নদী ও নগর রক্ষায় উদাসীনতা চট্টগ্রামের নেতারা নিষ্ক্রিয় কেন?

35

ওয়াসিম আহমেদ

অরক্ষিত নালায় পড়ে মানুষ মরছে। দায় নিচ্ছে না কেউ। রাস্তা-ঘাটের বেহাল দশায় জনদুর্ভোগ চরমে। চট্টগ্রামের ‘লাইফলাইন’ খ্যাত কর্ণফুলী নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু হলেও শেষ হয়নি। আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছে নদী আন্দোলনের সংগঠন। উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের সুফল পেতে হলে সচল ও টেকসই নগরীর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু নদী ও নগর রক্ষায় বরাবরই উদাসীন থাকছেন ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের রাজনৈতিক পদধারীরা। জনস্বার্থের কর্মকান্ডগুলোতে নিষ্ক্রিয় থাকছেন তারা।
জানা গেছে, বার বার তাগাদা সত্ত্বেও কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ না করায় আগামী ১৫ দিনের মধ্যে হাইকোর্টের আদেশ অবমাননার অভিযোগ এনে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার চাইবে চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন। ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট হাইকোর্ট কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের রায় প্রদান করেন। পরবর্তীতে প্রতিপক্ষ সুপ্রিম কোর্টে আপিল করায় ২০১৯ সালে এপ্রিল মাসে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়ে ৯০ দিনের সময় দিয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম চেয়ারম্যান বন্দর কর্তৃপক্ষ, চসিক মেয়র, সিডিএ চেয়ারম্যান, মহাপরিচালক পরিবেশ অধিদফতর ও পুলিশ কমিশনার চট্টগ্রামকে আদেশ দেন হাইকোর্ট। ২০২০ সালের ৫ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি পাঁচ দিন অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। পরবর্তীতে চলতি বছর লালদিয়া চরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
প্রসঙ্গত, ফিরিঙ্গিবাজার থেকে নতুন ব্রিজের পশ্চিম পাশ পর্যন্ত এলাকায় প্রতিদিনই গড়ে উঠছে নতুন নতুন স্থাপনা। ব্রিজের পশ্চিমে লাগোয়া জায়গাটি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে ট্রাক ও বাস টার্মিনাল। চলছে বালু দিয়ে ভরাট কাজ। সেখান থেকে রাজাখালী খালের মুখ পর্যন্ত স্থানে গড়ে উঠছে দোকান আর দোকান। এরপরই আছে নদী দখল করে গড়ে ওঠা মৎস্য আড়ৎ। উচ্ছেদ ঠেকাতে নির্মাণ করা হয়েছে ধর্মীয়সহ নানা স্থাপনা। আর সদরঘাট এলাকায় উচ্ছেদকৃত স্থানগুলো এখন ব্যবহার হচ্ছে ট্রাক-লরি এবং পণ্য লোড আন-লোডের ঘাট হিসাবে। দখল হয়ে গেছে উচ্ছেদকৃত অনেক স্থাপনা। নদী গবেষক ড. ইদ্রিস আলী বলেন, নদী হলো প্রাকৃতিক মূলধন। এ মূলধন নষ্ট করে নগরায়ন হতে পারে না। প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়ার ভার কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাই প্রকৃতিতে লালন করতে তাকে নিজস্ব মহিমায় চলতে দিতে হয়। চট্টগ্রামকে ঘিরে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ চলছে। কিন্তু জনসাধারণের অধিকার সুরক্ষা উপক্ষেতি হচ্ছে। নালায় পড়ে মানুষ মরছে তবুও রাজনৈতিক অবস্থান বলে চেয়ারে বসা মানুষগুলো দায় নিচ্ছেন না। দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছেন না। রাজনৈতিক মৌলিকতা নেই এমন মানুষদের দায়িত্বে ও চেয়ারে বসানোর কারণে এমনটা হচ্ছে বলে দাবি ইদ্রিস আলীর। তিনি আরও বলেন, প্রকৃতিকে রক্ষার নামে অনেকে ব্যবসায় নেমেছেন। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এসব হচ্ছে। নিজের স্বার্থের জন্য দৌড়ায় আর জনস্বার্থে বিবৃতি দিয়ে দায় সারছেন তারা। এভাবে চলতে পারে না। প্রাচ্যের রাণী চট্টগ্রাম আজ চরম নেতৃত্ব সংকটে দিন পার করছে। সম্প্রতি গণমাধ্যমে চট্টলার সন্তান শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, কর্ণফুলী নদীকে নিজস্ব অবয়বে ফিরিয়ে আনতে হবে। সরকার নির্দেশ দিয়েছে সারাদেশে নদীর জায়গা নদীকে ফেরত দিতে। মাছবাজারের বিষয়টা নিয়ে এর আগেও আমরা অনেক পদক্ষেপ নিয়েছি। কোনও সমাধান হয়নি। নদীরক্ষা কমিশন সিদ্ধান্তও দিল নদীর জায়গা নদীকে ফিরিয়ে দিতে। নদীর জায়গা দখল করে যারা ব্যবসা করবে তারা যাতে জায়গা ছেড়ে দেয় আমরা তার ব্যবস্থা করবো। তবে এখানে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ একটা সমস্যার সৃষ্টি করে রেখেছে। তা আমরা নিরসন করবো। বাইরে থেকে কেউ এসে নদী দখল করে দোকান বিক্রি করবে তা হতে দেয়া যাবে না। সারাদেশে নদীর জায়গা নদীকে ফেরত দেয়া হচ্ছে। এখানে কার পয়সায় কার ক্ষমতাবলে এটা করা হয়েছে তা বন্ধ করতে আমরাও দাবি জানাই।
