বদির ৪ ভাইসহ ১০২ ইয়াবা ব্যবসায়ীর আত্মসমর্পণ

49

স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আশায় টেকনাফে ১০২ ইয়াবা কারবারী আত্মসমর্পণ করেছেন। এর মধ্যে ৩০ জনই শীর্ষ ইয়াবা কারবারী। আত্মসমর্পণের তালিকায় রয়েছেন উখিয়া-টেকনাফের সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদির আপন চার ভাইসহ ফুফাত ভাই, চাচাত ভাই, তালতো ভাই, ভাগিনাসহ অনেক নিকটাত্মীয়, ছিলেন টেকনাফ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাফর আলমের ছেলেও। জেলা পুলিশের তত্ত্বাবধানে গতকাল শনিবার টেকনাফ পাইলট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে প্রশাসনের দেয়া নয় শর্ত মেনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের আইজি’র কাছে তারা আত্মসমর্পণ করেন। এ সময় আত্মসমর্পণকারীরা সাড়ে ৩ লাখ ইয়াবা, ৩০টি অস্ত্র ও ৭০ রাউন্ড গুলি জমা দেন। তাদের আইনি প্রক্রিয়া শেষে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এ আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ায় মুখ্য ভূমিকা পালনকারী সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদি ছিলেন না এ অনুষ্ঠানে। এতে সভাপতিত্ব করেন কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) এ বি এম মাসুদ হোসেন।
এতে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, জঙ্গি ও অস্ত্রবাজদের মতো আমরা মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি, এই যুদ্ধে আমাদের জয়ী হতেই হবে। ফলে যে কোন মূল্যেই এ ইয়াবা বন্ধ করতে হবে। মাদকের সঙ্গে কোন আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য জড়িত থাকলে তাদেরকেও ছাড় দেওয়া হবে না।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আত্মসমর্পণকারীরা অতীতের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত। তাই তারা আত্মসমর্পণ করেছেন। সরকার তাদের প্রতি সুদৃষ্টি রাখবে। শুধু অভিযান চালিয়ে মাদক বন্ধ করা যাবে না। আর যেন কেউ ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত না হন, সে বিষয়ে সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সজাগ থাকতে হবে।
আত্মগোপনে থাকা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আত্মসমর্পণ করুন, না হলে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করা হবে। আত্মসমর্পণ না করলে পরিণতি ভয়াবহ হবে। যারা আত্মসমর্পণ করছেন তাদের জন্য এক ধরনের বার্তা আর যারা করেননি তাদের জন্য আরেক বার্তা বলে উল্লেখ করেন মন্ত্রী।
টেকনাফ সীমান্তে দায়িত্বপালনকারী বিজিবি’র উদ্দেশ্যে বলেন, অভিযোগ এসেছে টেকনাফ সীমান্তে বিজিবি সদস্যরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না। তাদের প্রতি বার্তা হচ্ছে দায়িত্বে অবহেলা করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা কারবারীদের সরকারের পক্ষ থেকে আইনি সহায়তা দেয়া হবে। এদের মধ্যে কেউ আর্থিকভাবে অসচ্ছল থাকলে তাদেরও সহায়তা দেয়া হবে। ইয়াবা কারবার থেকে আয় করা স¤পদ জব্দ করে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হবে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বার্তা পাওয়ার পর নির্বাচনের পরে মাদকের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে অভিযান শুরু করা হয়। এই এলাকার গুটিকয়েক মানুষের কারণে সাড়ে তিন লাখ মানুষের দুর্নাম হচ্ছে। জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনে জনগণের সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে উল্লেখ করে তিনি মাদক নির্মূলেও সহযোগিতা কামনা করেন।
অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনার ভাইটি কী করে, ছেলেটি কী করে তার প্রতি নজর রাখুন। মাদক ব্যবসায়ীরা যদি আত্মসমর্পণ না করেন তবে কেউ ছাড় পাবেন না। পুলিশ যদি কোন নিরীহ মানুষকে ইয়াবা দিয়ে হয়রানি করে তাদেরও শাস্তি হবে।
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন কক্সবাজার থেকে নির্বাচিত চার সংসদ সদস্য জাফর আলম, আশেক উল্লাহ রফিক, সাইমুম সরওয়ার কমল ও শাহীন আক্তার, পুলিশ চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক, কক্সবাজার রিজিওনাল কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার সাজেদুর রহমান, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেন, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এড. সিরাজুল মোস্তাফা, সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান ও টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের এএসপি মাহামুদা রহমান সোনিয়া।
আত্মসমর্পণ করলেন যারা :
