নৈমিত্তিক আহারে মাছ মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় থাকা জরুরি

14

 

দেশের মানুষের কাছে মাছ একটি লোভনীয় খাদ্যসামগ্রী। এমন এক সময় ছিল দেশের নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাওর, দিঘি-পুকুর, পাহাড়ি ছড়া এবং সমুদ্রে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি (স্বাধীনতার পূর্বের পরিসংখ্যান অনুসারে)। স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে মাছের চাহিদার চেয়ে দেশে মাছ পাওয়া যেত বেশি পরিমাণে। বাঙালির প্রধান খাদ্য ভাত। ভাত খেতে মাছ ছিল বাঙালির আহারের অন্যতম প্রধান সহযোগী খাদ্য। যে কারণে দেশে প্রবাদ চালু হয়েছিল ‘মাছে ভাতে বাঙালি’।
স্বাধীন বাংলাদেশ ব্রিটিশ উপনিবেশ ও পাকিস্তানি বেনিয়া গোষ্ঠীর আমলের বাংলাদেশ নয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রা, কাজ-কর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানাসহ সর্বক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সূচিত হয়। আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে কৃষিপ্রধান দেশ শিল্প-বাণিজ্যের আন্তর্জাতিক ডামাডোলে গা-ভাসিয়ে নিজেদের মানিয়ে নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে বিদেশে তৈরি হয় এ দেশের মানুষের শ্রমবাজার। তৈরিপোশাক শিল্পের যাত্রা ও উন্নয়ন আসে দ্রæত। যোগাযোগ ব্যবস্থায় সড়ক যোগাযেগের উন্নয়ন সাধিত হয়। দেশের সর্বত্র নগরায়ণের ছোঁয়া লাগে, যার ফলে নদী ও সমুদ্র কেন্দ্রিক জনপদের চেয়ে সড়কপথে জনবসতি বাড়তে থাকে। মানুষ যত্রতত্র বাড়িঘর, দোকানপাট, হাট-বাজার, শিল্প-কলকারখানা সৃষ্টি করে। যার ফলে খালবিল, নদী-ছড়া, পুকুর-দিঘি, হাওর-বাওর ভরাট হতে থাকে। ধানি জমিতে কীটনাশকের ব্যবহার বাড়ে। যার ফলে বর্ষা মৌসুমে যত্রতত্র মাছ উৎপাদন ব্যাহত হয় দেশে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বাড়ি নির্মাণ বেড়ে যায়। নগরায়নের হাওয়ায় বিপনী বিতান, মার্কেট এবং বিভিন্ন জাতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পায়। দেশে পাল্লা দিয়ে কর্ম সংস্থানও বাড়ে। কিন্তু এক সময় দেখা যায় দেশে মাছের চাহিদা বাড়লেও মাছের উৎপাদন কমে যায়।
আধুনিক কৃষি উৎপাদনে সরকার মনোযোগ বাড়ানোর ফলে কৃষি উৎপাদনের পাশাপাশি বর্তমানে মাছ উৎপাদনের প্রতি খামারিরা মন দেয়। যার ফলে মিঠাপানির মাছ উৎপাদন বাড়ে। সমুদ্রে এবং নদীতে যে সব মাছ পাওয়া যায় তার পরিমাণ কমে যায়। সমুদ্রে প্রাপ্য মাছে প্রচুর পরিমাণ আয়োডিন থাকে। অথচ সমুদ্র এবং নদীতে এক সময় মাছের আকাল পড়ে। এর পেছনে কারণ হলো পোনামাছ, মা-মাছ, অপ্রাপ্ত বয়স্ক মাছ ধরতো মাছ শিকারীরা। নির্বিচারে ডিমালি মাছ ধরা পড়ার কারণে সমুদ্রে মাছের উৎপাদন কমে যায়। তা ছাড়া বিশ্বে নানাপ্রকার রাসায়নিক প্রক্রিয়ার অপব্যবহার ও পানি দূষণের কারণে নদী সমুদ্রের মাছে বিচিত্র মড়ক দেখা দেয়। বৈশ্বিক উষ্ণায়ণের ফলেও নদী-সমুদ্রের মাছ উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়। নদী ও সমুদ্র দূষণের শিকার হবার কারণেও নদী সমুদ্রের মাছের প্রজনন স্বাভাবিক থাকেনি। যে কারণে একসময় মাছের আকাল পড়ে। বাজারে মিঠাপানির মাছ যে পরিমাণ পাওয়া যেত, সে পরিমাণ সমুদ্রের মাছ পাওয়া যেত না।