ফেরদৌস উদ্দিন আহমদ চৌধুরী অকুতোভয় এক বীর মুক্তিযোদ্ধার গল্প

19

 

‘মুুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাবা কি করেছিলেন তা অন্যের মুখে শুনেছি, শহীদ মুুরিদুল আলম কাকা, শওকত ভাই (ফুফাতো ভাই) খোরশেদ ভাই এদের দেশের জন্য যুদ্ধ করার গল্পগুলো কল্পকাহিনীর মতো মনে হতো। বাবার জমিদারির টাকা দিয়ে অস্ত্র কেনা, সেই জের ধরে হানাদার বাহিনী পেট্রোল দিয়ে বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া, বাবাকে না পেয়ে দাদাভাইকে ভীষণ মারধর, ফুফুদেরকে গোলঘরের নীচে মাটির ঘরে লুকিয়ে রাখা,…আরও কত গল্প…. এতো গেলো যুদ্ধের কথা… বাবার দেশপ্রেম ও আদর্শের দৃঢ়তা আমরা নিজেরাই দেখেছি। মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার সময়ই বিসিএস পরীক্ষার তারিখ পড়ে গেলো। সেই বার পড়ার সময় রেগে গিয়ে বাবাকে বলেছিলাম এতো যে দেশ দেশ করো, মুক্তিযুদ্ধ করেছো এখনো কোনো মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুদের জন্য, তাদের পরিবারের জন্য নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করো, কই মুক্তিযোদ্ধার একটা সার্টিফিকেট নিতে পারলানা, যদি ওটা থাকতো আমি কোটা ব্যবহার করতে পারতাম। বাবার মুখটা অন্ধকারে ছেয়ে গেলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেছিলেন ‘যুদ্ধ করে সার্টিফিকেট নিবো, আবার সেই সার্টিফিকেট ব্যবহার করে সুবিধা নেবো এটা কখনো চিন্তাই করিনি’। বাবা কিছু করতে পারুক আর না পারুক, তিনি পাঁচটি দেশপ্রেমিক সন্তান দিয়ে গেছেন বাংলাদেশকে। আমি সার্টিফিকেটহীন মুক্তিযোদ্ধা বাবার কন্যা হয়েই গর্বিত’।
২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল নিজের ফেইসবুক টাইমলাইনে বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবার প্রতি মেয়ে মনিরুন ফেরদৌস চৌধুরীর আবেগাপ্লুত স্মৃতিচারণ ছিলো এমনিই। জমিদার বংশের সন্তান হয়েও যিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের মতো, মিশতেন সাধারণ মানুষের সাথে। বীর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌস উদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী আনোয়ারার বরুমছড়া ইউনিয়নের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৪ সালের ২১ আগস্ট। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। আনোয়ারা, বাঁশখালী ও পটিয়া থানার বিভিন্ন অপারেশনে তিনি অংশ নেন। যুদ্ধকালীন তাঁদের গ্রæপ কমান্ডার ছিলেন কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিচ। সেক্টর নম্বর -১ এ অংশ নেয়া এ বীর মুক্তিযোদ্ধা সাতকানিয়ার বিভিন্ন এলাকা চ‚ড়ামনি, দোহাজারী, জাফরাবাদ এলাকায় গেরিলা যুদ্ধে অংশে নেন।
‘উনি ছিলেন নির্লোভ মানুষ। সম্পদের প্রতি তাঁর কোনো লোভ ছিলোনা। সবসময় মানুষের উপকার করতেন। বরুমছড়া ফোরকানিয়া মাদ্রাসা ও স্কুলের জন্য তিনি জমি দান করেছিলেন। জুইদÐি ইউনিয়ন হাইস্কুলের জন্য জায়গা দান করে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন স্কুল। ১৯৯১-৯২ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিভাগের চেয়ারম্যান সমিতির সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯৩-৯৪ সালে চট্টগ্রাম বিভাগীয় চেয়ারম্যান সম্মেলনে উনি নেতৃত্ব দেন।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌস উদ্দিন চৌধুরী সম্পর্কে বলতে গিয়ে নিজের প্রতিক্রিয়া এভাবেই জানালেন তাঁর সহধর্মিনী, দক্ষিণ জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও জেলা পরিষদের সদস্য রেহেনা ফেরদৌস চৌধুরী।
দেশপ্রেমিক এ বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন রাজনীতি সচেতনও। ব্যক্তিগত এক প্রবন্ধে তিনি তার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে ,‘ মুরিদ ভাই (শহীদ মুরিদুল আলম) আমার চাচাতো ভাই। তার চেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে তিনি আমাকে রাজনীতি শিখিয়েছেন, রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধু করেছেন। আমি জমিদার বংশের সন্তান; আমার দাদা, বাবা জমিদারি করতেন। আমিও সেই পরিবেশে বেড়ে উঠি। কিন্তু মুরিদ ভাই আমার মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত করে আমাকে রাজনীতির মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন’।
ফেরদৌস উদ্দিন আহমদ চৌধুরী এভাবেই এসেছিলেন রাজনীতিতে। আনোয়ারার বরুমছড়া ইউনিয়নের জমিদার বাড়ির রাজনীতি সচেতন যুবক ফেরদৌস উদ্দিন চৌধুরী অংশ নেন একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধে। তাঁর বর্ণনায়, ‘১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চের পর মুরিদ ভাই কেশুয়ায় তার গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। এরপর এক বৈঠকে তিনি আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আমাদেরও এই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। তৈলারদ্বীপে আব্দুল লতিফ নামে বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার মেজর ছিলেন। আমি সুবেদার লতিফের সাথে যোগাযোগ করে মুরিদ ভাইয়ের কথা বললাম। তিনি আমাদের প্রস্তাবে রাজি হলেন। এরপর আমাদের ট্রেনিং শুরু হলো।
জুন মাসে আমারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাঁশখালীর সাধনপুর রাজাকার ক্যাম্পে অপারেশন করি, সাহেবের হাটের পূর্ব পাশে বীজ গুদামে রাজাকার ক্যাম্প ছিলো। এই অপারেশনে তিনজন রাজাকার মারা যায়। আমাদের কমান্ডার সার্জেন্ট মহিআলম এই অপারেশনে শহীদ হন। রাজাকারেরা আমার বাড়ি আক্রমণ করে আমার পিতা কবির আহমদ চৌধুরীকে ধরে কমিউনিটি সেন্টারে নিয়ে যায়। তারা আগুন লাগিয়ে আমার বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। কোনো এক শুক্রবার বাজারের দিন আমরা তিন চার গ্রæপের প্রায় ৭৫ জন মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার আবদুল লতিফের নেতৃত্বে রুস্তমহাট অপারেশন করি। এই অপারেশনে ২জন রাজাকার নিহত হয়।
সহযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী যা বললেন:-
‘সেদিন ছিলো শুক্রবার। ১৯৭১ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি সময় আমি, ফেরদৌস উদ্দিন চৌধুরী, আবদুর রহিম, আবদুল হক, আবু নসর চৌধুরী রুস্তম হাট বাজারে অপারেশন শুরু করি। বটতলীর সুরমা পুুকুর পাড়ে সেই সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রুস্তম। রুস্তম হাটের সেই অপারেশনে আমাদের হাতে ৮ জন রাজাকার নিহত হন। পরে তাদের লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিলো’।
২০২১ সালের ১১ ডিসেম্বর মধ্য দুপুরে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী তাদের যুদ্ধ দিনের গল্প শোনাচ্ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌস উদ্দিন চৌধুরীর বাড়ির পুকুর ঘাটে বসে। সামাজিক উন্নয়ন কর্মকান্ড ফেরদৌস চৌধুরীর ভ‚মিকা নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, বরুমছড়ার এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারের এ সন্তান স্বাধীনতা পরবর্তীতে আনোয়ারা ৫ নম্বর বরুমছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। এলাকার রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্কুল সংস্কার করেছেন তিনি, দুস্থদের অকাতরে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। তিনি ছিলেন একজন পরিপূর্ণ সমাজহিতৈষী। ফেরদৌস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর বাবা কবির আহমদ চৌধুরী স্কুল মাদ্রাসার জন্য অনেক জমি দান করেছেন। বংশপরম্পরায় ফেরদৌস উদ্দিনও মানুষকে অকাতরে দান করতেন। ২০১৫ সালের ২৯ আগস্ট এ বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুবরণ করেন।
লেখক: প্রাবন্ধিক