নূর কুতুব আলম

14

 

নূর কুতুব আলম, একজন দরবেশ এবং রাজা গণেশ এর নিপীড়ন থেকে বাংলার মুসলমান জনগণকে রক্ষাকারী ব্যক্তিত্ব। তিনি শেখ আলাউল হকের পুত্র ও প্রধান শিষ্য এবং লাহোরের শেখ আসাদের পৌত্র। তিনি পান্ডুয়ার পীর আউলিয়াদের মধ্যে শীর্ষ মর্যাদার অধিকারী হন। পিতা-পুত্র দুজনই পান্ডুয়ার বিখ্যাত শাশ হাজারী দরগায় (যে দরগায় ছয় হাজার টাকার সম্পত্তি দান করা আছে) শায়িত আছেন। পিতার ন্যায় তিনি চিশতিয়া মতাদর্শের পীর ছিলেন। তাঁর অনুসারী শিষ্যকুল ও দরবেশগণ কয়েক শতক ধরে বাংলায় মুসলিম সমাজজীবনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। শেখ আলাউল হক সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ ও তদীয় পুত্র সিকান্দর শাহ এর সমসাময়িক ছিলেন, আর নূর কুতুব আলম ছিলেন গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ এর সতীর্থ ও সমসাময়িক।
বাংলার মুসলিম রাজ্যকে এক ভয়াবহ ধ্বংসলীলা থেকে রক্ষা করার জন্য শেখ নূর কুতব আলম তাঁর পিতার চেয়েও বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করেন। যখন রাজা গণেশ পান্ডুয়ায় ক্ষমতা দখল করে শেখ, উলেমাসহ মুসলমান জনগণের উপর নির্বিচারে অত্যাচার শুরু করেন, তখন তিনি হস্তক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি জৌনপুরের সুলতান ইবরাহিম শর্কিকে বাংলার মুসলমানদের সহায়তায় এগিয়ে আসার অনুরোধ জানিয়ে পত্র দেন। ইবরাহিম শর্কিকে অনুরূপ আহবান জানানোর জন্য তিনি মীর সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানিকেও অপর একটি পত্রে অনুরোধ জানান। উভয়ের আহবানে সাড়া দিয়ে সুলতান ইবরাহিম বিরাট বাহিনী নিয়ে বাংলা অভিমুখে যাত্রা করেন। এতে গণেশ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে শেখ নূরের নিকট আত্মসমর্পণ করেন এবং দরবেশের নিকট প্রার্থনা করেন যাতে তিনি সুলতান ইবরাহিমকে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানান। নূর কুতুব আলম এতে সম্মত হন নি, বরং পূর্বশর্ত হিসেবে তিনি রাজা গণেশকে মুসলমান হতে আদেশ দেন, কেননা কোন অমুসলমানের পক্ষ নিয়ে একজন মুসলিম নৃপতিকে অনুরোধ জানাতে তিনি অপারগ বলে জানান। গণেশ তাতে সম্মত হন কিন্তু বিস্তারিত শুনে তাঁর রানী এতে বাধা দেন। গণেশ তখন তাঁর ১২ বছরের ছেলে যদুকে নিয়ে শেখের নিকট আসেন। যদুকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে জালালুদ্দীন নাম দেওয়া হয় এবং গণেশ তাঁর পক্ষে সিংহাসন ত্যাগ করেন।
শেখের মৃত্যুর পর গণেশ অবশ্য যদুকে হিন্দু ধর্মে পুনরায় দীক্ষিত করে নিজে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু শীঘ্রই গণেশের মৃত্যু হলে যদু জালালুদ্দীন মুহাম্মদ শাহ উপাধি নিয়ে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
বিনয় আয়ত্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে নূর কুতুব আলম তাঁর পিতার আমল থেকে সব ধরনের কায়িক শ্রম অভ্যাস করতেন। দরগায় আগত ফকিরদের কাপড় ধোয়া, লাকড়ি ও পানি বহন, শীতকালে মুরশীদের অজু করার জন্য সর্বদা পানি গরম রাখা, এমন কি খানকাহ সংলগ্ন শৌচাগার পরিষ্কার করা প্রভৃতি কাজে তিনি নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। তিনি তাঁর দুই পুত্র শেখ রাফকাতউদ্দীন এবং শেখ আনোয়ারকে আধ্যাত্মিক শিক্ষা দেন। পূর্বোক্ত জনের ছেলে শেখ জাহিদ পিতামহের মৃত্যুর পর দরবেশ হিসেবে বেশ খ্যাতি অর্জন করেন। খুব সম্ভবত পিতার জীবদ্দশায় শেখ আনোয়ার রাজা গণেশের হাতে সোনারগাঁওয়ে শহীদ হন। শেখ নূর কুতুব আলমের অন্য আর একজন প্রধান মুরিদ ছিলেন শেখ হুসামুদ্দীন মানিকপুরী।
শেখ নূর কুতুব আলমের দরগাহ সংলগ্ন সরাইখানা ও মাদ্রাসার ব্যয় নির্বাহের জন্য সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ অনেক গ্রাম দান করেন। দরবেশের মাযার জিয়ারতের জন্য সুলতান বছরে একবার রাজধানী শহর একডালা হতে পান্ডুয়ায় আসতেন। শেখ নূর কুতুব আলমের মৃত্যুর তারিখ সঠিকভাবে জানা যায় না, তবে খুব সম্ভব তারিখটি হবে ৮১৮ হিজরি বা ১৪১৫ খ্রিস্টাব্দ এবং এ তারিখের অভিব্যক্তি হলো নূ বানূর-শুদ (আলো আলোতে বিলীন)। সূত্র : বাংলাপিডিয়া