বজ্রপাতে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে

10

কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম

কিছুদিন আগে সিরাজগঞ্জে একইসময়ে বজ্রপাতে নয়জনের মর্মান্তিকভাবে মৃত্যু হয়। যেখানে একই পরিবারের তিন সদস্যও ছিল। এর কয়েকদিন পর মুন্সিগঞ্জে একই সময়ে বজ্রপাতে তিন শিশু নিহত হয়। যারা একে অপরের খালাতো ভাই-বোন ছিল। এভাবে বাড়ছে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার। পরিণত হচ্ছে জাতীয় সমস্যায়। প্রায় প্রতি বছরই বজ্রপাতে মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যার উদ্বেগজনক পরিস্থিতির অবসান হয়নি। কারণ, দেশে এখনো বছরে প্রায় দেড় শ মানুষের মৃত্যু হয় বজ্রপাতে। আর মারা যাওয়াদের প্রায় ৭০ শতাংশ কৃষক। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে বজ্রপাতের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। এটি জলবায়ুগত এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদানের পরিবর্তনের ফল। অন্য যে কোনো দুর্যোগের চেয়ে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুহার দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু প্রতিনিয়ত এমন মৃত্যু কাম্য হতে পারে না। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এক দশকে মোট ২ হাজার ৭৮৫ জনের বজ্রপাতে মৃত্যু হয়। আর আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যে, বজ্রপাতের কারণে বছরে গড়ে দেড় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরামের তথ্যে, চলতি এপ্রিলের ২০ তারিখ পর্যন্ত বজ্রপাতে ২০ জনের মৃত্যু হয়।
২০২০ সাল থেকে দেশে বজ্রপাতের ভয়ঙ্কর রূপ দেখা দিয়েছে। সাধারণত এপ্রিল মাসকে বজ্রপাত শুরুর মাস হিসাবে ধরা হয়। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বজ্রপাত হয়। কিন্তু ২০২০ সালের এপ্রিল মাসেই বজ্রপাতে মারা গেছে কমপক্ষে ৭০ জন। যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় চার গুণ। গত বছরের ৬ জুন রোববার বজ্রপাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে মোট ১৭ জন মারা গেছেন। বজ্রপাতের ক্ষেত্রে একটি অস্বাভাবিক বছর ছিল ২০১৬ সাল। ওই বছর প্রায় ৪৩ লাখ বজ্রপাত হয়। মারা যান প্রায় ২৬৩ জন মানুষ।
বৃষ্টিবাদলের দিনও মানুষকে কাজে বের হতে হয়। কোন উপায় থাকেনা। বিশেষ করে যারা ক্ষেতে-খামারে কাজ করেন তারাই বেশি বজ্রপাতের শিকার হচ্ছে। এমনিতে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবণ দেশ। এখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ইতিপূর্বে বহু মানুষ মারা গেছে। গরুছাগলসহ বহু প্রাণিও মৃত্যুমুখে পতিত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মানুষের ঘরবাড়ি। এখন নতুন করে বজ্রপাতের কারণে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। এই দুর্যোগ মোকাবেলায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সতর্ক, সচেতনতা। পাশাপাশি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। মানুষের মাঝে বজ্রপাতের কারণ ও তা থেকে বেঁচে থাকার বিষয়ে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। বজ্রপাত প্রতিরোধে ব্যাপকহারে তালগাছ লাগানোর পাশাপাশি আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি কাজে লাগাতে হবে। আকাশে মেঘ দেখলেই ভয় লাগে। কখন আবার বজ্রপাত শুরু হয়। একসময় দেখতাম বর্ষাকালে বজ্রপাত ও বাতাসবিহীন ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভিজত গোটা জনপদ। নির্ভয়ে মানুষ চলাচল করত। প্রয়োজনীয় কাজে মানুষ নি:সংকোচে বের হত। এখন দেখি বর্ষাকালেও বজ্রপাতযুক্ত বৃষ্টি হয়। বের হতে ভয় লাগে। আমি মনে করি, প্রকৃতির এমন আচরণ আমাদের হাতে পরিবেশ নষ্ট হওয়ার কারণেই। আমরাই ডেকে আনছি দুর্যোগ, সংকট। এ থেকে বাঁচার উৎকৃষ্ট উপায় আমাদেরকেই বের করতে হবে। নয়তো সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। আমাদের পরবর্তি প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে পারবোনা বেঁচে থাকার জন্য উপযুক্ত একটি পৃথিবী। বজ্রপাত থেকে বেঁচে থাকার জন্য কিছু উপায় বাতলে দিয়েছে স্বাস্থ্যঅধিদপ্তর। যেমন-বজ্রঝড় সাধারণত ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ মিনিট স্থায়ী হয়। এ সময়টুকু ঘরে অবস্থান করুন। অতি জরুরি প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যেতে হলে রাবারের জুতা পরে বাইরে যাবেন, এটি বজ্রঝড় বা বজ্রপাত থেকে সুরক্ষা দেবে।
বজ্রপাতের সময় ধানক্ষেত বা খোলামাঠে যদি থাকেন তাহলে পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙুল দিয়ে নিচু হযে বসে পড়তে হবে।
বজ্রপাতের আশংকা দেখা দিলে যত দ্রæত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। ভবনের ছাদে বা উঁচু ভূমিতে যাওয়া উচিত হবে না।
বজ্রপাতের সময় যে কোন ধরনের খেলাধুলা থেকে শিশুকে বিরত রাখতে হবে, ঘরের ভেতরে অবস্থান করতে হবে।
★ খালি জায়গায় যদি উঁচু গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি, ধাতব পদার্থ বা মোবাইল টাওয়ার থাকে, তার কাছাকাছি থাকবেন না। বজ্রপাতের সময় গাছের নিচে থাকা বিপজ্জনক ।
★ বজ্রপাতের সময় ছাউনিবিহীন নৌকায় মাছ ধরতে না যাওয়াই উচিৎ হবে। সমুদ্রে বা নদীতে থাকলে মাছ ধরা বন্ধ রেখে নৌকার ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে।
★ যদি কেউ গাড়ির ভেতর অবস্থান করেন, তাহলে গাড়ির ধাতব অংশের সাথে শরীরের সংযোগ রাখা যাবে না।
আসুন, আমরা বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে সতর্ক ও সচেতন হই। মেনে চলি প্রয়োজনীয় নির্দেশনা।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট