পাহাড়ে জঙ্গিবাদের বিস্তাররোধে সরকারকে কঠোর হতে হবে

10

দেশের ইতিহাসে পার্বত্যজেলার পরিবেশ-পরিস্থিতি কখনো সুখের ছিলনা। এ অঞ্চলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলো নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নামে দীর্ঘ দুই যুগেরও অধিক সময় ধরে স্বশস্ত্র আন্দোলন করে আসছে। এ আন্দোলনের বলির পাঁঠা হয়েছে নিরীহ পাহাড়ি-বাঙালি। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসি পদক্ষেপে পার্বত্য জেলার প্রধান আঞ্চলিক সংগঠন জনসংহতির সাথে শান্তি চুক্তির পর এতদঅঞ্চলে শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করে। যদিও নিজেদের স্বার্থের দ্ব›েদ্ব লিপ্ত হয়ে জনসংহতি সমিতি কয়েকভাগে বিভক্ত হয়ে নানা দল উপদল গড়ে উঠে। সম্প্রতি এসব দল-উপদলের অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও খুন খারাবী নিত্য ঘটনায় রূপ নিয়েছে। সরকার এসব দ্ব›দ্ব-সংঘাতের সন্ত্রাসকে মোকাবেলা করে আসলেও সম্প্রতি বান্দরবানের বিভিন্ন পাহাড়ে জঙ্গি সংগঠনগুলোর প্রশিক্ষণসহ তাদের সাংগঠনিক কার্যকলাপের খবর পেয়ে উদ্বেগ্ন। দুর্গম পাহাড়ে জঙ্গি সংগঠনের প্রশিক্ষণ এবং তৎপরতায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বাড়তি নজরদারি করতে হচ্ছে। খবরে প্রকাশ বিগত প্রায় ৬ মাস ধরে পার্বত্য এলাকায় নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া তৎপরতা শুরু করেছে। এটি আনসারুল্লাহ ও হুজির নতুন রূপ। এ নব্য জঙ্গি সংগঠনটি পার্বত্য এলাকার দুর্গম পাহাড়ে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) প্রশিক্ষণ শিবিরকে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করছে। গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করে কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মি সম্পর্কে রিপোর্ট দিয়েছে। গত বছর অক্টোবরের শেষে বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির পাহাড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। তাদের মধ্যে সাতজন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সদস্য এবং তিনজন পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সদস্য। এরপরও জঙ্গি কার্যক্রম পাহাড়ে থেমে নেই। গত কয়েক বছরের জঙ্গিবিরোধী অভিযানের চিত্র দেখলে বোঝা যায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সমতলের অনেক জায়গায় জঙ্গি আস্তানা গুঁড়িয়ে দিতে পেরেছে। কিন্তু পাহাড়ে বিষয়টি তেমন সহজ নয়। অত্যন্ত দুর্গম এবং আত্মগোপনের যথেষ্ট সুযোগ থাকায় প্রশিক্ষণ ও ঘাঁটি হিসেবে পাহাড়কে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ভাবছে জঙ্গিরা। তাছাড়া সেখানকার স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর সমর্থন ও সহযোগিতা পাচ্ছে তারা। জঙ্গিরা অস্ত্র চালনাসহ সশস্ত্র সংগ্রামের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গোপনে পরিচালনার জন্য বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির দুর্গম এলাকাকে বেছে নেয়। এজন্য তারা স্থানীয় একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সহায়তা গ্রহণ করে বলে জানা যায়। স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, তিন পার্বত্য এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ছয়টি সন্ত্রাসী সশস্ত্র সংগঠন। এরা হলো- জেএসএস, জেএসএস (সংস্কার), ইউপিডিএফ, গণতান্ত্রিক এমএনপি (মগ গণতান্ত্রিক পার্টি) এবং সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। কেএনএফের ছত্রছায়ায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’। এতে করে জঙ্গি ও পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের অপরাধ কর্মকাÐের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। প্রতিনিয়ত রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে সবুজ পাহাড়। খুন হচ্ছে একের পর এক। আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুনোখুনি বাড়ছে। এছাড়া অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, ছোট-বড় হামলার ঘটনাও ঘটছে পাহাড়ে।
পার্বত্য অঞ্চলে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন ও পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের নামে সক্রিয় আঞ্চলিক সংগঠনগুলো নিজেরাই পারস্পরিক দ্ব›েদ্ব লিপ্ত থাকছে সব সময়। তারা পরস্পর সাংগঠনিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিনিয়ত লিপ্ত হচ্ছে বন্দুকযুদ্ধ ও অপহরণের ঘটনায়। দুঃখজনক ব্যাপার, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এখনো এক গ্রæপ আরেক গ্রæপের দিকে সব সময় বন্দুক তাক করে থাকছে। এ অবস্থায় ধর্মান্ধ জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতা নতুনভাবে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে পার্বত্য জেলাবাসীকে। আমরা মনে করি, পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখতে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। আঞ্চলিক গ্রæপগুলোর সন্ত্রাসী তৎপরতার পাশাপাশি জঙ্গি সংগঠনের যেকোন অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর হতে হবে। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার অতীতে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে যে সফলতা দেখিয়েছিল- এর উপর ভিত্তি করে পার্বত্য জেলা জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মুক্ত করতে সক্ষম হবে-এমনটি প্রত্যাশা আমাদের।