ফুলে গন্ধ নেই

16

মুশফিক হোসাইন

এই মুহূর্তে ফিলিস্তিন কবি গায়থ আলমাধুন এর কথা মনে পড়ে গেল। যিনি দামেস্কের এক ফিলিস্তিন শরণার্থী শিবিরে জন্মনেন। বর্তমানে তিনি বার্লিন প্রবাসী। তিনি তাঁর কবিতায় প্রত্যাশা করেন যে, ‘এই দুনিয়া যদি ভার্চ্যুয়াল হতো’। এ উপসম্পাদকীয় লেখার পূর্বে কবির ‘যুদ্ধ শেষ’ কবিতার একটি চরণ উল্লেখ করতে চাই’। আর আমি আমার ভাইয়ের কবরে যে প্লাস্টিকের গোলাপ রেখে এসেছিলাম / সেটা প্রাণ পেয়ে জেগে উঠত। / যুদ্ধ শেষ, যে বন্ধুরা তাজা মৃত্যু কেনার জন্য বাজারে গিয়েছিল, তারা পথিমধ্যে নিহত হয়েছে’।
বস্তুত : মানবজীবন ভার্চ্যুয়াল নয়, অর্থাৎ অর্থিব নয়। জীবন পার্থিব। অতএব প্লাস্টিকের গোলাপ প্রাণ পেতে পারে না। তথাপি প্রাণহীন, গন্ধহীন ্ ইে প্লাস্টিকের ফুলের জন্য আমরা বাঙালিরা উদগ্রীব। সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে পাড়া মহল্লার অনুষ্ঠানাদিতে প্লাস্টিকের ফুল যথেচ্ছভাবে ব্যবহার হচ্ছে। স্বাধীনতা উত্তর সময়ে কাগজের ফুলের প্রচলন ছিল। তখন কাঁচা ফুলের চাষ ও উৎপাদন ছিল সীমিত। ফলে চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কাগজের ফুলের প্রচার ও প্রসার ঘটে। এতেকরে দেশে একটি কুটির শিল্প গড়ে উঠে। সাথে সাথে কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হয়। বিশে^ কাঁচা ফুলের চাষ সম্ভবত প্রাথমিক কৃষি যুগে শুরু হয়ে থাকতে পারে। তবে কখন কাঁচা ফুলের বাণিজ্য ব্যাপকতা লাভ করে তার সঠিক তথ্য এ মুহূর্তে জানা নেই।
মানব জীবনে ফুলের গুরুত্ব অপরিসীম। ফুল মানব মনের চাহিদা ও সৌন্দর্য পিপাসা পূরণ করে থাকে। ফুলের ¯িœগ্ধতা ও সৌরভ প্রকৃতি ও পরিবেশকে বিশুদ্ধ ও মোহনীয় করে তোলে। ঘর সাজানো বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি এবং নারীদের সাজসজ্জায়ও কাঁচা ফুলের কদর অনেক অনেক বেশি। এই ফুলের চাহিদাকে কেন্দ্র করে এক দেশ থেকে অন্যদেশে কাঁচাফুল রপ্তানি বাড়তে থাকে। কাঁচাফুল হয়ে উঠে অর্থকরী শস্য। আর্থিক লাভের কথা চিন্তা করে এবং চাষাবাদ বিশে^ বেড়েই চলেছে। ফুল রপ্তানি বাড়তে আধুনিক সংরক্ষণাগার যেমন গড়ে উঠেছে। তেমিন ফুল রপ্তানির জন্য কতিপয় নীতিমালাও প্রণীত হয়েছে। বিশে^ ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ১৬ হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। ইউরোপীয় দেশগুলোতে ফুলের চাহিদা ব্যাপক। বিশে^ ফুল রপ্তানিতে নেদারল্যান্ড শীর্ষে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ফুল চাষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। তার সূত্র ধরে বাংলাদেশের কাঁচাফুল মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, ব্রিটেন, পাকিস্তান, ভারত ইতালী, কানাডা, চিন, সিঙ্গাপুর রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সে স্বল্প পরিমাণে রপ্তানি হচ্ছে। এটি একটি আশার আলো হয়ে রপ্তানি বাণিজ্য পথ দেখাবে।
‘ জোটে যদি মোটে একটি পয়সা-খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি/দু’টি যদি জোটে অর্ধেক তার ফুল কিনে নিও, হে অনুরাগী’ এই অমিয় বাণীর কথা আমরা বাঙালিরা ভুলে যাচ্ছি। যাচ্ছি না বলে বংলা যেতে পারে ভুলেই গেছি। আর তা না হলে সমাজের সর্বস্তরে প্লাস্টিকের ফুলের এতো রমরমা প্রচলনও ব্যবস্থা কিভাবে সম্ভব। হয়ত একারণেই বাঙালি এক কবির লিরিকটি এতো জনপ্রিয়তা পেত না। লিরিকটি উদ্ধৃতি করা যাক ‘ফুলে গন্ধ নেই এতো ভাবতেও পারি না / সুরে ছন্দ নেই এতো ভাবতেও পারি না’ বস্তুত : প্লাস্টিকের ফুলে গন্ধ নেই। আমাদের সমাজের ছন্দপতনও হচ্ছে। যা আমরা বিস্তৃত হয়ে ভাবতে পারছি না।
এক তথ্যে জানা যায় যে, থার্টিফার্স্ট নাইট উপলক্ষে চট্টগ্রামে ফুল বিক্রির লক্ষমাত্রা ছিলো দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার। যার একটি বৃহৎ অংশ প্লাস্টিকের ফুল দখল করে আছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, স্বাধীনতা উত্তর গত পঞ্চাশ বছরে দেশে ফুলের ব্যবহার বেড়ে যায়। যার প্রেক্ষিতে দেশে ফুল চাষ ও বিপণন বাড়ে ৯৮শতাংশ। বাণিজ্যিকভাবে ফুলচাষও বিপণন জনপ্রিয়তা লাভ করে। সূত্র থেকে জানা যায় যে, দেশে ১৫০০ থেকে ২০০০ কোটি টাকার ফুলের চাহিদা দেখা দেয়। এই চাহিদা কৃষক ও ব্যবসায়ী সমাজকে উদ্বুদ্ধ করে। দেশে সবজী চাষের পাশাপাশি ফুল চাষ গুরুত্ব লাভ করে। একই ভাবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ফুলের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে। এতে করে একটি বৃহৎ জনসংখ্যা ফুল চাষ ও বিপণনে যুক্ত হয়ে অনুকূল কর্মসংস্থান গড়ে তোলে। এ ছাড়াও আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন একটি পণ্য যুক্ত হয়। ফুল চাষের ফলে প্রাকৃতিকে উপকারী কীট পতঙ্গ এবং বাস্তুতন্ত্রের জন্য সহায়ক হিসাবে ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশের আবহাওয়ার সাথে দেশি-বিদেশি ফুলের একট্ িউন্নত জাত সৃষ্টি হয়। বিদেশি অনকে ফুল এখন দেশে উৎপাদিত হয়। তারপরও বিদেশ থেকে সীমিত পর্যায়ে ফল আমদানী করতে হয়।
বাণিজ্যের এই সুযোগকে কাজে লাগাতে মুনাফালোভী কর্পোরেট হাউসগুলো এবং স্বার্থান্বেষি মহল চীন থেকে সস্তা ও গন্ধহীন প্লাস্টিকের ফুল দিয়ে বাজার সয়লাভ করে দেয়। এই মহল দেশের কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা না করে দেশের সম্ভাবনাময় একটি খাত ধ্বংস করার পাঁয়তারা করছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে সুবিধাভোগী আমলাও সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব ছাত্র সমাজের অনৈতিক একটি অংশ। ফলে দেশের উচ্চ পর্যায় থেকে নি¤œ পর্যায়ের সর্বস্তরের আচার অনুষ্ঠানাদিতে দেখে যাচ্ছে প্লাস্টিকের ফুলের রমরমা কারবার। আমাদের আনন্দ উল্লাস এবং শব যাত্রায় আজ ব্যবহৃত হচ্ছে সস্তা গন্ধহীন বর্ণিল প্লাস্টিকের ফুল।
প্লাস্টিক আমাদের প্রকৃতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে বিবেচিত হচ্ছে। আমাদের মাটির উর্বরতা শক্তির অত্যন্ত ক্ষতিকর এই পদার্থ। এছাড়াও নদী, খাল বিল ধ্বংসের অন্যতম কারণও বটে। সর্বোপরি আমাদের বাস্তুতন্ত্রের সকল জীবের জন্য মৃত্যুর কারণও বটে। উন্নত বিশে^ যেখানে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ হচ্ছে, সেখানে দেশের প্লাস্টিকের রমরমা ব্যবসা ও ব্যবহার আগামী প্রজন্মের অস্তিত্বের জন্য চরম হুমকীর কারণ হয়ে দেখা দেবে। অতএব এই মুহূর্ত থেকে প্লাস্টিকের ফুলের বিপণন নিষিদ্ধ করা হোক। আসুন আমরা সকলে প্লাস্টিকের ফুলকে না বলি।
লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব)