পবিত্র মক্কা ও মদিনা শরিফে দোয়া কবুলের বিশেষ স্থানসমূহ

101

 

হজের সফর দোয়া কবুলের অপূর্ব সুযোগ। হজ বা ওমরাহর জন্য ইহরামের নিয়ত করা থেকে দোয়া কবুল হওয়া শুরু হয়। হজের সফরে এমন কিছু সময় ও স্থান রয়েছে, যে সময় ও স্থানে দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, যে স্থানগুলোতে নবী-রাসুলদের দোয়া কবুল হয়েছিল বলে বর্ণিত আছে। সেসব জায়গায় দোয়া করা বাঞ্ছনীয়। পবিত্র মক্কা-মদিনার বিভিন্ন জায়গায় দোয়া কবুল হয়ে থাকে। সেসব স্থানে আল্লাহতায়ালার ওপর পরিপূর্ণ আস্থা রেখে-মনোযোগসহ বিনম্রচিত্তে,অশ্রুসজল নয়নে দোয়া করা দরকার। দোয়া কবুলের প্রসিদ্ধ কিছু- স্থান উল্লেখ করা হলো।
বায়তুল্লাহ শরিফ দৃষ্টিগোচর হলে : আল্লাহর ঘর বায়তুল্লাহ দেখে দোয়া করা। বায়তুল্লাহ শরিফ দেখামাত্র দোয়া করা। বর্ণিত আছে,বায়তুল্লাহ শরিফ প্রথম নজরে আসার পরে যে দোয়া করা হবে তা কবুল হবে।
হারাম শরিফ : হারাম শরিফের সীমানা বায়তুল্লাহর পশ্চিমে জেদ্দার পথে শুআইদিয়া পর্যন্ত ১০ মাইল, পূর্বে জেরুজালেমের পথে ৯ মাইল, দক্ষিণে তায়েফের পথে ৭ মাইল এবং উত্তরে মদিনা শরিফের পথে ৫ মাইল।
মসজিদুল হারাম : মসজিদুল হারাম হলো কাবা শরিফের চারদিকের বৃত্তাকার মসজিদ।
হাতিম : কাবা ঘরসংলগ্ন উত্তর দিকে অর্ধবৃত্তাকার দেয়ালঘেরা স্থান ‘হাতিম’ ও ‘হুজ্জাতু ইসমাইল’। এই স্থানটুকু আগে কাবাঘরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। নবী করিম (সা.)-এর নবুয়তপ্রাপ্তির কিছুদিন আগে কাবাঘরের সংস্কার করা হয়। এ সময় হালাল অর্থের অভাবে পূর্ণ কাবা নির্মাণ সম্ভব হয়নি বিধায় হাতিম অংশ বাদ রেখে নির্মাণ করা হয়েছে।
মিজাবে রহমত : কাবাঘরের ছাদের পানি পড়ার জন্য উত্তর পাশে হাতিমের ভেতরে মাঝখান বরাবর সোনার পরনালা হচ্ছে মিজাবে রহমত।
কাবা শরিফের রোকনসমূহ : কাবাঘরের প্রত্যেক কোণকে রোকন বলা হয়। কাবাঘরের উত্তর-পূর্ব কোণকে বলা হয় রোকনে ইরাকি, উত্তর-পশ্চিম কোণকে বলা হয় রোকনে শামি এবং দক্ষিণ-পশ্চিম কোণকে বলা হয় রোকনে ইয়ামানি।
হাজরে আসওয়াদ : কাবাঘরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে দেয়ালে লাগানো জান্নাতি পাথর।
মুলতাজিম : হাজরে আসওয়াদ ও কাবাঘরের দরজার মধ্যবর্তী স্থান।
বাবুল কাবা : কাবাঘরের দরজা।
মুস্তাজার : কাবার বহির্গমন দরজা। বর্তমানে দেয়াল দিয়ে বন্ধ করা আছে।
রোকনে ইয়ামানি ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যস্থল : তাওয়াফের প্রতি চক্করে এই স্থানে পড়তে হয়, রাব্বানা আতিনা ফিদ দুনিয়া হাছানা,ওয়া ফিল আখিরাতি হাছানা ; ওয়া কি না আজাবান নার। (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২০১)।
