বৃটেনের মসনদ ভারতীয় ঋষি কি যেতে পারবে ?

14

লিটন দাশ গুপ্ত

উপরের শিরোনামে ভারতীয় যে ঋষির কথা বলছি, এই ঋষি মানে মুনি-ঋষি, সাধু-সন্ত কিংবা ত্রিকালজ্ঞ আধ্যাত্মিক কোন ব্যক্তির কথা নয়। ভারতীয় ঋষি বলতে ভারতের বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ নাগরিক ঋষি সুনাকের কথাই বলছিলাম। যিনি গত ৭/৮ ধাপ নির্বাচনে ঝড়ের গতিতে জয়ী হয়ে, বর্তমানে কনজারভেটিভ পার্টি থেকে ৫ সেপ্টেম্বর শেষধাপ তথা চূড়ান্ত ভাবে বিজয়ী হবার অপেক্ষায় আছেন। আর তিনি বিজয়ী বা নির্বাচিত হতে পারলে এশিয়ার বংশোদ্ভুত প্রথম কোন ব্যক্তি, যিনি বৃটেনের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে প্রবেশের সুযোগ পাবেন। উল্লেখ্য বৃটেনের ৩৫৮ জন কনজারভেটিভ সদস্যের মধ্যে ১০/১১ জন প্রার্থী থেকে বাছাই প্রক্রিয়ায় তিনি রকেট গতিতে এই পর্যন্ত উত্তীর্ণ হয়ে এসেছেন।
প্রধানমন্ত্রী পদে প্রার্থী হবার আগে তিনি বরিস জনগণ সরকারের মন্ত্রীসভায় বিশ্বস্ত অর্থমন্ত্রী ছিলেন। একসময়ের ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত এই চ্যান্সেলর পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের বিরুদ্ধে একগাধা অভিযোগ এনে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। মূলত তাঁরই পদত্যাগ তথা বিদ্রোহের কারণে, প্রধানমন্ত্রী বরিস জনগণকে গদি হারাতে হয়েছে। কারণ ঋষি প্রথম পদত্যাগের সাথে একে একে অন্য আরো অনেক চ্যান্সলর পদত্যাগ করেছেন। তাই অধিকাংশ ব্রিটিশ মনে করেন, ডাউনিং স্ট্রিট থেকে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনগণকে বের করে দেয়ার পিছনে মূলহোতা এই ঋষির হাত রয়েছে। এই অবস্থায় বরিস জনগণও চাচ্ছেন না, ঋষি সুনাকই পরবর্তী বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী হোক। অন্যদিকে বরিস জনসনের পছন্দের প্রার্থী হচ্ছেন তাঁরই মন্ত্রী সভার সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী লিজ ট্রাস। যিনি ৭/৮ ধাপ নির্বাচনে প্রতিবার দ্বিতীয় তৃতীয় কিংবা আরো পরের অবস্থানে ছিলেন। যদিও এখন চূড়ান্ত নির্বাচনে দুজনেই একে অপরের সমান সমান প্রতিদ্ব›দ্বী বা কোন কোন জরীপ মতে লিজ ট্রাস এগিয়ে আছেন। তবে আগামী ৫ সেপ্টেম্বর প্রায় দুলক্ষ ভোটারের ভোটের রায়ের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে, কে বসবেন বৃটেনের মসনদে!
ঋষির পূর্বপুরুষ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের অধিবাসী ছিল। তাঁর পূর্বপুরুষ প্রথমে দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকায়, এরপর ষাটের দশকে উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমায়। ঋষি সুনাক ১৯৮০ সালের ১২ মে মাসে বৃটেনের সাউদাম্পটনে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা যশবীর ছিলেন একজন সাধারণ চিকিৎসক এবং মাতা উষা সুনাক ফার্মেসিতে কাজ করতেন। ঋষি যুক্তরাজ্যের উইনচেস্টার কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে লেখাপড়া করেন। এরপর অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে দর্শন ও অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করেন। এরপর স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফুলব্রাইট স্কলার নিয়ে এমবিএ সম্পন্ন করেন। ব্যক্তিগত জীবনে দুই সন্তানের জনক ঋষি সুনাক, ভারতীয় অন্যতম শীর্ষ ধনী আউট সোর্সিং জায়ান্ট ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা এন.