বীর মুক্তিযোদ্ধা পুলকেশ বড়ুয়া প্রফেসর ড. দীপংকর শ্রীজ্ঞান বড়ুয়া

24

রামগড় বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত খাগড়াছড়ি জেলায় অবস্থিত একটি উপজেলা শহর। স্বাধীনতার পূর্বে এটি ছিল মহকুমা সদর। রামগড় সদর শহরের উত্তর-পশ্চিমে ভারতের ত্রিপুরা প্রদেশ; মাঝখানে ছোট্ট ফেনী নদী প্রবাহিত। নদীর ওপাড়ে ত্রিপুরা রাজ্যের সাব্রুম মহকুমা, এপাড়ে বিস্তীর্ণ জায়গা নিয়ে অবস্থিত রামগড় উচ্চ বিদ্যালয়। পুলকেশ বড়ুয়া এই বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষক। সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া অঙ্গনে তার সগৌরব পদচারণার কারণে সংস্কৃতিমনষ্ক স্থানীয় জনগণ এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে তার নিবিড় হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে শুরু হয় নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর আধুনিক অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। দেশব্যাপী শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই রামগড় মহকুমা সদর হয়ে ওঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি। রামগড় উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য স্থাপিত হয় ট্রেনিং সেন্টার এবং ভারতগামী শরণার্থীদের জন্য বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে স্থাপন করা হয় অস্থায়ী শরণার্থী শিবির। ১ মে পর্যন্ত রামগড় ছিল মুক্ত এলাকা; ২ মে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে রামগড়ের পতন ঘটে। এসময়ে আওয়ামী লীগ ও সমমনা সদস্যদের সঙ্গে শিক্ষক পুলকেশ বড়ুয়া শরণার্থীদের এবং প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাযত্নের দায়িত্ব পালন করেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলের অধিকাংশ শরণার্থীদের ভারতে যাওয়ার সুবিধাজনক সীমান্ত হচ্ছে রামগড়- সাব্রুম সীমান্ত। ফলে প্রতিদিন হাজার হাজার শরণার্থীর ভির ছিল রামগড় সদর। এসময়ে শরণার্থীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ও দেখাশোনা করার জন্য সমন্বয়কারী ছিলেন রামগড় থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল মান্নান চৌধুরী। তিনি চট্টগ্রামের মানুষ ছিলেন বিধায় পুলকেশ বড়ুয়ার সঙ্গে তার ছিল আন্তরিক সম্পর্ক। পাকবাহিনীর হাতে রামগড়ের পতন হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত পুলকেশ বড়ুয়া অন্যদের সঙ্গে এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের এবং শরণার্থীদের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। ২ মে পুলকেশ বড়ুয়া ঐতিহাসিক মুজিবনগরে গমন করেন। এখানে খ্যাতনামা সাংবাদিক সঞ্জয় বড়ুয়ার সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। তার পরামর্শক্রমে তিনি বাংলাদেশের একমাত্র ইংরেজি পত্রিকা ‘দি পিপল’- এ সংবাদকর্মী হিসেবে যোগদান করেন। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন আবিদুর রহমান। পুলকেশ বড়–য়া তার স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছেন, ‘মুজিবনগরে গণমাধ্যম ‘দি পিপল’ পত্রিকায় অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে আমার মনে এক নতুন আশার সৃষ্টি হয়। স্বাধীনতার সমরসংগ্রামে গণমাধ্যম প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ের জন্য জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে আমাদের সম্পাদক আবিদুর রহমান অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন। কলকাতা প্রেসক্লাবে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে পত্রিকা সম্পাদক আবিদুর রহমান ‘আমরা কেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাই’ শীর্ষক ইংরেজি ভাষায় যে তথ্যপূর্ণ যৌক্তিক বক্তব্য উপস্থাপন করেন তা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পুলকেশ বড়ুয়া বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে মুক্তিযুদ্ধের নানান প্রকার সংবাদ সংগ্রহ করে ‘দি পিপল’ পত্রিকায় প্রকাশের জন্য প্রদান করতেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ‘দি পিপল’ পত্রিকায় তার সংগৃহীত বহু সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন অকুতোভয় ‘কলমসৈনিক’। বাংলাদেশ শত্রæমুক্ত হওয়ার পর পুলকেশ বড়ুয়া স্বদেশ প্রত্যাগমন করে তার কর্মস্থল রামগড় উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এই বিদ্যালয়ে তিনি ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করার পর চট্টগ্রামস্থ বাকলিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত, বান্দরবান সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত এবং সর্বশেষ নাসিরাবাদ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯৮৭ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সাথে শিক্ষকতা করে অবসর গ্রহণ করেন।
পুলকেশ বড়ুয়ার সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘ তিন দশকের অধিক। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব, আত্মীয়তা, আত্মার সম্পর্ক। বিগত একযুগ হতে আমরা উভয় পরিবার একই ভবনে অবস্থান করায় পারিবারিক সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হয়েছে। কিন্তু অকস্মাৎ এবং এতো শীঘ্রি তিনি যে চিরতরে চলে যাবেন ভাবতেই পারিনি। মাত্র মাসখানেক রোগভোগের পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ভারতের ব্যাঙ্গালোরে নারায়না হৃদয়ালয় হাসপাতালে ২০১৯ সালে ২৯ এপ্রিল পরলোকগমন করেন। তার মৃত্যুতে সমাজ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, এটি বলার অপেক্ষা করে না। এই মহৎপ্রাণ বীর মুক্তিযোদ্ধা পুলকেশ বড়ুয়ার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী তিথিতে তাকে স্মরণ করছি এবং তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
লেখক : প্রফেসর চ.বি. পালি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি