পদ্মায় জাগছে যে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

14

নিজস্ব প্রতিবেদক

সোনালি স্বপ্নের দ্বার পদ্মা সেতু উন্মুক্ত হচ্ছে আজ। এই সেতু যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অর্থনীতিতে আনবে এক নতুন বিপ্লব। সেতু দিয়ে যুগলবন্দী হয়েছে স্রোতস্বিনী পদ্মার দু’ক‚ল। এতে সমৃদ্ধ দেশ গড়তে চালিকাশক্তি হিসেবে পদ্মা সেতু অসামান্য অবদান রাখবে বলে মনে অনুরণিত হচ্ছে বারংবার।
বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবেই ঘনবসতিপূর্ণ। যে কারণে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা শুধু চ্যালেঞ্জিংই নয় বরং দুরূহও বটে। বাংলাদেশের বুক চিড়ে প্রায় সাতশ নদ-নদীর গড়ে ওঠা নেটওয়ার্কের মধ্যে হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন পদ্মাই অন্যতম, যা দিয়ে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জলধারা বঙ্গোপসাগরে মেশে। বিশ্বের সবচেয়ে খরস্রোতা নদী আমাজনের পরেই পদ্মার অবস্থান, যার খরস্রোতা প্রকৃতির কারণে দু’ক‚লের মানুষ দিশেহারা হয়ে এর নাম দিয়েছে কীর্তিনাশা। সেই পদ্মায় আজ সোনালি স্বপ্নের দ্বার উন্মোচন হচ্ছে।
পদ্মা সেতুর ছোঁয়ায় বদলে যাবে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮ (পৃষ্ঠা-৫) এ বিশেষ অঙ্গীকার হিসেবে মেগা প্রকল্পের দ্রুত ও মানসম্মত বাস্তবায়ন, দারিদ্র্য নির্মূল, সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা প্রভৃতিতে আমূল পরিবর্তন যেমন ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। তেমনি চট্টগ্রামের বাণিজ্যেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এমনটিই প্রত্যাশা ব্যবসায়ী নেতাদের।
বিশ^ব্যাংকের তথ্যমতে, পদ্মা সেতুর ফলে আঞ্চলিক বার্ষিক জিডিপি ২ শতাংশ ও দেশের সার্বিক জিডিপি ১ শতাংশেরও অধিক হারে বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলাকে সংযোগকারী সেতুটি স্থানীয় দারিদ্র্য ১.৯ শতাংশ এবং জাতীয় দারিদ্র্য ০.৯ শতাংশ হ্রাস করবে যা বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ। কৃষি ও কৃষকের ভাগ্যেও পদ্মা সেতু নিয়ে আসবে এক অভাবনীয় পরিবর্তন। পদ্মা সেতুর বদৌলতে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষিতে অগ্রগতি আসবে ১০ শতাংশেরও বেশি।
গত কয়েক বছরে শরীয়তপুর ও মাদারীপুরে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে আধুনিক কৃষির ব্যাপক আয়োজন ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলেছে। নানা ধরনের কর্মকাÐ শুরু করেছে কৃষক ও কৃষির সঙ্গে জড়িত খামারি ও ব্যবসায়ীরা। পরিবহনের অভাবে দক্ষিণাঞ্চলের মাছ, ধান, পান, ফুলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যই সরাসরি ঢাকায় আসতে পারত না। আর এলেও দীর্ঘ সময় লাগার কারণে সরবরাহের পরিমাণ ছিল কম। ফলে, ঢাকায় চড়া দাম হলেও স্থানীয় বাজারে তা সস্তায় বিক্রি হতো। পদ্মা সেতু চালু হলে কৃষক পণ্য নিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীর শিকল ভেঙে ঢাকায় আসবে। ফলে একদিকে যেমন কৃষক লাভবান হবে, অন্যদিকে কমে আসবে নিত্যপণ্যের দাম।
পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ার পর বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন দিকে মোড় নেবে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ ইতিমধ্যে বিশে^র স্বনামধন্য অর্থনীতি বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠানসমূহ করতে শুরু করেছে। একটি প্রতিষ্ঠানের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ার পর আগামী ৩০ বছরের মধ্যে দেশের জিডিপি বৃদ্ধি পাবে ৬ হাজার বিলিয়ন ডলার এবং ২০৩০ সালেই তার বাৎসরিক রিটার্ন দাঁড়াবে ৩০০ মিলিয়ন ডলার। শিল্পের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা। পদ্মা সেতুর ফলে দক্ষিণের জেলাগুলোতে গড়ে উঠছে বড় বড় সব শিল্পকারখানা। পদ্মার ওপারে গেলে শত-শত কোম্পানির বিলবোর্ড ও সাইনবোর্ড থেকে বুঝা যায় ভারী শিল্পের এক অনন্য জনপদে পরিণত হতে প্রস্তুত হচ্ছে অঞ্চলটি।
ধারণা করা হচ্ছে, সরকারি ও বেসরকারিভাবে আনুমানিক ২-৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা যাবে এ অঞ্চলের শিল্পোন্নয়নে। যার ফলে কর্মসংস্থান হবে ১০ লাখের বেশি মানুষের।
