বানর উপাখ্যান

24

মছিউদ্দৌলা জাহাঙ্গীর

আজব এক প্রাণী বানর, তার এই আজব স্বভাবের কারণে মানুষকেও আজ আমরা বানর বা বাঁদর বলে ডাকি। বিশেষ করে বজ্জাত ধাঁচের মানুষদের আমরা সাধারণত সেই অভিধায় অভিহিত করি। বানর নব্বই বছর হলেও গাছ বায়Ñএকটি বহুল ব্যবহৃত বাক্য। কিসিঞ্জার কিসিমের মানুষের ক্ষেত্রে সচরাচর আমরা এই উপমাটি প্রয়োগ করি। অবশ্য বানরের আরো কিছুপ্রতিশব্দ রয়েছে, তার মধ্যে একটি হলÑশাখামৃগ। গাছ বাওয়ার সাথে এটি পরিপূর্ণ যায়, সেই সাথে খাসামৃগ তথা হরিণের সাথে নাকি তার ভালো বন্ধুত্ব রয়েছে। প্রচলিত আছে বানরের ডাক শুনে হরিণেরা সেখানে ছুটে যায়। আর এ তথ্যটি কাজে লাগিয়ে শিকারীরা বানরের মতো ডাকতে থাকে। ডাক শুনে যখন হরিণ আসে শিকারীরা তাদের শিকার করে। এদিক হতে বিবেচনা করলে, বানরের বন্ধুত¦ হরিণের জন্য অতি ব্যয়বহুল। বানর হরিণকে গাছের ফল-পাতা পেড়ে দেয় বলেই তাদের মধ্যে এত বন্ধুত্ব। কিন্তু তার জন্য হরিণকে অনেক সময় চড়া মূল্য দিতে হয়। সে যা’ই হোক, তার জন্য তো আর বন্ধুত্ব থেমে থাকে না। তবে কুকুর-বানরের রসায়নটা পরম বৈরী, চরম সাংঘর্ষিক। বছর খানেক আগে, তথা ২০২২ সালে আমরা তা লক্ষ্য করলাম ভারতের মহারাষ্ট্রে।
মহারাষ্ট্রের একটি গ্রামে কুকুর-বানর রীতিমত বিশ^যুদ্ধ হয়ে গেল। কুকুর নাকি একবার বানরের একটি বাচ্চাকে হত্যা করেছিল। ব্যস, সেই সূত্র ধরে গোটা গ্রাম বানরেরা কুকুর শূন্য করে দিল!আর বানরের সেই প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ দেখে গোটা একটি প্রবন্ধ লিখে ফেলেছিলাম সেই সময় বানরের উপরে। তারপর ভেবেছিলাম সেই শেষ, আরকিছু লিখতে হবে না বানরকে নিয়ে। বানর আমাদের জীবনে আর আসবে না। কিন্তু না, সেই আসা শেষ আসা না। বানর আমাদের ছাড়ছে না, ঘুরেফিরে বানর খালিআমাদের জীবনের যাত্রাপথে প্রবেশ করছে। সম্প্রতি দেখলাম ক্লাস সিক্স-সেভেনের পাঠ্য বইয়ে সে স্থান করেনিয়েছে। ওমাÑবানর নাকি মানুষের পূর্বপুরুষ, আমরা মানুষরা নাকি বানর থেকে এসেছি বিবর্তন তথা রূপান্তরের মাধ্যমে! ও মোর খোদা, এইডা কি অইলে, বানর মানুষ অইলে ক্যামনে?Ñবরিশাইল্যা কথা, হাহাহাহা। বহু আগে শুনেছিলাম হযরত দাউদ নবী অভিশাপ দিয়ে কিছু মানুষকে বানর বানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সে তো ছিল কিছু সময়ের জন্য, কদিন পর তারা তো মরে গিয়েছিল।