মাতাফ : কাবা শরিফের চতুর্দিকে তাওয়াফের জন্য খোলা স্থান।
মাকামে ইব্রাহিম : কাবা শরিফের পূর্ব দিকে মাতাফের মধ্যে যে পাথরখন্ড সংরক্ষিত আছে, যার ওপর দাঁড়িয়ে হজরত ইব্রাহিম (আ.) কাবাঘরের প্রাচীর গাঁথতেন।
সাফা : কাবা শরিফের পূর্ব পাশের নিকটতম পাহাড়, যেখান থেকে সাঈ শুরু করতে হয়।
মারওয়া : সাফা থেকে থেকে ৪৫০ মিটার দূরত্বে মারওয়া পাহাড় অবস্থিত। এখানে সাঈ শেষ হয়।
মাসআ : সাফা ও মারওয়া এই দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী সাঈর স্থান।
মিলাইনে আখদারাইন : সাফা পাহাড় থেকে মারওয়া পাহাড়ের দিকে ৫০ গজ গেলে দেয়ালে সবুজ বর্ণের লাইট দ্বারা চিহ্নিত প্রায় ৪০ হাত স্থান।
আরাফাত : আরাফাত ময়দানে হজরত আদম (আ.)-এর সঙ্গে হজরত হাওয়া (আ.)-এর পুনর্মিলন হয় এবং এখানেই তাঁদের তওবা কবুল হয়। তাঁরা এই দোয়াটি পড়েছিলেন,রাব্বানা জালামনা আনফুছানা,ওয়া ইন লাম তাগফির লানা ওয়া তারহামনা ; লানাকুনান্না মিনাল খছিরিন। (সুরা-৭ আরাফ, আয়াত : ২৩)।
হাদিসে এসেছে,উত্তম দোয়া,আরাফার দিবসের দোয়া এবং উত্তম কথা,যা আমি এবং আমার আগের নবীরা বলেছেন। আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি একক, তার কোনো শরিক নেই, রাজত্ব তারই, প্রশংসাও তার, তিনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান। সুনানে তিরমিজি : ৩৫৮৫
জাবালে রহমত : দয়ার পাহাড়, এই পাহাড় আরাফাত ময়দানে অবস্থিত।
মসজিদে নামিরা : আরাফাতের দিন এখান থেকে হজের ভাষণ দেওয়া হয়।
মুজদালিফা : এখানে বাবা আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.) প্রথম একত্রে রাত যাপন করেন।
মিনা : আল্লাহ তাআলার আদেশে হজরত ইব্রাহিম (আ.) স্বীয় তরুণ পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-কে যে স্থানে কোরবানির জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন।
কঙ্কর নিক্ষেপের পর দোয়া করা : কঙ্কর নিক্ষেপের পর দোয়া করা। দোয়া কবুলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও সময় হচ্ছে, জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপ করে দোয়া করা। কঙ্কর নিক্ষেপের পর জামারার স্থান থেকে সামান্য সরে গিয়ে প্রাণ খুলে দোয়া করা।
মসজিদে খায়েফ : মসজিদে খায়েফ মিনা প্রান্তরে অবস্থিত। এখানে আদিকাল থেকে আখেরি নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) পর্যন্ত ৭০ জন পয়গম্বর (আ.) আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করেছেন।
