ফায়ার হাইড্রেন্টের জন্য অধীর অপেক্ষা

46

তুষার দেব

ধারাবাহিকভাবেই প্রাকৃতিক জলাধার বা পানির উৎস কমে যাওয়ায় নগরীতে অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে বিকল্প হিসেবে স্ট্রিট ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানোর প্রকল্প চলমান থাকলেও সেগুলোতে এখনও পানির সংযোগ দেয়া যায় নি। এ কারণে কোথাও অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলে আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্মীদের এখনও নিকটবর্তী প্রাকৃতিক পানির উৎসের উপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। তবে ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানোর কাজ সুসম্পন্ন হলে অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে বিকল্প উৎস থেকে পানিপ্রাপ্তি সুনিশ্চিত হবে বলে আশা করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।
এর মধ্যে নগরীতে অগ্নিদুর্ঘটনার প্রাণ ও সম্পদহানি কিছুতেই রোধ করা যাচ্ছে না। সর্বশেষ গত ১৮ মে নগরীর ইপিজেডের কলসি দীঘির পাড়ের ধুমপাড়া এলাকায় আগুনে পুড়ে মারা গেছেন আব্দুল করিম হাওলাদার নামের প্রায় শতবর্ষী এক বৃদ্ধ। তিনি অন্ধ ছিলেন। ওই আগুনে পুড়েছে ৬৪টি আধপাকা ও কাঁচা দোকান এবং সাতটি বসতঘর। আগুনে পুড়ে যাওয়া ঘরগুলোর একটির ভেতরে ঘুমিয়েছিলেন মারা যাওয়া আব্দুল করিম হাওলাদার। ওইদিন সকাল ১১টার দিকে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। বসতঘরের রান্নার চুলা থেকেই এ অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত। আগুনে ২৫ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং ৫০ লাখ টাকার মালামাল উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস।
আগ্রাবাদ বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা কপিল উদ্দিন বলেন, রান্না ঘরের চুলা থেকেই মূলত আগুনের সূত্রপাত। সকালের ওই আগুনে দৃষ্টিশক্তিহীন এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। তিনি ওই এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা। ঠিকমত চলাফেরওা করতে পারতেন না বলে জানতে পেরেছি। প্রায় দেড় ঘন্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। তবে সেখানে কোনও ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবহারের সুযোগ ছিল না। আগুনে বিভিন্ন ধরনের ৬৪টি দোকান ঘর পুড়ে গেছে। এতে আনুমানিক ২৫ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আরও ৫০ লাখ টাকার মালামাল আমরা উদ্ধার করতে পেরেছি। আমরা দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই দৃষ্টিশক্তিহীন আব্দুল করিম হাওলাদার অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান।
এর আগে গত ১১ মার্চ শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে নগরীর অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ জহুর হকার্স মার্কেটে ৭০টি দোকান আগুনে পুড়ে যায়। অগ্নিকান্ডের খবর পেয়ে দ্রুতই সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন ফায়ার সার্ভিসের ৯টি ইউনিটের কর্মীরা। কিন্তু আগুন নেভাতে গিয়ে রিজার্ভার ট্যাংকের পানি শেষ হয়ে গেলে বিপাকে পড়েন তারা। মার্কেটের আশপাশে নেই কোনও ফায়ার হাইড্রেন্ট। দুর্ঘটনাস্থল থেকে ৭০০ মিটার দূরে লালদীঘি মসজিদের পুকুর থেকে পানি এনে আগুন নেভানো হয়। অথচ, ওই মার্কেটে আগুন লাগার পর নন্দনকানন, আগ্রাবাদ ও চন্দনপুরা থেকে তাদের তিনটি ইউনিটের নয়টি অগ্নিনির্বাপক গাড়ি নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে কর্মীরা আগুন নেভাতে কাজ শুরু করেন। রাত সোয়া ১০টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক ফারুক হোসেন শিকদার বলেন, শহরের ভেতর আগুন নেভাতে গিয়ে পানির উৎসের জন্য প্রায়ই দিশেহারা অবস্থা হয় ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের। এতে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় বেশি লাগে, পাশাপাশি আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বেড়ে যায়। চার দশক আগে নগরীর ২৪ হাজার পুকুর, দীঘি, জলাশয় ও জলাধার ছিল আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের পানির উৎস। দখলে-দূষণে এখন বিলুপ্ত পানির এসব উৎস। বিকল্প উৎস ফায়ার হাইড্রেন্ট। এগুলো বসানোর পাশাপাশি সেগুলোতে ওয়াসার পানির লাইনের সংযোগ দেয়ারও কাজ চলছে।
তিনি জানান, আগুন নেভাতে পানি সরবরাহের জন্য নগরজুড়ে বসানো হচ্ছে একশ’ ৭৪টি ফায়ার হাইড্রেন্ট। এগুলোয় জিপিএস সুবিধা সংযুক্ত থাকবে। ফলে আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিস সবচেয়ে কাছের ফায়ার হাইড্রেন্ট শনাক্ত করতে পারবে। দুটি প্রকল্পের আওতায় এসব আধুনিক ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। ইতোমধ্যে একটি প্রকল্পের আওতায় ৩০টি ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানোর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। অন্য প্রকল্পের একশ’ ৪৪টির মধ্যে ৯৬টি হাইড্রেন্ট স্থাপনের কাজ শেষ। চলতি বছরের অক্টোবরের মধ্যে বাকিগুলো বসানোর কাজ সম্পন্ন হবে। ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীতে আগুন নেভাতে পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলো সীমিত হয়ে এসেছে। অগ্নিকান্ডে সময় পানির জন্য আশপাশে কোনও পুকুর বা জলাশয় খুঁজে পাওয়া যায় না। ফায়ার হাইড্রেন্টগুলো স্থাপন হলে দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। স্বস্তি মিলবে ফায়ার ফাইটারদেরও।
ওয়াসা সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনের জন্য ৮৬টি স্থান নির্ধারণ করে নক্শা প্রণয়নের জন্য ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সকে চিঠি দেয় ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। এর ভিত্তিতে দুটি প্রকল্পের অধীনে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ‘চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ ইমপ্রুভমেন্ট ও স্যানিটেশন প্রকল্পের’ অধীনে ২০১৮ সালে শহরে ৩০টি ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনের কাজ অব্যাহত রয়েছে। এগুলো কার্যকর করার কাজও এগিয়ে চলেছে। ২০১৯ সালে কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প-২-এর অধীনে আরও একশ’ ৪৪টি ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনের উদ্যোগ নেয় চট্টগ্রাম ওয়াসা। এই প্রকল্পের আওতায় নগরীতে সাতশ’ কিলোমিটার পাইপলাইন নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হচ্ছে। পাইপলাইন স্থাপনের কাজ চলতি বছরের অক্টোবর নাগাদ শেষ হবে। এই পাইপলাইনের সঙ্গেই সংযোগ দেয়া হচ্ছে ফায়ার হাইড্রেন্টগুলোর। দুই প্রকল্পে একশ’ ৭৪টি ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনে দুই কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে।
ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা নিজেদের উদ্যোগে দুটি প্রকল্পের অধীনে একশ ৭৪টি ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। অধিকাংশ হাইড্রেন্ট স্থাপন ও সেগুলোর কমিশনিং-এর কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। যে কোনও সময় হাইড্রেন্টগুলো ফায়ার সার্ভিসকে বুঝিয়ে দেয়া সম্ভব হবে বলে তারা আশা করছেন।