প্লাসে মাইনাসে আÐা, তাদের সাথে আমাদের হিসাব ঠাÐা, সব শেষ। সকল সম্পর্ক মিটে গেছে, সব হিসাব চুকে গেছে। তাদের দলে তারা আমাদের দলে আমরা। কিন্তু এত বছর পর সেই সম্পর্ক কেন আবার খোঁচা দিতে লাগল? শুনেছি দুই হাজার বছর আগে ফিলিস্তিন ছিল ইহুদীর দখলে। সেই সূত্র ধরে আজ তারা তাদের অধিকার বুঝে নিয়েছে, ফিলিস্তিন দখল করেছে। মাঝ খানের দুই হাজার বছর গায়েব করেদিল। ফলে সেই দীর্ঘ সময় ধরে যারা সেখানে বাস করেছিল তারা এখন প্রবাসী, ইহুদীরাই তার প্রকৃত অধিবাসী। কাজেই দুই হাজার বছর বাদ দিলে ফিলিস্তিন গত কালও তাদের ছিল, আজও তাদের আছে এবং আগামীতেও তাদেরই থাকবে, হেহেহেহে। সেই ফর্মূলা মোতাবেক হিসাব করলে দাউদ নবীর বানর আর আমরা বরাবরই এক। মাঝের তিন হাজার বছর ভুলে গেলেই হবে, তাহলে বানর যা আমরাও তা। এখানে কথা হতে পারে তারা তো কয়দিন পর মরে গেছে, সুতরাং তারা ও আমরা এক হলাম কি করে? জবাব অতি সোজা। সেই কয়দিনের মধ্যে কি তাদের বাচ্চাকাচ্চা হয়নি? সেই কদিন তারা ঘর-সংসার করেনি এমন প্রমাণ কি কেউ দিতে পারবেন?
মনে রাখতে হবে এ পৃথিবী জন্ম-মৃত্যুর খেলা। এখানে প্রতি মুহূর্তে কেউ জন্মগ্রহণ করছে, কেউ মৃত্যুবরণ করছে। প্রতিনিয়ত একাজ এখানে চলছে, কাজেই তর্কে যাওয়ার দরকার নাই। তর্কে কোনসমাধান নাই, বিশ^াসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। যার যা বিশ^াস সে তা নিয়ে থাক। আমরা কারো বাড়াভাতে হাত দিতে চাই না। আমরা চাই জাফর ইকবাল সাহেব তাঁর বিশ^াস নিয়ে থাকুক, আমরা আমাদের বিশ^াস নিয়ে থাকি। কি দরকার খামোখা তর্কে জড়িয়ে। আমরা তর্ক করবো না, আমরা করবো গল্প। গল্প করে দিন কেটে যাবে, সময় বয়ে যাবে, মন সতেজ হবে। পূর্বে আমাদের দাদা-নানারাও নাকি এই কাজটা করতেন সময় কাটানোর জন্যে।আমাদেরও সেই সুয়োগ এখন এসেছে, সময় কাটাবার উপায়। এই কাজে আবার আফগান পাঠানরা নাকি ভারি ওস্তাদ, আমাদের প্রখ্যাত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেব বলেছেন। মিশরীয়রাও নাকি কম যায় না, তারাও নাকি বেশ আড্ডাবাজ। সেদিকে আর না যাই, আসলে সময় কাটার দারুণ এক প্রসঙ্গ পেয়েছি। পাঠ্যবই নিয়ে টিভি-মিডিয়াতে চলছে বড় জম্পেশ আড্ডা। দিনরাত খালি টক শো, দেখতে দেখতে সময় কেটে যাচ্ছে কিন্তু টক লাগছে না, হাহাহাহা।
দেশে গেল কয়েক মাসে আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে যে অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, মনে হচ্ছে জাফর ইকবাল মহোদয় সেই আগুনে পানি ঢেলে দিয়েছেন। ফলে সবাই এখন ভিপি নুর, মোসাদ, আন্দোলন বাদ দিয়ে ঢুকেগেছে পর্দা, শরিফার স্বপ্ন আর ডারউইন তত্তে¡। সুতরাং বলা যায় জাফর ইকবাল সাহেব কামের কাম একটি করেছেন। জনগণকে আন্দোলন থেকে বের করে আড্ডায় বসিয়ে দিয়েছেন। কাজেই মানুষ বেপর্দা, সমকামীতা, বানর-শিম্পাঞ্জী নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছে। বিরোধী দলের আন্দোলন সেখানে এসে নোঙ্গর করেছে, টিভি-মিডিয়ায় টকশোগুলোতে খালি বানর এবং ডারউইনকে নিয়ে কথা-বার্তা। শুরু হয়েছে ইসলাম ও বিবর্তনবাদ নিয়ে বিতর্ক। অতএব