প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ও প্রবেশগম্যতা

9

অধ্যাপক আয়েশা পারভীন চৌধুরী

প্রতি বছর পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে বেশ কিছু সংখ্যক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। আমাদের দেশে স্কুল কলেজগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীর পাশাপাশি কয়েকজন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীও লেখাপড়া করে। প্রত্যেকটি ধাপে ধাপে তারা সাধারণ শিক্ষার্থীর পাশাপাশি তাদের মেধা ও মননের যোগ্যতার পরীক্ষা দিয়ে আসে। এই প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা জন্মের পর থেকে পরিবারের সদস্যদের সাহায্য সহযোগিতায় এগিয়ে যায়। তবুও মাঝে মাঝে কিছুটা অবহেলা থাকে। তবুও তারা কখনো কখনো বঞ্চনার শিকার হয়। পরিবারের গÐি পেরিয়ে যখন আস্তে আস্তে বের হতে থাকে তখনি চলার পথে সমাজের অনেকের অবজ্ঞা; অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়। তবুও তারা হাটি হাটি পায়ে পায়ে এগোতে থাকে। ১; ২; ৩ করে সংখ্যা গনণা শিখে। অ; আ; ক; খ দিয়ে বাংলা বর্ণমালা পড়ে। ইংরেজি অক্ষর গুলো আস্তে আস্তে শিখতে শুরু করে। নিজ নিজ ধর্মের জ্ঞান অর্জন করে থাকে। এভাবে বয়স ও মেধার ভিত্তিতে তাদের শিক্ষা জীবন শুরু হয়। এছাড়া অন্য দশজন সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মতো তারা সুন্দর ও পরিপাটি পরিবেশে শিক্ষা জীবন শুরু করতে পারে না। তাদেরকে শিক্ষা জীবনের প্রতিটি ধাপে অনেক ধরনের অসংগতিমূলক ব্যবহারের সম্মুখীন হতে হয়। জীবনের শুরুতে কিছু কিছু আপন মানুষের স্নেহ মায়া মমতায় তাদের জীবন জড়িয়ে আছে। নিজের নাঁড়ি ছেঁড়া ধনকে কখনো কেউ অবহেলায় পড়ে থাকতে দেয় না। মা বাবা ভাই বোন তাদের সাধ্যমত সময় ও সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে আসে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবন্ধী সমাজের জন্য অনেক কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই প্রতিবন্ধী বাচ্চাগুলোকে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বনির্ভর করে তোলার জন্য আহবান জানান। বাংলাদেশ সরকারের আওতাধীনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রতিবন্ধী ভাতা চালুর মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবন কিছুটা হলেও সহনীয় করেছে। প্রতি মাসে পাওয়া এই প্রতিবন্ধী ভাতার পরিমাণ খুবই সামান্য ও খুবই নগণ্য হলেও একজন প্রতিবন্ধীর জীবন চলার পথে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ের প্রশিক্ষণ গুলো প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। শারীরিকভাবে যারা বিভিন্ন অঙ্গহানীর ফলে প্রতিবন্ধী জীবন যাপন করছে তাদের অনেকেই লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। হয়তো হাতে লিখতে পারছি না কিন্তু পায়ে লিখে লিখে অনেকেই লেখাপড়া করে যাচ্ছে। কারো হয়তো এক হাত নেই অথচ অন্য একটি হাত দিয়ে কোন মতে লেখা পড়া করছে। অথবা কারো দুই হাত নেই। পা দিয়ে লিখছে। এভাবেই তারা পরীক্ষার হলে অংশগ্রহণ করে। আবার অনেকে জন্মগতভাবে অন্ধ। পৃথিবীর সুন্দর আলো ও অপরুপ প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত। এই অন্ধ শিক্ষার্থীদের অনেকেই ব্রেইল পদ্ধতিতে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত গ্রহণ করছে। আমাদের দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে প্রতি বছর অনেক অন্ধ শিক্ষার্থী ভালো ভালো বিষয়ে শিক্ষা জীবন শেষ করছে। অনেক বোবা শিক্ষার্থী ইশারা ভাষায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে। ইশারা ভাষার মাধ্যমে অনেক শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে নিজেদের যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রমাণ করেছে। তারা যাতে চাকুরির ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পান সেই বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথাযথ নির্দেশনা দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল অটিজম আক্রান্ত বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের শিক্ষার মূল ¯্রােত ধারায় আনার জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অটিস্টিক বাচ্চাদের একটা সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবন উপহার দেওয়া জন্য সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিশেষ ভূমিকা সারা পৃথিবীতে রোল মডেল হিসেবে পরিচিত পেয়েছে।
একটা বয়সের পর যখন তারা কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের জন্য ভর্তি হতে যায় তখনি প্রাথমিকভাবে একটা বিরাট ধাক্কা আছে। বিশেষ করে স্কুল গেটে পাড় হয়ে যখন এগোতে থাকে ঠিক তখনই ইচ্ছুক চোখ গুলো যেন তাকে থামিয়ে দিতে চায়। তবুও সে হাটি হাটি পায়ে স্কুলের প্রাঙ্গণ পাড় হয়। ইস্কুলের করিডোর দিয়ে যখন অফিস কক্ষে উপস্থিত হয় তখন আসে আরেক বাধা। অনেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীরা প্রাথমিকভাবে একজন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে সহজ ভাবে নিতে পারে না অথবা তারা নিতে চায় না। মানসিকভাবে কি যেন তাদেরকে পিছনে টানে। এক সময় হয়তো সে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে ভর্তি করে। এরপর থেকে তার শিক্ষা জীবন শুরু হয়। শিক্ষা জীবনের প্রথম প্রথম একেবারে সেই শৈশবে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ ও বসার সময় আবার একটা সজোরে ধাক্কা। শ্রেণীকক্ষে অন্যান্য ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই ও স্বাভাবিকভাবে একজন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে মেনে নিতে পারে না। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে প্রতিবন্ধী সহপাঠীর দিকে। কেমন যেন একটা অনুভূতি কাজ করে তাদের মাঝে। এর মধ্যেও সান্ত¡না থেকে যায়। একজন দুইজন করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বন্ধু হয়ে এগিয়ে আসে। একজন দুইজন করে স্বাভাবিক ও সুস্থ বাচ্চাগুলো প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীটিকে আপন করে নেয়। এই চলার পথে তবুও অনেক সময় হোঁচট খেতে হয়। পড়তে পড়তে আবার নিজেকে দাঁড় করাতে চেষ্টা করে। এভাবেই শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষার্থীদের মায়া মমতা স্নেহ ভালোবাসায় শিক্ষার একটা পরিবেশ পায়। এভাবে সে তার মেধার ও যোগ্যতা পরীক্ষা দিতে দিতে প্রতিটি শ্রেণীর ধাপ পাড় হয়। এক এক সময় এক একটি পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। সম্পূর্ণ নতুন একটি পরিবেশে নতুন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে নিজেকে হয়তো মানিয়ে নিতে প্রাথমিকভাবে অনেক কষ্ট হয়। তার আশে পাশে থাকা পুরনো বন্ধু বান্ধবীরা তাকে মানসিকভাবে সাহায্য যুগিয়ে যায়। তাছাড়া পরীক্ষার হলে শিক্ষকের মানবিক আচরণ তাকে স্বাভাবিক ও সাবলীলভাবে পরীক্ষা দিতে উৎসাহ দেয়।
মাধ্যমিকের চুড়ান্ত পরীক্ষার পরে এই প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের অনেকেই আবার নতুন করে নতুন আঙ্গিকে কলেজ জীবন শুরু করে। সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে; নতুন শিক্ষক; শিক্ষার্থী ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে মানিয়ে নিতে প্রথম প্রথম তাদের বেশ কষ্ট হয়। কিছুদিন পর পুরনো কয়েক জন বন্ধু বান্ধবীদের পাশাপাশি আবার অন্যদের সাথে নতুন করে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। নতুন নতুন শিক্ষক-শিক্ষিকার সাথে নতুন করে মানবিকতা ও সহনশীলতার মনোভাবে একটি বন্ধন গড়ে তোলে। এভাবে কলেজ জীবনের অর্থাৎ একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণী পর আবার একটা পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়।
অন্য কলেজে গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে ও ভিন্ন পরিবেশে তাকে পরীক্ষার হলে পরীক্ষার জন্য বসতে। আশেপাশে কয়েক জন পুরনো বন্ধু বান্ধবীর মাঝে নতুন নতুন শিক্ষার্থীদের মাঝে নিজেকে একটু বেমানান মনে হয়। এদের মধ্যে হয়তো কয়েক জনের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে।আবার একটা মানবিক পরিবেশ তৈরি করে ফেলে। তবুও অন্য দশজনের মতো নিজেকে এক মনে করতে পারে না। সেই একই হলে একেক দিন একেক জন নতুন নতুন শিক্ষকের দায়িত্ব থাকে। দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক অথবা শিক্ষিকার মানবিক আচরণের ফলে পরীক্ষার ক্ষেত্রে একজন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী মানসিকভাবে নিজেকে মানিয়ে নেয়। এভাবে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হয়তো অন্য আর দশজন স্বাভাবিক শিক্ষার্থীদের মত সব বিষয়ে এবং সব ক্ষেত্রে নিজেদের যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিচয় দিতে পারে না। কারণ সে যতটুকু জানে ও যতটুকু শিখেছে তা হচ্ছে তার একান্ত নিজস্ব অভিজ্ঞতা। প্রতিটি ধাপে ধাপে নতুন মানুষ ও নতুন পরিবেশের সাথে জীবন যুদ্ধে এগিয়ে যেতে হয়েছে। তবুও যাদের লেখাপড়ার প্রতি বিশেষ আগ্রহ আছে তারা একান্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও সাহসিকতায় লেখাপড়া চালিয়ে যায়। এই প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের অনেকেই প্রতি বছর পাবলিক পরীক্ষায় অন্যান্য স্বাভাবিক বাচ্চাদের চেয়েও ভালো রেজাল্ট করে। আধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের ভালো রেজাল্টগুলো নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে থাকে। ি
বশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেকোনো পাবলিক পরীক্ষার চ‚ড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের পর প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের নিয়ে যে পোস্টগুলি দেওয়া হয় তাতে আপন পর সুস্থ এবং স্বাভাবিক সকলের মধ্যে সহানুভূতি জন্মায়। কোন ধরনের করুণা নয় সকলের স্নেহ মায়া মমতা ও ভালোবাসা এ প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। একজন মানবিক মানুষের পরিচয় দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর একজন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে নিজেই ফোন দিয়ে খবরাখবর নেন। শেখ হাসিনার ইতিবাচক ভুমিকা সকল প্রতিবন্ধীদের প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। আগামীতে আরো অনেক বেশি ইতিবাচক ভুমিকার প্রত্যাশায় এক একটি প্রতিবন্ধী পরিবারে জীবন চলার পথে উৎসাহিত করবে।
লেখক : কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক
ডা. ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।