নাতাশা

18

সিরাজুল মুস্তফা

আমি আর নাতাশা একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করি। ভালো মাইনে পাই। মাসের মাইনে মাসে মিলে। সুযোগ-সুবিধা খুব ভালো। কাজের জন্য উপযুক্ত জায়গা। তার আগে দৈনিকের অফিসে কাজ করতাম। মাইনের কোন ইয়ত্তা ছিলো না। ্গত জুলাইয়ের ৪ তারিখ যোগ দেই এই অফিসে। উত্তরা আজিমপুর । আয়েশা ব্রোকারেজ হাউজ। শুরুর দিকে আমি আমার পত্রিকা অফিসের সে বাউন্ডলে জীবনকে বহন করি। সময় প্রকৃতি পরিস্থিতি আমাকে বদলে দেয়। আমার পাশের ডেস্কে কাজ করে আমার চেয়ে বয়সে বড় নাতাশা। মুখোমুখি ডেস্ক। তাই ইচ্ছায় অনিচ্ছায় মাথা তুললে তার দিকে আমার চোখ পড়তো। চোখ দুটো যেন তার পটলের ন্যায় অংকিত। ঠোঁঠের কোণে লাজুক মিষ্টি এক টুকরো হাসি। শুভ্র চেহারা। আমি আফিম সেবকের ন্যায় নেশাগ্রস্ত হয়ে যেতাম। সামনে চলাচলের একটা সরু পথ। আমি ঘোরের মাঝে সে পথে একখানা বিশাল পথ রচনা করতাম। দু-দিকে সদ্য গজানো পাতা নিয়ে রাশি রাশি চায়ের গাছ। মাঝখানে মাঝখানে আকাশমণি দাম্ভিকতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাঝখানে একটা মহাসড়ক যেনো দূরে গিয়ে নীল আকাশের খোলের ভেতরে হারিয়ে গেছে। সে পথে আমি লং ড্রাইভে বেরিয়েছি নাতাশা পাশের সিটে। খোলা ছাদঅলা গাড়ি। নাতাশার চুলগুলো বাতাসের হেঁয়ালি পেয়ে উড়ছে মনের আনন্দে। আমি আমার মনের মাঝে হারিয়ে যায়। পাশের টেবিলে নুর হোসাইন। সে আমাকে আলতো ঠেলায় জাগিয়ে তুলে। আমি হঠাৎ কেঁপে উঠি। সংবিৎ ফিরে পেলে বুুঝতে পারি আমি যে ছোট্ট একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ করছি। তখন আমি আরেকটিবার মাথা তুলি ওকে দেখতে পাই না। হয়তো অন্য কোন কাজের প্রয়োজনে অন্য কোন ডেস্কে গিয়েছে সে। আমি নিজেকে আটকে দিতে চাই। অফিসের কলিগের দিকে এমন লাস্যময়তা নিয়ে তাকাতে নেই। আপন কাজে ডুব দেই। অনেক কাজ জমে গেছে।
আমি স¦ভাবে চাপা। কারুর সাথে সহজে আদিখ্যেতায় জড়াতে জানিনা। তবে যার সাথে জড়িয়ে যাই আর বেরোতে পারি না। তার সাথে মনে হবে আমার জন্ম জন্মান্তের সই পাতানো ছিল। মাস পেরিয়ে গেলো আজো নাতাশার সাথে আমার হাই/হ্যালো অবধি হয়নি। অথচ দুজনে পাশের ডেস্কে কাজ করি। তবুও এমন কোন কাজের প্রয়োজন পড়েনি ওর সাথে যে সুযোগে একটু হাই/হ্যালো সেরে নেব। ও ভীষণ চাপা। হয়তো আমারই মতো বা তারচেয়ে বেশি। অফিসের কারুর সাথেই ও তেমন একটা বেশি কথা বলে না। কাজে ভীষণ চতুর। গোঁছালো, শান্তশিষ্ট, শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা বলে মনে হয় কবিতা। আমি যেহতু নতুন সবাই এসে কথা বলে পরিচিত হয়। কেবল নাতাশা আসেনি। জানিনা কেনো! তাও ‘আমার মন বলে চাইÑ চাইরে, যারে আমি পাই নারে! আমার মন বলে চাই চাই গো, যারে নাহি পাই গো।’ দিনের পর দিন কেটে যায়। কাজের ফাঁকে আমি আনমনে চেয়ে থাকি তার দিকে। সেও মাথা তুলে তাকায়। চোখাচোখি হয়, মুখোমুখি হয় কথা হয় না। মনে হয় যেনো জনমের শত্রুতা নিয়ে আমরা দুজন পাশাপাশি বাস করছি। আসলে আমরা দু-জন দুজনের প্রতি দুর্বল এটাই তার বহিঃপ্রকাশ। সোমবার দিন। আমার একটা কাজ পড়ে গেলো। বসের আদেশ নাতাশার সাথে ডিসকাস করে নেওয়া। বাধ্য হয়ে আমাকে কথা বলতেই হলো । ও প্রথমে আমার দিকে চোখ তুলে এমন ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো আমি আঁতকে উঠি। বিধাতা জানেন কেনো এমন করে তাকালো। আমি সরে যাবার পর ও ঠিকই চোখ দুটো দিয়ে আমাকে খুঁজে দেখছে। আমি আড়াল থেকে দেখছিলাম। দিনে দিনে আমি ওর প্রতি আসক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। অফিস ছেড়ে বেরোতে মন চাইতো না। সকাল বেলা অফিসে চলে গিয়ে অপেক্ষায় থাকাতাম কখন সে আসবে। সে আসার আগ অবধি মনে হতো জলের মাছ ডাঙায় উঠে গিয়ে জলের খুঁজে যেমন ছটফট করে আমিও তেমন ছটফট করতাম । ও আসলে মনের প্রশান্তি। দেখতে দেখতে দিন কেটে গেল। একদিন ওর সাথে আমার কথা হলো। অনেক কিছু নিয়ে । অফিসের কাজে একটা প্রজেক্ট দেখতে আমাদের দুজনকে সরেজমিন নিরীক্ষণের দায়িত্বে পাঠায়। আমি আর ও খোলা রিকশায়। আহা! আমার বহুদিনের চাওয়া পূর্ণ হয়েছে। রিকশায় ওকে সৌজন্যতার খাতিরে একবার জিজ্ঞাসা করলাম নাশতা করে নেবে কিনা। ও কিছু বললো না। শুধুই আমার দিকে একটিবার তাকালো। আমি যেন জ্বলন্ত মোমের মতন গলে যাচ্ছিলাম। ওর শরীরের কড়া পারফিউমের ঘ্রাণ আমার নাকে আজও লেগে আছে। জানিনা সে কোথায় আছে, কেমন আছে? আগের মতন অমন বিশুদ্ধ হাসি আজও হাসে কিনা জানিনা। যেখানেই থাকো ভালো থেকো নাতাশা। সেদিন সন্ধ্যা নেমে আসে । রাত্রি গভীর অন্ধকারময় ছিল। তার মাঝে গুটিকয়েক বাতি জ্বলছিলো। সানাইয়ের নহবত আজো আমাকে আক্ষেপে পোড়ায়।