নালায় পড়ে চারমাসে চারজন মারা গেছেন। একজনের লাশ খুঁজেও পাওয়া যায়নি। ঝুঁকিপূর্ণ স্থান নির্ধারণে জরিপ চালাচ্ছে সিটি করপোরেশন। ওয়াসা ইচ্ছেমত রাস্তা কাটছে। নগরীর বিভিন্ন জায়গায় রাস্তা-ঘাটের বেহাল দশা। উন্নয়ন কর্মকান্ডে সমন্বয়হীনতায় নাগরিক দুর্ভোগ চরমে।
রাজনৈতিক অনৈক, দায় চাপানোর মনোভাব ও অদূরদর্শীতার কারণে এমনটা হচ্ছে বলে মনে করছেন নগরবিদরা। এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ সুভাস বড়ুয়া বলেন, আমাদের সমাজটা হলো ভোগবাদী সমাজ। এখানে ভোগের জন্য যা প্রয়োজন তার বাইরে কিছু করা হয় না। আমাদের চট্টগ্রামেও এমনটা হচ্ছে। এ শহরের চালিকা শক্তি সাধারণ মানুষ। তাদের মৃত্যুতে সংশ্লিষ্ট সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো টনক নড়ছে না। তার অন্যতম কারণ হলো, প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার যারা আছেন তারা জনগণের কান্না-কষ্টকে অনুভব করতে পারেন না। ভোগ আর লোক দেখানো টাকার অংকে উন্নয়নের মাপকাটি দেখিয়ে যাচ্ছেন। জনগণের জন্য এসব টাকা ব্যয় হচ্ছে অথচ জনগণ কতটুকু উপকৃত হচ্ছে সেটা নিয়ে কেউ ভাবছেন না। কারণ দূরদর্শী নেতৃত্ব নেই প্রতিষ্ঠানগুলোতে। নগরের ভেতর নদী, শাখা নদী, খাল, নালা দখলের কারণে পানি চলাচল করতে পারছে না। জলাবদ্ধতা তারই ফলাফল। কিন্তু জলাবদ্ধতা রোধে হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। কয়টি খাল আগের অবস্থান ফিরে পেয়েছে? আর এস খতিয়ান অনুসারে খালগুলো পুনরুদ্ধারে দাবি উঠলেও কেউ দায়িত্ব নিচ্ছেন না। মাস্টারপ্ল্যান যে করে সে প্রতিষ্ঠানই সবচেয়ে বেশি শর্তভঙ্গ করছে। এভাবে প্রজেক্ট হবে, হাজার কোটি টাকার অংক শুনানো হবে কিন্তু জনগণের ভাগ্য বদলাবে না বলে মন্তব্য করেন সুভাস বড়ুয়া।
নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের উন্নয়নের দায়িত্ব নিয়েছেন। চট্টগ্রামকে ঘিরে যা উন্নয়ন হচ্ছে তা ইতিহাস। রাস্তা-ঘাট মেরামতের দায়িত্বে সিটি করপোরেশন কাজ করছে, কর্ণফুলী নদী রক্ষায় সংশ্লিষ্ট দপ্তর কাজ করছে। তাদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। তবে কোনো কিছুকে আন্দোলনের ইস্যু বানানোর পাঁয়তারা করা যাবে না। যদি কোনো অসঙ্গতি মনে হয় তাহলে সেটা যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে হবে। অধৈর্য হয়ে রাস্তায় নামলে সবকিছু হয়ে যায় না। যদি চট্টগ্রামবাসীর প্রয়োজনে রাস্তায় নামতে হয় তাহলে আমিও নামবো।
নগর বিএনপি’র সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর বলেন, জনগণ ট্যাক্স দিচ্ছে। বিপরীতে যাবতীয় সেবা দিবে সেবা সংস্থাগুলো। রাস্তা-ঘাটের বেহাল দশা, নালায় পড়ে মানুষ মরছে। এমনকি খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমান সরকার যেমন গণতন্ত্রের বিষয়ে উদাসীন তেমনি সরকারের প্রতিনিধি সেবা সংস্থার প্রধানরাও উদাসীন। যে যেদিকে পারছে দখল-বাণিজ্যে মেতেছে। মানুষকে নিয়ে ভাববার সময় তাদের নেই। আমরা বিরোধী দল হিসেবে সবসময় জনগণের কথা বলে আসছি। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে বলছি, জননিরাপত্তার বিষয়ে বলে আসছেন দাবি এ বিএনপি নেতার।
নগরবিদ ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টদের অভিমত, যেখানে মানুষের মৃত্যুও সংস্থাগুলোকে নাড়া দিতে পারছে না, নিশ্চয় সেখানে হীন ব্যক্তিস্বার্থ দলীয় স্বার্থ, নগর ও নগরবাসীকে ছাপিয়ে গেছে। প্রাকৃতিকভাবে সম্ভাবনার প্রাচুর্যের নগরী চট্টগ্রামকে এসব সসম্যা থেকে উত্তোরণে কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। চট্টগ্রাম থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের অনেকেই কেন্দ্রীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বভার পেয়েছেন। কিন্তু চট্টগ্রাকে সামগ্রিকভাবে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের বলিষ্ঠ কোনো ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়নি। তাই সমন্বয়, রাজনৈতিক ঐক্য ও সঠিক নেতৃত্বই এগিয়ে নিতে পারে চট্টগ্রামকে। এমনটা মনে করছেন তারা।