উখিয়া টেকনাফ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির চার ভাইসহ যথাক্রমে আবদুর শুক্কুর, আবদুল আমিন, মোহাম্মদ শফিক ও মোহাম্মদ ফয়সাল, ভাগিনা সাহেদুর রহমান নিপু, ফুফাত ভাই কামরুল হাসান রাসেল, চাচাত ভাই মো. আলম, ভাগিনা সাহেদ কামাল নিপু, শামসুল আলম শামীম, তালতো ভাই শাহেদ কামাল, ছৈয়দ হোসেন মেম্বার, জামাল হোসন, মং অং থেন, টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আলমের ছেলে দিদার মিয়া, টেকনাফ সদর নাজির পাড়ার এনামুল হক মেম্বার, আবদুর রহমান, মোহাম্মদ রফিক, মোহাম্মদ হেলাল, মো. আবছার, নূরুল আলম, মৌলভী পাড়ার একরাম হোসেন, আব্দুল গনি, মো. আলী, গোদার বিলের জিয়াউর রহমান ও আবদুর রহমান, কচুবনিয়ার বদিউর রহমান প্র. বদুরান, ডেইল পাড়ার আব্দুল আমিন ও নুরুল আমিন, উত্তর লম্বরির আব্দুল করিম, রাজারছড়ার আব্দুল কুদ্দুছ, জাহালিয়া পাড়ার মোহাম্মদ সিরাজ, তুলাতলির নুরুল বশর, হাতিয়ার ঘোনার দিল মোহাম্মদ, মো. হাসান, মো. সিরাজ, মো. আব্দুল্লাহ, হোসন আলী, জাফর আলম, মো. ছিদ্দিক, মো. আয়ুব, মাঠ পাড়ার মো. কামাল হোসেন, নতুন পল্লান পাড়ার মো. সেলিম, তুলাতুলির নূর বশর কালা ভাই, করাচি পাড়ার মো. হাসন, রাজারছড়ার আব্দুল কুদ্দুস, মিঠা পানির ছড়ার মো. ইউনুচ, টেকনাফ পৌরসভার পুরাতন পল্লান পাড়ার শাহ আলম, জালিয়াপাড়ার মোজাম্মেল হক, জুবাইর হোসেন, ঈমান হোসন, নূর বশর, নূরুল বশর মিজ্জি, মো. হাসেম আন্তু, অলিয়াবাদের মারুফ বিন খলিল বাবু, হাবিবুর রহমান প্র. নূর হাবিব, মো. ইসমাইল, নূর আলম, মো. আলম, নাইট্যং পাড়ার মোহাম্মদ ইউনুছ, মো. আয়ুব, রহিম উল্লাহ, হ্নীলা লেদার নূরুল হুদা মেম্বার, জামাল মেম্বার, মো. শাহ, নূর কবির, ছৈয়দ হোসন সইতু, হাসান আব্দুল্লাহ, রমজান আলী, ফরিদ আলম, মাহবুব আলম, নজরুল ইসলাম, রশিদ আহাম্মদ রশিদ খুলু, শাহ আজম, রোস্তম আলী, মো. হোসেন, আবু তৈয়ুব, আলী নেওয়াজ, জোহুর আলম, মো. হোসেন, রবিউল আলম, হামিদ হোসেন, বোরহান উদ্দীন, মো. হারুন, পূর্ব লেদার জাহাঙ্গীর আলম, পশ্চিম পানখালীর নূরুল আফসার, সাবরাং এর মো. শামসু মেম্বার, মোয়াজ্জেম হোসেন দানু মেম্বার, রেজাউল করিম মেম্বার, মৌলভী বশির আহাম্মদ, আবু তাহের, আব্দুল হামিদ, মো. তৈয়ুব, জাফর আহম্মদ, কাটাবনিয়ার শওকত আলম, চান্দলী পাড়া হোসাইন আহাম্মদ, মন্জুর আলী, মো. রাশেল, নূরুল আমিন, জিনা পাড়ার আলী আহাম্মদ, মুন্ডার ডেইলের সাকের মাঝি, নয়াপাড়ার আলমগীর ফয়সাল লিটন, বাহারছড়ার শামলাপুরের শফি উল্লাহ, জোম পাড়ার সৈয়দ আলম, উত্তর শীলখালীর আবু সৈয়দ, জাহাজপুরার নূরুল আলম, কক্সবারের মো. শাহ জাহান আনসারী।
অনুষ্ঠানে ছিলেন না বদি :
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না আত্মসমর্পণে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী সাবেক আলোচিত সাংসদ আবদুর রহমান বদি। অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক, অতিরিক্ত ডিআইজি (অপারেশন অ্যান্ড ক্রাইম) মোহাম্মদ আবুল ফয়েজ, কক্সবাজার জেলার চারটি আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম, আশেকউল্লাহ রফিক, সাইমুম সরওয়ার কমল, শাহীন আক্তার চৌধুরী, জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা, সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান রহমান প্রমুখ উপস্থিত থাকলেও যাকে টেকনাফের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ও সবকিছুর নিয়ন্ত্রক বলা হয়, সেই আলোচিত আবদুর রহমান বদিকে দেখা যায়নি।
সূত্রমতে, বিতর্ক এড়াতে বদিকে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তবে আবদুর রহমান বদিই আত্মসমর্পণের প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন। বিভিন্ন সভা সমাবেশ ও মাইকিং করে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আল্টিমেটাম দিয়ে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছিলেন তিনি। বদির আহব্বানে সাড়া দিয়ে তার নিকটাত্মীয়সহ অনেকে আত্মসমর্পণের জন্য প্রায় একমাস আগে পুলিশি হেফাজতে চলে যান। কিন্তু বিভিন্ন বিতর্কের মুখে শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি তাকে। তবে বদির স্ত্রী বর্তমান সংসদ সদস্য শাহীন আক্তার আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
দৃষ্টি ছিল শাহাজান আনসারির প্রতি :
ইয়াবার ব্যবসা করে কোটিপতি বনে যাওয়া শাহাজান আনসারি অবশেষে আত্মসমর্পণ করেছেন। কক্সবাজারের শীর্ষ এই ইয়াবা ব্যবসায়ী সকালে টেকনাফ পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এক সময়ের পান দোকানী শাহাজান আনসারি ইয়াবা ব্যবসা করে বর্তমানে কয়েকটি আবাসিক হোটেলসহ হাজার কোটি টাকার মালিক। কক্সবাজার পর্যটন এলাকার হোটেল লেগুনা বিচ ও জামান হোটেল তার ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে। ইয়াবা ডন শাহাজান আনসারি আত্মসমর্পণ করছেন বলে দীর্ঘসময় কক্সবাজারবাসীর মধ্যে নানা গুঞ্জন চলছিল। গতকাল তার আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সেটি সত্যি প্রমাণ হল।