আন্দোলনের চাপ থেকে সরকার কিছুটা মুক্তি পেয়েছে, বাস্তবে আন্দোলনে কিছু ভাটা দেখা যাচ্ছে। মনে হয় ডারউইনের তত্ত¡ ভাল কাজ দিয়েছে। কিন্তু কথা হল জনগণ সব বুঝেগেছে, এটা যে আন্দোলন দমানোর কৌশল জনতা তা ধরেফেলেছে। টকশোতে আলোচকরা বলছেন বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন না করতে। কারণ আন্দোলন করলে সরকার পশ্চিমাদের বুঝাতে সক্ষম হবে, ‘দেশ জঙ্গী-মৌলবাদীদের খপ্পরে পড়েছে, তাদের দমাতে আমাদের ক্ষমতায় থাকতে হবে,’ হেহেহে।
আচ্ছা সিক্স-সেভেনে বিবর্তনবাদ না পড়ালে কি হয়? দয়া করে কেউ ভুল বুঝবেন না। কেউ কেউ বলছেন, বিবর্তনবাদ বিজ্ঞান। অতএব আমাদের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান বিমুখ রাখলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অনগ্রসর হয়ে পড়বে। আসলে কথাটা মানতে পারছি না। কারণ জাতির অগ্রসরতার জন্য নৈতিকতা হচ্ছে মূলত প্রধান বিষয়। আর নীতি এবং নৈতিকতার আসল উৎস হলো ধর্ম। ধর্মের কথা যখন চলে আসে তখন ইসলাম হয়ে উঠে আলোচনার প্রধান নিয়ামক। কারণ ইসলামই হল নৈতিকতা অর্জনের মূল ভিত্তি। এখন ইসলাম যেখানে অবস্থান করবে সেখানে তো বিবর্তনবাদের স্থান হতে পারে না। যেহেতু দুটি বিষয় পরস্পর সাংঘর্ষিক, তাই এ দুই বিষয় কখনো একসাথে যেতে পারে না। কাজেই একটিই থাকতে হবে। এখন প্রশ্ন, কোনটি থাকবে? আমাদের কথা হল, অবশ্যই ইসলাম থাকতে হবে। কারণ একটি জাতি বিনির্মাণে বিবর্তনবাদ শিক্ষার চাইতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ নৈতিকতা শিক্ষা। তাছাড়া বিবর্তনবাদ তো কোন বিজ্ঞান না, অনুমান। আর বিজ্ঞান হলেই যে সব বিজ্ঞান শিখতে হবে এমন কোন কথা নেই। কিন্তু নৈতিক শিক্ষা প্রত্যেককে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে, আর বিবর্তনবাদ থাকলে সেখানে নৈতিক শিক্ষা সম্ভব নয়।
এখানে একটি কথা বলি, বিজ্ঞান কিন্তু চূড়ান্ত সত্য প্রকাশ করে না, প্রকাশ করে কাছাকাছি সত্যÑএটি আমার কথা না। আইজ্যাক আসিমভ, ব্রাইয়াল স্মিড, ইথান সেগেল, নোয়াম চমস্কি, প্রমুখ মনীষীদের কথা। আসলে বিজ্ঞান ও গবেষণা একসময় মানুষকে বিভ্রান্তির দিকে নিয়ে যায়। মাইক্রো ও ম্যাক্রো, উভয় ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটি ঘটে। মহাকাশের দিকে তাকান, এই যে অভিকর্ষ টান, সূর্যের এই টানের কারণে নাকি পৃথিবীসহ গ্রহগুলো কক্ষপথে টিকে আছে। অথচ আমরা জানি একেকটি গ্রহের গতি ঘণ্টায় লক্ষ মাইল। এই প্রচÐ গতির গ্রহকে সূর্য আটকে রাখছে কেমন করে? নিশ্চয় সেখানে সূর্যের অভিকর্ষ টানের শক্তি গ্রহদের গতি শক্তি থেকে বেশি হতে হবে। নইলে প্রচÐ গতির কারণে তো গ্রহগুলোর কক্ষচ্যুতি ঘটার কথা। অপরদিকে সূর্যের অমন শক্তিশালী টানের কারণে গ্রহদের সূর্যের ভেতর ঢুকে যাওয়ার কথা কিন্তু ঢুকছে না, তাদের অবস্থানেই তারা রয়েছে। এটি কেমন করে হচ্ছে? বেশ জটিল সমীকরণ, এ সমস্যা সমাধানে বিজ্ঞানীরা স্ট্রিং তত্ত¡ হাজির করেছেন কিন্তু সমাধান হচ্ছেনা। এমন অগণিত বিভ্রান্তি বৃহৎ পরিসরে যেমন রয়েছে, তেমন কোয়ান্টাম স্তরেও বিদ্যমান আছে।