জামারাত : মিনাতেই তিনটি জোমরা (স্তম্ভ) অবস্থিত,এগুলোকে একত্রে ‘জামারাত’ বলে। এগুলো ছোট শয়তান (জোমরায়ে উলা), মেজ শয়তান (জোমরায়ে উস্তা),বড় শয়তান (জোমরায়ে আকাবা) নামে পরিচিত। হজরত ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানির পথে এই স্থানে শয়তান বাধা সৃষ্টি করলে তিনি পাথর ছুড়ে তাকে বিতাড়িত করেন।
জমজমের পানি পান করার সময় : জমজমের পানি পান করার সময় দোয়া করা। জমজমের পানি পান করার সময় আপনার যা খুশি আল্লাহর কাছে চাইবেন। এখানে আপনি যা দোয়া করবেন, আল্লাহতায়ালা তাই কবুল করবেন।
বিদায়ী তাওয়াফ শেষে : হজের সব কর্ম পালন শেষ করে দেশে ফেরার আগে বিদায়ী তাওয়াফ করতে হবে। তাওয়াফ শেষে আপনি মুলতাজামের কাছে চলে যাবেন। মুলতাজামে চেহারা, বুক, দুই বাহু ও দুই হাত রেখে দোয়া করবেন। এটিই আপনার শেষ সুযোগ। একে কাজে লাগান। আল্লাহর কাছে যা খুশি আপনি চাইতে পারেন।
রিয়াজুল জান্নাত অর্থ বেহেস্তের টুকরাতে দোয়া করা : মা আয়েশার ঘর থেকে মসজিদে নববির মিম্বর এর মধ্যস্থিত স্থান। মসজিদে নববির যে অংশ টুকুতে সবুজ রং এর কার্পেট বিছানো আছে। রসূল (স.)-এর রওজা ও মিম্বর এর মাঝে একটি জায়গা রয়েছে। যার নাম রিয়াজুল জান্নাহ। অর্থাত, বেহেশতের টুকরা। সেখানে নামাজ পড়া অনেক সৌভাগ্যের বিষয়। মসজিদে নববীতে ৮ দিনে মোট ৪০ ওয়াক্ত নামাজ পড়া বিশেষ মর্যাদার। কেননা মসজিদে নববীতে এক রাকাআত নামাজ পড়া ৫০ হাজার রাকাআত নামাজ পড়ার সমান।
উপরোল্লিখিত স্থানসমূহ ব্যতীত পুরো হারাম শরিফেও দোয়া কবুল হওয়ার কথা বর্ণিত আছে। এ ছাড়া রাসুল (সা.)-এর জন্মস্থান, হজরত খাদিজা (রা.)-এর বাড়ি, গারে হেরা, গারে সাওর, রিয়াজুল জান্নাত, দুই উস্তুয়ানা, দারে আরকাম, মেহরাবে নবী, আসহাবুস সুফফা ইত্যাদি স্থানও দোয়া কবুল হওয়ার স্থানসমূহের অন্তর্ভুক্ত।
দোয়ায় কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি করা যাবে না। আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ও আস্থা রেখে দোয়া করা খুবই জরুরি। দোয়ার সময় এ বিশ্বাস মনে পোষণ করবেন, আল্লাহ অবশ্যই আমার কথা শুনছেন এবং আমার দোয়া কবুল করছেন।
হজ ও ওমরাহ সম্পন্ন করে বাড়িতে ফিরে আসার পরও ৪০ দিন পর্যন্ত হাজিদের দোয়া কবুল হতে থাকে এবং হাজি যত দিন পর্যন্ত ইচ্ছাকৃত কোনো কবিরা গুনাহে লিপ্ত না হবেন,তত দিন পর্যন্ত তাঁর দোয়া কবুল হতে থাকবে। হে আল্লাহ আমাদের সকলকে আপনার মকবুল বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত করুন। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর হিদায়ত সকলকে নসীব করুন। আল্লাহতায়ালা সবাইকে তওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : হেড অব ফাইন্যান্স এন্ড একাউন্টস
এপিক হেলথ কেয়ার লিমিটেড