প্রাথমিকে ছুটিহরণ ও বিবিধ বৈষম্য পুরো রমজান মাস ছুটির দাবি

41

লিটন দাশ গুপ্ত

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা, শৈশবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হতে চেয়েছিলেন। তাঁর একাধিক বক্তব্য থেকে আমরা এমনটাই জেনেছি। প্রাথমিক শিক্ষায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ ও বহুমুখী উন্নয়ন, তাঁর আন্তরিকতা ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এখানে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের পর, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৬ হাজারের বেশী কমিউনিটি, রেজিস্টার্ড বেসরকারি স্কুল জাতীয়করণ করে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন কেবল তা নয়, প্রতিটি অর্থবছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন অভৌত সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরী কাম প্রহরী নিয়োগ দেয়া হয়েছে, দেশের ভিতরে এবং দেশের বাইরে শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বিভিন্ন বিদ্যালয়ে অসংখ্য পদ সৃষ্টি করে প্রায় প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। প্রধানশিক্ষক পদ দ্বিতীয় শ্রেণি ঘোষণা ও সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল উন্নীতকরণ ইত্যাদিসহ আরো অনেক পরিবর্তন এনেছেন। এছাড়া সাফল্য ও উন্নয়নে দেখা যায়- ভর্তির হার বৃদ্ধি, ঝরেপড়া রোধ, শতভাগ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি প্রদান, ছাত্রছাত্রীর সমতা আনায়ন, বছরের প্রথমদিন নতুন বই প্রদান, বিভিন্ন এলাকায় মিডডে মিল প্রচলন, প্রায় প্রতিটি বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ কম্পিউটার, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ইন্টারনেট সংযোগ ইত্যাদি আরো কতকি! এখানেই শেষ নয়, এখনো প্রত্যেক বছর ছোট বড় অনেক প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই সকল গৃহীত পদক্ষেপ বা অসামান্য অবদানের কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যুগ যুগ ধরে থাকবেন প্রাথমিক শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গে মনের গহীন মনিকৌঠায়। কিন্তু এতসব সত্তে¡ও গৃহীত কিছু সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায়, শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি না পায়নি। যারফলে সমাজের ভিতরে বাইরে এমনকি দেশের একশ্রেণির মানুষের কাছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এখনো ‘প্রায়মরি ইস্কুলর মাস্টর’ হিসাবে পরিচিত ও পরিগণিত হচ্ছে! তাই নিরীহ ‘প্রজাতি’র প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষককে ঐ শ্রেণির মানুষ ‘প্রায় মারি-মারি’ ভাব প্রদর্শন করতে থাকে, অন্যদিকে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকগণ ‘প্রায় মরি-মরি’ ভাব অনুভব করতে থাকে! এই পরিস্থিতিকে অনেকেই মনে করেন, সরকারের কোন একস্তরে লুকিয়ে থাকা, দেশ ও সরকার বিরোধী তথা স্বাধীনতাবিরোধী বা তাদের পোষ্য ও দোসররা, লক্ষ-লক্ষ প্রাথমিক শিক্ষকের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ করে, শিক্ষক ও সরকারের মধ্যে এক প্রকার তিক্ত মনোভাব সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরা একেক সময় একেকটি ঋণাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে, যাতে বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়ে সরকারের ভাবমূর্তিক্ষুন্ন হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্রধানশিক্ষকের দ্বিতীয় শ্রেণি বা দশম গ্রেড দশ বছরের বাস্তবায়ন হয়নি, প্রধানশিক্ষকদের পদোন্নতির কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি, কিছুদিন আগে যে খসড়া নীতিমালা একটা প্রণয়ন করা হয়েছে বলে শুনেছি, সেখানেও নাকি ৪৫ বছরের উর্ধ্বে প্রধানশিক্ষক পদোন্নতির বাদ দেয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। আবার বিভিন্ন প্রশিক্ষণও ৪০ বা ৪৫ বছর উর্ধ্বে শিক্ষককে প্রশিক্ষণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এইদিকে ’১৫ সালের জাতীয় পে-স্কেল অনুযায়ী শিক্ষকদের ১০ বছর পর বা ৬ বছর পর প্রথম দ্বিতীয় টাইমস্কেল বা উচ্চতর গ্রেড বিভিন্ন অজুহাতে প্রদান করা হচ্ছেনা। এই রকম আরো কত সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, নতুন শিক্ষাক্রমে (২০২৩ সাল থেকে শুরু হওয়া শিক্ষাক্রম) সকল স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুদিন করার প্রস্তাব ছিল। এই শিক্ষাক্রমের সারসংক্ষেপ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অভিমুখে উপস্থাপনের সময় দেখা গেল- বিশ্ববিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, উচ্চবিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কারিগরি বিদ্যালয়, মাদ্রাসাসহ সকল প্রকার বিদ্যালয়ে শুক্রবার শনিবার এই দুইদিন সাপ্তাহিক সরকারি ছুটি রাখা হয়। অন্যদিকে প্রাথমিকে ছুটি রাখা হয়েছে কেবল শুক্রবার একদিন। বিষয়টিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। অবশেষে তিনি প্রাথমিকেও দুইদিন ছুটি রেখে সংশোধন করে আনার নির্দেশ প্রদান করেন। অতঃপর প্রাথমিকেও সাপ্তাহিক দুইদিন ছুটি কার্যকর করতে বাধ্য হয়। আবার সাপ্তাহিক ছুটি দুইদিন করা হলেও চলতি বছরের এই ছুটির তালিকায় দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত সকলস্তরের মধ্যে সবচেয়ে কম ছুটি রাখা হয়েছে প্রাথমিকস্তরের ছুটির তালিকায়। এখানে দেখা যায়, কলেজে ছুটি ৭১ দিন, উচ্চবিদ্যালয়ে ৭৬ দিন, নি¤œমাধ্যমিকে ৭৬ দিন, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৮০ দিন। কিন্তু প্রাথমিকে মাত্র ৫৪ দিন। এইদিকে পবিত্র মাহে রমজান শুরু হতে হচ্ছে ২৪ মার্চ ’২৩ ইং তারিখ থেকে। অন্য সকল প্রকার বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী পুরো রমজান মাস ছুটিতে থাকলেও প্রাথমিকে স্কুল খোলা রাখা হয় ০৬ এপ্রিল পর্যন্ত অর্থাৎ ১৪ রমজান পর্যন্ত। আর যদি ২২ মার্চ শাবান মাস শেষ হয়, তাহলে ২৩ মার্চ থেকে রমজান শুরু হবে এবং ১৫ রমজান পর্যন্ত কেবল প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা থাকবে। এই অবস্থায় দেখা যাবে পরিবারের বড় ছেলে বা মেয়েটি রোজা রেখে ঘরে ছুটি কাটাবে, অন্যদিকে ছোট ছেলে বা মেয়েটি রোজা রেখে স্কুলে যাবে। বিষয়টিতে অভিভাবকও অসন্তুষ্ট থাকবে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের বিদ্যালয়ে ছুটি সমন্বয়ে সমস্যা সৃষ্টি হবে। যেমন- অনেক সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে সংযুক্ত থাকে প্রাথমিক স্তরের বেশ কয়েকটি ক্লাস, আবার অনেকগুলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাথে সংযুক্ত আছে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত নি¤œমাধ্যমিক ক্লাসসমূহ। তারা দুইস্তরের ছুটি সমন্বয় করতে গিয়ে অবশেষে দেখা যাবে ক্লাস সমন্বয় করতে হবে।
ছুটির বিষয় যখন বলছি তাহলে আরো কিছু কথা বলতে হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছুটি হরণ ও ছুটি বৈষম্যের বিষয়টি কেবল রমজান মাসে সীমাবদ্ধ নয়। অন্য সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্মের ছুটি ১২/১৪ দিন হলেও প্রাইমারিতে ৭/৮ দিন। চলতি বছর মাধ্যমিকে শীতকালীন অবকাশ ১২ দিন আর প্রাইমারিতে বড়দিনসহ মোট ৩ দিন। এছাড়া বিভিন্ন সময় ছুটির মধ্যে দেখা যায়- ভোটার তালিকা প্রণয়ন, ভোট গ্রহণ, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, নানাবিধ শুমারি, উপবৃত্তি কার্য সম্পাদন, বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালন, সময় সময় ঘোষিত বিশেষ দিনের কার্যক্রম, নানান ধরনের তথ্য প্রেরণ ইত্যাদি কাজে ও কারণে, বার্ষিক ছুটির তালিকায় প্রদত্ত ছুটি হরণ হয়! এইদিকে প্রধানশিক্ষকের হাতে ৩ দিন ছুটি সংরক্ষিত থাকলেও প্রধানশিক্ষক সংরক্ষণ করার ক্ষমতা নেই। যার ফলে এই ছুটি ভোগ করা হয়না। আবার অনেক সময় দেখা যায় এই ছুটির কারণে শিক্ষকগণ শ্রান্তি বিনোদন ভাতা ৩ বছরের পরিবর্তে আরো অনেক দেরীতে পায়। অর্ধগড় বেতনে অর্জিত ছুটি নির্ধারণসহ এই রকম ছুটি নিয়ে আরো নানান সমস্যা রয়েছে। অথচ ভ্যাকেশনাল কর্মচারী হিসাবে শিক্ষকগণ অবসরে গেলে দেখা যায়, নন-ভ্যাকেশনাল কর্মচারীর তুলনায় আর্থিকভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
যাইহোক, আসন্ন পবিত্র মাহে রমজানে ১৫ রোজা পর্যন্ত সকলপ্রকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলেও, প্রাথমিক স্কুল খোলা রাখার বিষয়ে যা বলছিলাম। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভিন্ন ভিন্ন ছুটির কারণে একই মা-বাবার একাধিক সন্তানের ক্ষেত্রে দেখা যাবে, রোজা রেখে বড় সন্তান ঘরে থাকবে আর রোজা রেখে ছোট সন্তান বিদ্যালয়ে যাবে, যা আগেই বলেছি। এই ব্যাপারে অনেকেই বলতে পারে, প্রাথমিকের শিশু শিক্ষার্থীরা এত কম বয়সে রোজা রাখেনা। বাস্তবক্ষেত্রে দেখা যায় পবিত্র রমজান মাসে ১ম ও ২য় শ্রেণির কম সংখ্যক ছাত্রছাত্রী রোজা থাকলেও ৩য় থেকে ৫ম শ্রেণির প্রায় সকল শিক্ষার্থী সিয়াম সাধনার মাসে রোজা ব্রত পালন করে থাকে। এছাড়া রমজান মাস ইবাদতের মাস হিসাবে শিশু শিক্ষার্থীরা রোজা রাখার পাশাপাশি কোরান পড়া শিখে। বাংলাদেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ শিক্ষক ইসলাম ধর্মাবলম্বী। আবার ৬০ শতাংশ শিক্ষক মহিলা নিয়োগ করার কথা থাকলেও কোন কোন উপজেলায় ৭০-৮০ শতাংশের বেশী মহিলা। তারা পবিত্র রমজান মাসে রোজা রেখে ঘরের কাজ আর স্কুলের কাজ করতে গিয়ে চরম বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। এছাড়া পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, বিদ্যালয়ে রমজান মাসে অতি নগন্য সংখ্যক শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকে। এই অবস্থায় সামগ্রিক বিষয় বিশ্লেষণ করে, অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বয় রেখে, ছুটির তালিকা সংশোধন করে, পুনরায় পুরো পবিত্র মাহে রমজান ছুটি ঘোষণা করা হোক। এটিই সকল ছাত্রছাত্রী আর শিক্ষকশিক্ষিকার পক্ষ থেকে আজকের এই নিবন্ধের মাধ্যমে আবেদনপূর্বক দাবি জানাচ্ছি।

লেখক : সাহিত্যিক ও কলামিস্ট