বিলুপ্তি আর নির্যাতন থেকে হাতিকে রক্ষা করা হোক

27

রূপম চক্রবর্ত্তী

হাতি নিয়ে লেখার এবং ভাববার অনেক কারণ আছে। এই বৃহদাকার প্রাণীটির প্রতি অমানবিক হলে দেখা যাবে ডাইনোসরের মত হাতিও আমাদের থেকে হারিয়ে যাবে। রাস্তায় চলাফেরা করার সময় অনেক সময় হাতি দিয়ে মানুষের থেকে টাকা তুলতে দেখা যায়। যে হাতি দিয়ে মাহুত মানুষের থেকে টাকা তুলে সেই হাতিকে বশে আনার জন্য যে নির্মম, নির্যাতন করা হয় তা খুব দুঃখজনক। আবার বিভিন্ন জায়গায় সার্কাস দেখানোর সময় কিছু পোষা হাতি দেখা যায়। আধুনিকতার এই যুগে সার্কাস এবং চাঁদা তোলার কাজে হাতির কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করিনা। আমাদের মনে রাখতে হবে বনের পশু বনেই সুন্দর। জলবায়ু পরিবর্তন, উষ্ণতা বৃদ্ধি, বন খেকোদের নির্বিচারে সবুজ গাছপালা ধ্বংস এবং ভূমিদস্যুদের আগ্রাসী মনোভাবের কারণে প্রতিনিয়ত আমাদের বন্যপ্রাণী কমে যাচ্ছে। আগে বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামে জঙ্গলে সাপ, ব্যাঙ, বেজি, বনবিড়াল, খরগোশ, কাঠবিড়ালিসহ বিচিত্র প্রাণীর দেখা মিলত। কিন্তু বসতি ও কৃষিজমি বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে বনজঙ্গল উধাও হয়ে গেছে। তাছাড়া সরকারি বনাঞ্চল যেভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে সেখানে এদের আশ্রয় কতদিন মিলবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
বন্যপ্রাণীদের সংরক্ষণের উপায় নিয়ে সবাইকে ভাবতে হবে। বন্যপ্রাণী শিকারের প্রবণতা দূর করা দরকার। এজন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বন সৃজনের কার্যক্রম হাতে নেয়া যেতে পারে। ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ নামক বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ গোষ্ঠীর তথ্য মতে, আবাসস্থল ধ্বংস, বিশেষ করে বন উজাড়করণের ফলে ১৬০০ প্রজাতির মেরুদন্ডী প্রাণীর প্রায় অর্ধেক প্রজাতি হুমকির সম্মুখীন। পাখির মধ্যে লাল মাথাযুক্ত হাঁস ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে; অন্যদিকে কালো তিতির, লাল মাথাযুক্ত শকুন, ঈগল, পেঁচা ও সাদা ঈগল ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। শুধুমাত্র নগরায়নের প্রয়োজনে নির্বিচারে একের পর এক অরণ্য কেটে সাফ করে দেওয়া হচ্ছে। চোরাচালানকারীদের কবে পড়ে বিভিন্ন মূল্যবান গাছ অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বন্যপ্রাণীকুলের ধ্বংসের পিছনে অরণ্য ধ্বংসের অবদান সম্ভবত সবথেকে বেশি।