তাই তো সেখানে শ্রæডিঙ্গারের বিড়ালতত্ত¡, হাইজেন বার্গের অনিশ্চয়তার নীতি, আইনেস্টাইনের স্পুকি এ্যাকশন কথাগুলো চালু রয়েছে। বস্তুত গোটা পৃথিবী রহস্যময়, পুরা বিশ^ই বিভ্রান্তি। আরে মানুষ তো তার অস্তিত্ব নিয়েই সন্দিহান ছিল, মাত্র চারশ বছর আগে রেনে দেকার্তে প্রথম অনুধাবন করেছিলেন, ‘আই থিঙ্ক, দিয়ারফর আই এ্যাম!’ তারপর থেকে মানুষ ভাবতে পারছে সে একটি সত্তা, হাহাহাহা। অতএব পরমসত্য এখানে কিছু না। আসলে ঝামেলা সব জ্ঞানীদের ভেতর, আমজনতা তার ধারেকাছেও নাই।
এবার আসুন পিএইচডি গবেষণায়। ধরুন আপনি রবিন্দ্রনাথকে নিয়ে গবেষণা করছেন। এখন আপনি চাইলে তাঁকে ফেরেস্তা বানাতে পারেন, আবার চাইলে শয়তানও বানাতে পারেন। সব আপনার মগজের খেল, যেমন চিন্তা তেমন ফল। বিবর্তনবাদও তেমন ডারউইনের চিন্তাপ্রসূত একটি প্রস্তাবনা। দুঃখের কথা হল ডারউইন যে জাহাজে বিশ^ ভ্রমণ করেছিলেন, সেই বীগল জাহাজের ক্যাপ্টেনফিটজরয় ডারউইনের তত্তে¡র কারণে নিজেকে মহাপাতক ভেবে আত্ম হত্যা করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, যেহেতু ডারউইনকে তিনি জাহাজে নিয়েছেন, তাই ডারউইনের পাপে তিনিও সম অংশীদার। অনেক মতবাদ সমাজে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে, তাই সমাজের কল্যাণে অনেক কিছু গোপন রাখতে হয়।বিবর্তনবাদ আবশ্যক ধরে নেওয়ার কোন কারণ নাই, এতত্ত¡ ভুলও হতে পারে। যেমন আমরা জানি বিশে^র সর্বোচ্চ গতি হচ্ছে আলোর গতি। কিন্তু কোয়ান্টাম তত্তে¡ বলা হচ্ছে, দুটি ইন্টেঙ্গেলড পার্টিক্যালকে মহাবিশে^র দুই প্রান্তে রাখলেও একটিতে যদি হেড আসে, সাথে সাথে অপরটিতে টেল আসবে। অথচ দুটির দূরত্ব ৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষÑঅনুমান করা হচ্ছে মহাবিশ^ নয় হাজার তিনশ কোটি আলোকবর্ষ পরিমাণ বিস্তৃত! এই তাৎক্ষণিক যোগাযোগের কোনব্যাখ্যা নাই, আর এখানেই আমি আমার ¯্রষ্টাকে খুঁজে পাই। এবারএকটি চুটকি বলে লিখার ইতি টানি। শিক্ষক, মিঠু বানর থেকে যে মানুষ হয়েছে, একথা কি তুই জানস? মিঠু, কন কি স্যার, তাহলে দেশে এত বানর এখনো থাকে কি করে? সব তো মানুষ হয়ে যাওয়ার কথা, হাহাহাহা।
বি. দ্র. ইন্টেঙ্গেলমেন্ট হলোÑদুটি পার্টিক্যাল একই উৎস হতে উৎপত্তি, কিংবা দুটি পার্টিক্যাল পরস্পর মিথস্ক্রিয়। ইন্টেঙ্গেলড পার্টিক্যালের ক্ষেত্রে দূরত্ব কোন বিষয়ই না।

লেখক : কলামিস্ট