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তি আমাদের অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছে। মানুষের চিন্তাশক্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। মানুষ নিজেদের জীবনের সংকট নিরসনে নতুন নতুন কৌশল ও প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছে। মানুষ মাছের চাহিদা পূরণের জন্য নানা গবেষণা করে সমাধান বের করতে সক্ষম হয়েছে। যার ফলে বর্তমানে দেশে মাছের চাহিদার অধিক মাছ উৎপাদিত হচ্ছে। এক সময় নদীতে ডিমালী ইলশ মাছ নির্বিচারে ধরা হতো। যার ফলে ইলিশের উৎপাদন কমে গিয়েছিল। ইলিশ বাঙালির সখের মাছ। ছড়া আছে ‘ইলিশ ভাজা খেতে মজা / গরম গরম হলে’। কিন্তু বাজারে ইলিশ আসে না, ঝাটকা এবং ডিমালি মাছ জেলেরা নির্বিচারে ধরার কারণে। এমন পরিস্থিতি হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য জাতীয় মৎস্য আইন প্রবর্তিত হয়। যার ফলে মা-মাছ নিধন, ডিমের মাছ নিধন, ইলিশের প্রজনন সময়ে মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হতে থাকে জাতীয় ভাবে। ফলে দেশে ইলিশ উৎপাদনের পাশাপাশি সমুদ্রে অন্যান্য মাছের উৎপাদনও বর্তমানে বাড়ছে। মৎস্য আইন মেনে নির্দিষ্ট সময়ে নদী সমুদ্রে জাল না ফেলার জন্য মৎস্যজীবীদের ভর্তুকি দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করে সরকার। জেলেরাও তা মেনে দেশের জলসীমায় মাছ উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে দেশে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়ে বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তবে দেশের বাজারে মাছ থাকলেও মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও মাছের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নেই। বাজারে সব ধরনের মাছ ক্রয় করে খাচ্ছে অর্থবিত্তের মালিকেরা। স্বল্প আয়ের মানুষ দৈনিক ছয়শত টাকা বেতনে কাজ করে ছয় শত টাকা হতে ষোলশত টাকা কেজিদরে ইলিশ মাছ ক্রয় করে খেতে পারছে না। হ্যাঁ, পুকুরের পাঙ্গাস, ফার্মের বিদেশি কৈ মাছ, আফ্রিকান মাগুর, আর তেলাপিয়া মাছের দাম কিছুটা দরিদ্র সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকতে দেখা যায়। সু-স্বাস্থ্যের জন্য প্রচুর পরিমাণে মাছ ক্রয় করে খাচ্ছে তারাই, যাদের অঢেল টাকা আছে, ঘুষের কামাই আছে, অবৈধ রোজগার আছে। দুর্নীতির মাধ্যমে যারা প্রচুর টাকার মালিক মূলত তারাই বেশি পরিমাণে মৎস্য ভোজন করছে।
একথা সত্য যে, দেশের অধিকাংশ মানুষ সু-স্বাস্থ্য রক্ষায় সুস্বাদু মাছ ক্রয় করে খেতে পারছে না। তাদের প্রধান খাবার আলুভর্তা এবং তরল ডাল। দেশের সর্র্বস্তরের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অনুকূল মাছের মূল্য বাজারে স্থিতিশীল করা গেলেই মানুষ শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগানদানকারী সবধরনের মাছ খেয়ে জনস্বাস্থ্যের উন্নতি করতে সক্ষম হবে।