বনের বৃক্ষ কমছে, বাড়ছে আচ্ছাদিত এলাকা

9

 

একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকলে তাকে প্রকৃতিবান্ধব দেশ বলা চলে। সেখানে বাংলাদেশে আছে মাত্র ১১ শতাংশ বনভূমি। গত শত বছর ধরে দেশের বনভূমি নানা কারণে কমে যাচ্ছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের এইক্ষণে যা কাম্য নয়। তবে শান্তনার বিষয় এই যে, বনের বৃক্ষ কমলেও বনের বাইরে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা বাড়ছে। যার পরিমাণ প্রায় দুই লাখ বিশ হাজার হেক্টর। পরিসংখ্যানে দেখ যায় যে, ২০০০ এবং ২০১৪ সালে যথাক্রমে বনভ‚মির বাইরে ও বনে বৃক্ষ বাড়া ও কমার হিসাব। প্রতি এক হাজার হেক্টরের ভিত্তিতে হিসাবটি দেয়া গেল। ২০০০ সালে বনের বাইরে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা ১৭০১.৪ হেক্টর এবং ২০১৪ বন এলাকা ছিল ১৯২০.৭ হেক্টর। পার্বত্য এলাকার বনভ‚মি ছিল ৯৩৭.৯ হেক্টর তার বাইরে ছিল ৮৫৬.২ হেক্টর। একই ভাবে ম্যানগ্রোভ এলাকায় ৫০৩ এবং ৫০০.৭ হেক্টর। শালবনে ছিল ১৬.৬ ও ১৬.১ হেক্টর। এই হিসাবটি স্যাটেলাইট ছবিতে ধারনকৃত এবং মাঠ জরিপের ভিতিত্তে করা হয়।
আগেই বলেছিল দেশে প্রাকৃতিক বনভূমি ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে, বাড়ছে আচ্ছাদিত বনভূমি। এর মূল কারণ হলো, বৃক্ষের অর্থনৈতিক মূল্যের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ, কমিউনিটি উদ্যোগ এবং সরকারের সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি। যার প্রভাবে লোকালয়ে বৃক্ষের সংখ্যা বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ বন বিভাগের যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে যে, ২০০০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বনের বাইরে প্রায় দুই লাখ উনিশ হাজার তিনশত হেক্টর বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা বেড়েছে। অনেকে এ তথ্যকে আশাব্যঞ্জক মনে করলেও পরিবেশ ও জীব বিজ্ঞানিরা বলেন গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন। কারণ হিসাবে তারা বলেন, লোকালয়ে শুধু অর্থনৈতিক গুরুত্ব দিয়ে আচ্ছাদিত বন সৃষ্টি করা হয়। অন্যদিকে প্রাকৃতিক বনে হরেক ধরনের বৃক্ষ উৎপন্ন হওয়ায় বৃক্ষের বৈচিত্র্যতা যেমন বাজে, তেমনি জীববৈচিত্র্যতাও রক্ষা পায়। জীববৈচিত্র্যতা উন্নত বাস্তুতন্ত্রের একটি মাপকাঠি।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতত্ত্ব বিষয়ক রাষ্ট্রিয় সংস্থা ইউএসজিএস ও মহাকাশ বিষয়ক সংস্থা নাসা থেকে সরবরাহকৃত ছবি এবং স্থানীয়ভাবে মাঠ জরিপের ভিত্তিতে এই গবেষণাকর্মটি সম্পাদিত হয়। ২০০০ সালকে মূল বর্ষ ধরে ২০১৪ সালের মধ্যে বন ও বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার তুলনা করাই ছিল গবেষণার উদ্দেশ্য। বনবিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মনে করেন যে, উপক‚লীয় অঞ্চলে জেগে ওঠা নতুন চরভূমি এবং ফাঁকা জায়গায় গাছ লাগানোর ধারণাটি জনপ্রিয় করায় এই পরিবর্তন। এ ছাড়াও প্রান্তিক পর্যায়ে মানুষ গাছকে তার সামাজিক বীমা হিসাবে দেখে থাকে। বলা যায় গাছের বিক্রয় মূল্যের কারণে মানুষ লোকালয়ে গাছ লাগাতে উৎসাহী হচ্ছে। এ গবেষণায় সর্ব মোট তিন হাজার গ্রহণ করা হয়। তাতে দেখা যায় দেশের পার্বত্য এলাকায় একই সময়ে ৮০ হাজার ৮০০ হেক্টর বনভূমি উজাড় হয়ে গেছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী দেশে বর্তমানে তিন লাখ ৬৫ হাজার ৪০০ হেক্টর বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা আছে। দেশের আয়তনের ২১ শতাংশ আচ্ছাদিত বনভূমি। অন্য দিকে বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন বনভূমির পরিমাণ মোট আয়তনের মাত্র ১১ শতাংশ। এই ১১ শতাংশ নিয়েও আছে নানা দ্বিমত।
দেশের আচ্ছাদিত বনের পরিমাণ বাড়া যেমন ইতিবাচক পরিবর্তন তেমনি প্রাকৃতিক ও সংরক্ষিত বনভ‚মি কমে যাওয়া/ধ্বংস হওয়া দুঃচিন্তার কারণও বটে। কারণ জীববৈচিত্র্য ও জিন সম্পদ প্রাকৃতিক বলেই লালিত হয়ে থাকে। তাই আমাদের বনভূমি রক্ষার জন্য গভীর মনোযোগ দিতে হবে অবশ্যই। আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ একটি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ। এখানে কৃষি শিল্প ও নগরায়নের জন্য প্রচুর জমি প্রয়োজন। এই জমির যোগান স্বল্প। অন্যদিকে জনসংখ্যা আকার বিশাল। এই জমির চাহিদা মিটিয়ে কৃষি, শিল্প ও গৃহায়তনের জন্য চাই সুপরিকল্পিত দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। বাস্তবতা হলো এককভাবে গাছের জন্য জমি ব্যবহার করা কঠিন। তাই সামাজিক বনায়ন, বৃক্ষরোপণ, ছাদ বাগানের কর্মসূচির পাশাপাশি বিদ্যমান বনভ‚মিকে যেকোন মূল্যে রক্ষা করতেই হবে। আবার উপকূলীয় নতুন চরে ব্যাপক হারে বৃক্ষরোপণকে উৎসাহিত করা বাঞ্ছনীয়। ইতিমধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির সফলতার জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে ৭টি পদক পেয়েছে। তবে আমাদের সমস্যা হলো পার্বত্য অঞ্চলের বেশিরভাগ জমি জেলা প্রশাসন ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির এবং কর্পোরেটদের দখলে আছে।
বৃক্ষ দেশে অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং একই সাথে কার্বন নিঃসরণ কমায়। উষ্ণতা রোধ করে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে দেশকে রক্ষা করে। সিলিন্ডারের অক্সিজেন নয় প্রাকৃতিক অক্সিজেন বেশি বেশি জরুরি। বনাঞ্চল বৃষ্টির পানি ও প্লাবন থেকে মাটিকে ধরে রাখার জন্য ৭০ শতাংশ অবদান রাখে। মাটির ভাঙ্গন ও ক্ষয়রোধ করার জন্য বৃক্ষের ব্যাপক ভূমিকা আছে। অতএব আচ্ছাদিত বনের পাশাপাশি প্রাকৃতিক বনভূমিকে ধ্বংসের হাত থেকে অবশ্যই অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। দেশের প্রকৃত উন্নয়নের বনভ‚মিকে রক্ষা করে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার বিকল্প নেই।
লেখক: কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব.)