পদ্মা সেতুর ছোঁয়ায় শিল্পায়ন, ব্যবসা খাত ও বাণিজ্যের বিকাশের বদৌলতে ২.৫ কোটির অধিক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। পদ্মা সেতু যে শুধু দেশের দক্ষিণ অঞ্চলকেই জোড়া লাগাবে তা নয়, ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও বড় নিয়ামক হয়ে উঠবে। ১ লাখ ৪১ হাজার কিমি দৈর্ঘের এ হাইওয়ে পদ্মা সেতুতে যুক্ত করবে নতুন মাত্রা, বৃদ্ধি পাবে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। শুল্ক আদায় হবে স্বাভাবিকের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি। পদ্মা সেতু পর্যটন শিল্পে অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে। দক্ষিণের কুয়াকাটা, সুন্দরবন, ভোলার শত-শত নয়নাভিরাম চর, এমনকি পদ্মা সেতুর দুই পাড় হয়ে উঠবে পর্যটন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ঢাকার মানুষ ব্যস্ততার কারণে দূরে কোথাও ঘুরতে যেতে পারে না। তাই পদ্মা সেতুকে ঘিরে গড়ে উঠবে হাজার কোটি টাকার পর্যটন শিল্প।
এদিকে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরাও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে পদ্মা সেতুকে কাজ লাগাতে উন্মুখ হয়ে আছে। যেহেতু আমাদের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের ৮০ ভাগই চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে হয়ে থাকে। স্বপ্নের পদ্মাসেতুর মাধ্যমে দেশের সাথে সড়কপথে যুক্ত হচ্ছে দক্ষিণের ২১ জেলা। কমে যাবে পরিবহন ব্যয় ও সময়। সারাদেশের ন্যায় এই সেতু উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরাও। উল্লেখিত জেলার উৎপাদকদের কাছ থেকে সরাসরি পণ্য কিনে দেশে বাজারজাত এবং বিদেশে রপ্তানির আশা করছেন অনেক ব্যবসায়ী।
এই বিষয়ে চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলমের বক্তব্য হচ্ছে, পদ্মা সেতু যোগাযোগ ব্যবস্থার নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। পদ্মার ওপারের ২১টি জেলার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। আর যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিবর্তন মানেই ওই অঞ্চলের আর্থ সামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন। এই সেতুর মাধ্যমে পণ্য পরিবহন ও যাত্রী পরিবহনে সময় বাঁচবে। এর মাধ্যমে সারা দেশের পাশাপাশি চট্টগ্রামও উপকৃত হবে। এছাড়া পানি পথে ঝুঁকি নিয়ে চলাচলের ক্ষেত্র সংকোচিত হয়ে আসবে। মোট কথা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন মানেই দেশের অর্থনীতির চেহারা পাল্টে দেয়া। পাশাপাশি পদ্মার ওপারে মংলা বন্দরের কর্মব্যস্ততা বাড়বে।
চিটাগাং মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের ভাইস প্রেসিডেন্ট এ এম মাহবুবু চৌধুরীর মতে, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়নে প্রাণভোমরা। বিরতিহীন গাড়ি চলাচলের মাধ্যমে পণ্য পরিবহনে সময়ের সাশ্রয় হবে। পাশাপাশি যাত্রীবাহী জাহাজের ওপর নির্ভরতাও কমে আসবে। অর্থাৎ পদ্মা ব্রিজ পুরো যোগাযোগ ব্যবস্থা পাল্টে দেবে। এছাড়া পদ্মার ওপারের ২১টি জেলার যেসব পণ্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেত সেই যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আসবে। পদ্মার ওপারে শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠবে। পাশাপাশি পটুয়াখালি ও সুন্দরবন এলাকার যে পর্যটন শিল্প এতোদিন যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি সেটিও এবার জায়গা করে নিতে পারবে। পদ্মা সেতুর রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হলে সেই পথে পণ্যপরিবহনও সহজ হবে। আর্থিকভাবে লাভবান হবে ব্যবসা-বাণিজ্য। সময়ক্ষেপনও কমবে।
এদিকে মোস্তফা হাকিম গ্রæপের পরিচালক মোহাম্মদ সরওয়ার আলম জানান, পদ্মার ওপারের সাথে চট্টগ্রামের ব্যবসা বাণিজ্যের গতি ত্বরান্বিত হবে। এখান থেকে পদ্মার ওপারে কিংবা পদ্মার ওপার থেকে এখানে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে সময় এবং অর্থ দু‘টারই সাশ্রয় হবে। যা ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি আরও জানান, ওই অঞ্চলে ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠা ও পর্যটন খাতের উন্নয়ন আরও গতি পাবে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর।
বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি সালাম মুশের্দীর মতে, পদ্মা সেতুর ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে। সক্রিয় হবে মোংলা বন্দর।