বন্যপ্রাণীরা তাদের খাদ্য এবং আশ্রয়ের জন্য বিশেষভাবে অরন্যের ওপর নির্ভর করে থাকে। তাছাড়া ব্যাপক পরিবেশ দূষণের ফলে বিভিন্ন পতঙ্গ বিলুপ্তির গহবরে হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে অরন্যের স্বাভাবিক প্রজনন পদ্ধতি ব্যাহত হচ্ছে। বন এবং বন্যপ্রাণী ধ্বংসের ব্যাপারে আলাদা করে আর কোনো আলোচনার বিশেষ প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়না। বন জঙ্গলের উপর মানুষের যথেচ্ছাচারের কথা আজ সর্বজনবিদিত। বিপন্ন প্রাণীগুলোর হাতি অন্যতম। প্রতিবছর আমাদের দেশে বেশ কিছু হাতি মানুষের হাতে মারা যাচ্ছে। এই হাতির বংশবৃদ্ধির জন্য আমাদের কাজ করতে হবে। অন্যথায় এই প্রাণীটি এক সময় আমাদের ইতিহাস হয়ে যাবে। এই লেখাটা যখন লিখতে বসেছি তখন একটি টিভি নিউজের প্রতিবেদন দেখছিলাম। হাতিকে পোষ মানানোর কথা বলে কিভাবে একটি বনের পশুর উপর নিষ্ঠুর নির্যাতন করা হয়। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা যায় মা হাতি থেকে দূরে রেখে বাচ্চাকে আলাদা বেঁধে ২-৩ মাসব্যাপী ‘প্রশিক্ষণ’এর নামে নানা কলা-কৌশল শেখাতে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়।
পালিত হাতির বাচ্চা জন্মের আড়াই বছর থেকে ৫ বছরের মধ্যে তাকে পোষ মানাতে হয়। বেশ ব্যয়সাপেক্ষ এ কর্মযজ্ঞটি চলে তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে। প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানহীন এমন একদল লোক ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে হাতির বাচ্চাকে পোষ মানোনোর নামে অমানবিক নির্যাতন করে। এ সময় হাতিটি শৃঙ্খলমুক্ত হতে জোর চেষ্টা চালায়, শুড় উঁচিয়ে কাতরায়। এ সময় হাতিকে খড়ের সঙ্গে মিষ্টি জাতীয় কিছু মিশিয়ে খাওয়ানো হয়। এরপর রশি বাঁধা অবস্থায় হাতিকে বিভিন্ন স্থান ঘোরানো হয়। তারপর ফের বেঁধে রাখা হয়। কখনও নির্যাতনে হাতি শাবক মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তবুও নির্যাতন থামে না। সাতজনের হাতে থাকা সাতটি লোহার রড দিয় অবিরাম খোঁচানো হয় হাতি শাবককে। এই নির্যাতন সইতে না পেরে অনেক হাতি মৃত্যুবরণ করে।
আইইউসিএনের ২০১৬ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, সে সময় বাংলাদেশে হাতি ছিল ২৬৮টি। স্থায়ীভাবে এ অঞ্চলের বাসিন্দা এমন হাতি ছাড়া পরিব্রাজক হাতির গড় সংখ্যা ছিল ৯৩। বন্দী দশায় আছে নিবন্ধিত এমন ৯৬টি হাতি ছিল সে সময়। এক সংবাদে দেখা যায়, গত ৩০ বছরে প্রায় ১৪৩টি হাতিকে হত্যা করা হয়েছে। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় তিন বছরে ৪৩টি হাতি মারা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬টি চট্টগ্রামে এবং বাকিগুলো বান্দরবান ও কক্সবাজারে। চট্টগ্রামের বাঁশখালীর বৈলছড়ি ও অইব্যারখীল বনাঞ্চল, চকরিয়ার ফুলছড়ির রাজঘাট, দুর্গম পান্ডাছড়ি, কাইস্যারঘোনা ও গোয়ালিয়া পালং, ঈদগড়ের ভোমরিয়াঘোনা, উখিয়া, টেকনাফের হ্নীলা, হোয়াইক্যং, লামার ফাঁসিয়াখালীর কুমারী ও ফাঁসিয়াখালী- এ ১৫টি পয়েন্টেই গত পাঁচ বছরে হাতি হত্যা ও হাতি-মানুষের সংঘর্ষ অনেক বেড়ে গেছে।
হাতির যাত্রাপথে যাতে কোনো বাধার সৃষ্টি না হয় তার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। হাতির বিচরণ আছে, এমন বনভূমির আশেপাশে যাদের বাড়ি, তারা যদি নিজেদের ফসল রক্ষা করতে চান তাহলে ধান, আম এসবের চাষ না করে এরকম বিকল্প ফসলের চাষ করতে পারেন। বাড়ির আশেপাশে যেন হাতি না আসে, সেজন্য মধু চাষ করা যেতে পারে। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। এই ব্যবস্থায় দুটো উপকার হয়। মধু চাষ করে বছর শেষে আর্থিকভাবে যেমন লাভবান হওয়া যায়, তেমনি রক্ষা পাওয়া যায় হাতির উৎপাত থেকেও।
বাড়ির অদূরে চারপাশে যদি মৌবাক্স লাগানো হয়, তাহলে চলাচলের সময় হাতির শরীরের সাথে এই বাক্সগুলোর আঘাত লাগলে সেখান থেকে মৌমাছি বেরিয়ে আসে। মৌমাছিরা তখন স্বাভাবিকভাবেই বাক্স থেকে বেরিয়ে এসে হাতিদের কামড় বা তাড়া দেয়। হাতিরা তখন ফের বনে পালিয়ে যায়। হাতিদের উৎপাত থেকে মুক্ত থাকার জন্য এটা খুবই ফলপ্রসূ একটি পদ্ধতি।
দেখা যাচ্ছে প্রতিবছর হাতির সংখ্যা কমছে। হাতি প্রশিক্ষণের নামে পরিচালিত আদিম বর্বরতা বন্ধ করতে হবে। প্রচলিত আইনকে প্রয়োজনে আরও কঠোর করতে হবে। ফসলখেতের বেড়ায় বিদ্যুতের তার লাগানো এবং তাতে বিদ্যুৎ সঞ্চালন যাতে না হয় সেজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সতর্ক থাকতে হবে, দরকার হলে শাস্তির ব্যবস্থাও করতে হবে। যেসব বনে অবৈধভাবে ঘরবাড়ি, ফসলি জমি করা হয়েছে, সেগুলোকে উদ্ধার করে হাতির করিডোর নিশ্চিত করতে হবে। বনের বৃক্ষনিধন বন্ধ করতে হবে। বনে পর্যাপ্ত গাছপালা থাকলে হাতি সেখান থেকে খাবার পাবে, লোকালয়ে আসা কমাবে। বর্শার ডগায় আগুন ধরিয়ে ছুড়ে মারা হয় হাতিকে লক্ষ্য করে। এই আগুনে অনেক হাতি ক্ষত বিক্ষত হয়। যারা এই নিষ্ঠুর কাজগুলো করে তাদেরকে কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে বুঝাতে হবে। কক্সবাজারে মিয়ানমার থেকে অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে এসেছে। তাদের জায়গা দিতে গিয়ে পাহাড়-জঙ্গল সাফ করে তৈরি করা হয়েছে বহু অস্থায়ী ঘর। এতে হাতিরা খাবারের সন্ধানে পাহাড়ের এক পাশ থেকে অন্য পাশে যেতে পারছে না কোনোভাবেই। এমত অবস্থায় হাতির জন্য নিরাপদ আবাস তৈরি করা খুব দরকার।
রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন জায়গায় বন্য হাতির দেখা পাওয়া যায়। সিলেটের কুলাউড়ার লাঠিটিলার জঙ্গলে ভারতীয় জঙ্গল থেকে অনেক সময় হাতি নেমে আসে। শেরপুর, নেত্রকোনা, জামালপুরেও বছরের কয়েক মাস হাতি দেখা যায়। বাকি সময়টা এরা থাকে ভারতে। যেখানেই হাতি থাকুক না কেন সেখানেই হাতি সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিতে হবে। আগামী দিনে হাতি সংরক্ষণ না করলে এবং মানুষের হাতে হাতি নিধন বন্ধ করতে না পারলে বিশাল দেহের ডাইনোসরের মতো এই প্রাণীটিও এক সময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ব্যাক্তি পর্যায়ে থাকা হাতিগুলোর জন্য একটা অভয়ারণ্য তৈরি করা হোক। হাতি দিয়ে সার্কাস দেখানো, হাতি দিয়ে চাঁদা উত্তোলন এবং শিকারীদের কাছ থেকে হাতিকে রক্ষা করে বিপন্ন প্রজাতির এই প্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে বাংলাদেশের বনভূমি চিরজাগ্রত থাকুক।
লেখক: প্রাবন্ধিক