আর নারায়ণ মূর্তি ও সুধা মূর্তির মেয়ে, অক্ষতা মূর্তিকে ২০০৯ সালে বিয়ে করে আলোচনায় আসেন। স্ত্রী অক্ষতা মূর্তি অঢেল সম্পত্তির মালিক ও বৃটেনের শীর্ষধনীদের মধ্যে অন্যতম। এই বিষয়ে ঋষি সুনাক বলেন, তাঁর শ্বশুরের এক সময় কিছুই ছিলনা; তবে একটি স্বপ্ন ছিল। শাশুড়ির বহু কষ্টে সঞ্চিত সামান্য অর্থ দিয়ে প্রথমে ছোটখাটো একটি ব্যবসা শুরু করেন। ধীরে ধীরে ব্যবসা প্রসার হতে থাকে। এই অবস্থায় বর্তমানে তিনি বিশ্বের মর্যাদাপূর্ণ সফল কোম্পানিরগুলোর একটির প্রতিষ্ঠাতা। আর এখন তাঁর কোম্পানিতে চাকুরী করে, হাজার হাজার পরিবারের লাখো মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। মিঃ সুনাক আরো বলেন, তাঁর শ্বশুর এমন বাস্তব গল্পের ইতিহাস সৃষ্টির জন্যে তিনি সত্যিকার অর্থে গর্বিত। একইসাথে তিনি উল্লেখ করেন, প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচিত হলে বৃটেনে এই রকম শত শত গল্প সৃষ্টি করবেন।
এইদিকে ঝড়ো গতিতে এতগুলো ধাপ জয়ী হয়ে এলেও চূড়ান্ত বিজয় অতটা মসৃণ নয়। কারণ প্রধানমন্ত্রী হবার পথে তাঁর জন্যে প্রতিকূল পরিবেশ বিদ্যমান। প্রথমতঃ তিনি একজন অভিবাসী ভারতীয় বংশোদ্ভুত, তারপর সদ্য ৪১ বছর অতিক্রম করা তরুণবয়সী, গাত্রবর্ণ হিসাবে কৃষ্ণাঙ্গ নেতা, স্ত্রীর কর প্রদান বিষয়ক বির্তক, নিজ দলের শীর্ষনেতার প্রতি আনুগত্য না হয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠা ইত্যাদি বিভিন্ন তর্কবির্তক তাঁর পিছনে ছুটছে। এইদিকে বৃটেনের চলমান তীব্রতাপ দাহে বৃটেনবাসী যখন চরম অতিষ্ট, তখন নিজ খামার বাড়িতে বিপুল অর্থ ব্যয়ে তিনি বিলাসবহুল সুইমিং পুল নির্মাণ করেন পরিবারের সদস্যদের অবকাশ যাপনের জন্যে। এটা নিয়ে চলছে ব্যাপক সমালোচনা।
আবার অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন সাধারণ জনগণের কর বৃদ্ধি, সদ্য ক্ষমতাচ্যূত প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের প্রকাশ্যে বিরোধিতা ইত্যাদির মত আরো কত কি বিরোধী সদস্যরা জনগণের সামনে নিয়ে আসেছ! আবার বৃটেনের স্থায়ী নাগরিক হয়ে, বৃটেনের মত দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করতে গিয়ে সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় সংস্কৃতি লালনপালন ও ধারণ করা নিয়েও প্রকাশ্যে আলোচনায় আসছে। যেমন- দেবদেবীর প্রতি অতিরিক্ত ভক্তিশ্রদ্ধা, বিভিন্ন পূজা অর্চনা, গোমাতা সেবা, মন্দিরে উপস্থিত হয়ে সমবেত প্রার্থনা, ধর্ম যজ্ঞ ইত্যাদি নিয়ে একাংশ নাগরিক ভিন্নভাবে দেখছে। এছাড়া বিভিন্ন বিতর্কে লিজ ট্রাসের সমর্থকরা জনগণকে অবহিত করছে, ঋষি খুবই আগ্রাসী মেজাজি, কাউকে সমীহ করেনা, সকলের সাথে রুঢ় আচরণ করেন, নিজেকে বিজয়ী হিসাবে সকলের সামনে উপস্থাপন করতে চাই ইত্যাদি আরো কত কি! এখন সবশেষ কথা হচ্ছে, ব্রিটিশগণ প্রায় দুইশ বছর যাবৎ শাসন ও শোষণ করেছিল ভারতবর্ষকে। আর এখন সেই ভারতীয় ঋষি সুনাক, বৃটেনের মসনদে গিয়ে বৃটেনবাসীকে কি শাসন করতে পারবে? তার উত্তর পেতে আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।

লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক