দাঙা। চল্লিশ দশকের এই বিক্ষুব্ধ পটভূমিতে আইপিটিএতে অর্থাৎ বামপন্থী থিয়েটার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন কিছু মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাঁরা সবাই নাটক লিখতেন না, অথবা অভিনয়ও করতেন না।
অনেকে কেবল গান রচনা করতেন। যেমন সলিল চৌধুরী এবং হেমাঙ্গ বিশ্বাস। অনেকে শুধু গান গাইতেন। যেমন, দেবব্রত বিশ্বাস। এঁরা গণনাট্যের পাশাপাশি গড়ে তোলেন গণসংগীতের আন্দোলন। গণসংগীতের সূচনা অবশ্য হয়েছিলো এর দু দশক আগে- ১৯২৬ সালের প্রথম দিকে। বাংলা ভাষায় প্রথম গণসংগীত রচনা করেছিলেন নজরুল ইসলাম। তিনি ১৯২৬ সালের ফেব্রæয়ারি-মার্চ মাসে তিনটি গান লেখেন যা তাঁর আগেকার গান থেকে আলাদা। এগুলো দেশাত্মবোধক গান নয়, গণসংগীত। গান তিনটি হলো ‘ওঠ রে চাষী জগৎ-বাসী ধর কষে লাঙল’ [কৃষকের গান], ‘ধ্বংসপথের যাত্রীদল / ধর হাতুড়ি তোল কাঁধে শাবল’ [শ্রমিকের গান] আর ‘আমরা নীচে পড়ে রইব না আর শোন রে ও ভাই জেলে’ [জেলেদের গান]।
আইপিটিএ এবং গণসংগীত আন্দোলন নামেই বামপন্থী আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিলো না। বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের কেউ কেউ সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। যেমন, নাম-করা সংগীতজ্ঞ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্র যোগদান করেন ১৯৩৯-৪০ সালে। তাঁর পিতা ছিলেন পাবনা জেলার একজন জমিদার। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জন্ম ১৯১১ সালে। ছেলেবেলা থেকে তিনি নানা ধরনের সংগীত শেখেন। তার মধ্যে একদিকে ছিলো উচ্চাঙ্গ সংগীত, অন্যদিকে ছিলো রবীন্দ্রসংগীত এবং লোকসংগীত। তা ছাড়া, তিনি পাশ্চাত্য সংগীতেরও উৎসাহী শ্রোতা ছিলেন। তাঁর ‘নবজীবনের গানে’ তিনি উচ্চাঙ্গ সংগীতের সঙ্গে পাশ্চাত্য সংগীতের সমন্বয় ঘটানোর প্রয়াস পেয়েছিলেন। দেবব্রত বিশ্বাসের পিতা ছিলেন কিশোরগঞ্জের একটি সম্পন্ন ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান। তাঁর জন্ম ১৯১১ সালে। তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ না-দিয়ে যোগ দিয়েছিলেন আইপিটিএ অর্থাৎ গণনাট্য সংঘে। তাঁর অতুলনীয় কণ্ঠ এবং এক্সপেশন দিয়ে গণসংগীত এবং রবীন্দ্রসংগীতকে দারুণ জনপ্রিয় করেছিলেন। বিশেষ করে তাঁর কণ্ঠে ‘হেই সামালো ধান হো’, ‘বিচারপতি তোমার বিচার’, ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’ ‘অবাক পৃথিবী’ ইত্যাদি গানকে জীবন্ত করে পরিবেশন করেছিলেন।
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের পিতাও ছিলেন জমিদার, সিলেটের। হেমাঙ্গ জন্মেছিলেন হবিগঞ্জে, ১৯১২ সালে। তিনি লেখাপড়া শেখেন প্রথমে হবিগঞ্জ স্কুল, তারপর মুরারীচাঁদ কলেজে। ছাত্রজীবনেই তিনি দুবার রাজবন্দী হিসেবে জেল খাটেন এবং সেখানেই য²ারোগে আক্রান্ত হন। স্কুল-জীবন থেকে তিনি গ্রামের শ্রমজীবী মানুষদের দুঃখদারিদ্র্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠেন। এই নিয়ে পিতার সঙ্গে তাঁর প্রকাশ্য মতবিরোধ হয়। তখন থেকেই তিনি বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন। তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। দরিদ্রদের প্রতি তাঁর দরদ তাঁর গানে গানে প্রকাশ পেয়েছে। যেমন, ‘বাঁচবো বাঁচবো রে আমরা বাঁচবো রে বাঁচবো- গোলায় গোলায় উঠবে ধান / গলায় গলায় উঠবে গান।’ অথবা ‘হায় হায় / ঘোর কলিকাল আইল আকাল সোনার বাংলায় / ক্ষুধার অনল দিকে দিকে ধিকিধিকি ধায়।’ তাঁর গানের তিনটি সংকলন আছে। সলিল চৌধুরীর পিতা ছিলেন আসামের চা-বাগানের ডাক্তার। তিনি পাশ্চাত্য সংগীতের একজন আগ্রহী শ্রোতা ছিলেন। তাঁর সংগ্রহে ছিলো পাশ্চাত্য সংগীতের বহু রেকর্ড। বিশেষ করে সিম্ফনির রেকর্ড। এক কথায়, তিনি ছিলেন একটি শিক্ষিত সম্পন্ন পরিবারের প্রধান। তাঁর পুত্র সলিল চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৩ সালে। ছেলেবেলা থেকে তিনি পাশ্চাত্য সংগীতের পরিবেশে মানুষ হন। তা ছাড়া, উচ্চাঙ্গসংগীত এবং লোকসংগীতের ব্যাপক প্রভাবও পড়েছিলো তাঁর ওপর। তরুণ বয়সে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনে যোগদান করেন। তিনি তাঁর অসংখ্য গান ও কবিতায় সমাজের নীচের তলার লোকের প্রতি গভীর দরদ প্রকাশ করেন। এ রকমের নিবেদিত-প্রাণ বামপন্থী গীতিকার ছাড়াও, চল্লিশের দশকের অন্য অনেক গীতিকারের রচনায়ও বাম রাজনীতি এবং সমাজের নীচের তলার মানুষদের প্রতি আন্তরিক দরদ লক্ষ করা যায়। যেমন, শৈলেন রায়ের ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে কত প্রাণ হলো বলিদান / লেখা আছে অশ্রুজলে’। অজয় ভট্টাচার্য-রচিত ‘দুঃখে যাদের জীবন গড়া, তাদের আবার দুঃখ কি রে!’ গানটিও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এ গানের একটি পংক্তি বিশেষভাবে লক্ষণীয়: তোদের প্রাণে বন্দী হয়ে কাঁদে ভুখা ভগবান। মোহিনী চৌধুরী এ রকমের আর-একজন গীতিকার। তিনি বামপন্থী ছিলেন না, কিন্তু তাঁর বহু গানে দরিদ্র ও নিপীড়িতদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। যেমন, তাঁর জনপ্রিয় গান: ‘আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়, তুমি যে বহ্নিশিখা’, ‘জেগে আছি একা জেগে আছি কারাগারে- মুক্তির পথে কত বাধা, কত রক্ত’ এবং ‘পৃথিবী আমারে চায় রেখো না বেঁধে আমায়- শোনো নাকি ঐ আজ দিকে দিকে হায় / কত বধূ কাঁদে, কাঁদে কত অসহায়।’ এ রকম মানবিকতা প্রকাশ পেয়েছে পরেশ ধরের গানেও। তাঁর বক্তব্য হলো: ‘মোদের গানের অঙ্গনে যদি মানুষ না পায় ঠাঁই / গানের আসর ভেঙে দাও তবে, আমরা সেথায় নাই।’ ‘বেজে উঠুক গান, জেগে উঠুক প্রাণ।’ গণসঙ্গীতের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারে আমাদের স্বদেশী সংগীত। স্বদেশ প্রেমের আবেগকে জড়িয়ে ‘স্বদেশী গান’-এর একটি ধারা একসময় শক্তিশালী ও জনপ্রিয় হয়ে উঠে। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনাকালে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের পটভূমিকায় গণসংগীতের জোয়ার আসে। তারই পথ ধরে ১৯৪২-৪৩ সালে বাংলার সংগীত জগতে একটি বিশেষ ধরনের গান বোঝাতে ‘গণসংগীত’-এর ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং বাংলাদেশের প্রায় সব
অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে বিশেষভাবে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নোর যুক্তফ্র্রন্ট নির্বাচন, ষাটের দশকে বাঙালি জাতিয়তাবাদী আন্দোলন, নক্শাল বাড়ি আন্দোলন এবং সর্বশেষ ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে ‘গণসংগীত’ ছিল বাংলাদেশের মানুষের অধিকার
আদায়ের বলিষ্ঠ হাতিয়ার।
যেখানেই অসঙ্গতি, যেখানেই শোষণ, যেখানেই দ্ব›দ্ব, নিপীড়ন, যেখানেই মানবতার অপমান, সেখানেই গণসংগীতের সৃষ্টি হতে শুরু করে। কান্নার আপন স্বরে প্রতিবাদী কণ্ঠে যে শিশুর জন্ম এই পৃথিবীতে, সেও তার আগমন বার্তা ঘোষণা করে আসছে তার আপন উচ্চকণ্ঠে। মানুষের জন্য এবং তারই প্রয়োজনে শেষ পর্যন্ত শিল্পসুরের মিশ্রণে গান হয়ে ওঠে গণসঙ্গীত। স¤প্রতি চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে বিপুল সংখ্যক দর্শক-শ্রোতাদের উপস্থিতিতে গণসংগীত সংগঠন সৃজামি সাংস্কৃতিক অঙ্গন তিন দিনের গণসংগীত উৎসব সম্পন্ন করেছে। উৎসব উদ্বোধন করেন দেশের বরেণ্য নাট্য ব্যক্তিত্ব নাট্যজন মামুনুর রশিদ। উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি বলেন, দেশ যেখানে সা¤প্রদায়িকতা আর অপ রাজনীতির বিষবাষ্পে জর্জরিত, ‘যেখানে সংগীত গেছে থামিয়া’ সেখানে সৃজামির আয়োজন আমাদের মনে আশা সঞ্চার করেছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন একুশে পদক প্রাপ্ত গুণী নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দার। অনুষ্ঠানের শুরুতে সুজিত চক্রবর্তী’র পরিচালনায় সৃজামির শিল্পীরা পরিবেশন করেন, ভাষা শহীদদের স্মরণে জাগরণের গান। ১৫-১৭ ফেব্রæয়ারি প্রতিদিন শিল্পকলা একাডেমির মুক্তাঙ্গনে তিন দিনের উৎসবে অংশগ্রহণ করেন বোধন আবৃত্তি পরিষদ, ওড়িশি এন্ড টেগর ডান্স মুভমেন্ট সেন্টার, ছন্দানন্দ সাংস্কৃতিক পরিষদ, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, চট্টগ্রাম। এছাড়াও উৎসবে গণসংগীত পরিবেশন করেন কোলকাতা থেকে আগত বিশিষ্ট গণসংগীত শিল্পী রাজু বল ও রুমা বল এবং পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত গণসঙ্গীত দল সারেঙ্গি। গণসংগীত মানুষকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহস দেয়। সাধারণ মানুষকে খুব সহজেই প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। রক্তশুন্য ধমনীতে রক্ত সঞ্চার করে এবং গানের কথা ও সুর সাধারণ মানুষ নিজেই তৈরী করে। অন্ধকার থেকে আলোর দিকে, অপূর্ণতা থেকে পূর্ণতার দিকে, অসুন্দর থেকে সুন্দর জীবনের দিকে যাবার পথ দেখায় এই সংগীত। এক সময় এই সংগীত প্রতিবাদের ভাষা হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে সবচেয়ে বেশী। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন গণসংগীতের আবেদন মানুষের জীবনের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার বিমূর্ত রূপ হয়ে ফুটে ওঠে। শোষণ, নিপীড়ন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যে কথা ও সুর তা বিশ্বের অপর প্রান্তেও প্রতিফলন ঘটায়। হয়তো তার ঘটনা বা রূপ ভিন্নতর। গণসংগীতের চর্চায়-অবগাহনে বিশ্বসংগীতের সাথে সেতুবন্ধনে সহযাত্রী স্বরূপ সৃজামি নিষ্ঠাবান।
লেখক : নাট্যকর্মী ও সাংবাদিক