নজরুল জীবনে নার্গিস

50

আরিফুল হাসান

দুনিয়া উল্টে ফেলার নাম কবিতা। তবে দুনিয়া উল্টাতে গিয়ে নিজে উল্টো হলে চলবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো দুনিয়া উল্টে গেলে নিজেরও ভাঁজ থাকার উপায় নেই। তাই কবিরা উল্টা পাল্টা, মাতাল, বদ্ধ পাগল। এই পাগলামিটাই কবিতা।
কবিতার পথে হাঁটতে হাঁটতে নজরুল আসলেন দৌলতপুর। এসে প্রেমেপড়ে গেলেন আরেক কবিতার। পটে আঁকা ছবি মুখের নার্গিসের সাথে দেখা হলো বিয়ে বাড়িতে। আনমনে নার্গিস কখন যে চুল খুলে দাঁড়িয়ে ছিলো খান বাড়ির ছাদে। দূরে পুকুরের পাড়ে কদম তলায় বাঁশি বাজাতে বাজাতে কালা দেখে। তার সুর এলোমেলো হয়ে যায়। সৈয়দা খাতুনের তিনি নাম রাখেন নার্গিস আসার খানম। তারপর থেকে কালার বাঁশির সুর শুনেও নার্গিসের মন উতলা হয়। কিশোরী মনে খেলে যায় প্রেমের হিল্লোল। দখিনা বাতাস এসে উড়িয়ে দেয় উতলা আঁচল। সাথে শিউলির ঘ্রাণ মিশে তাকে মোহাচ্ছন্নতায় ঘিরে ফেলে। কল্পনায় ছোট্ট একটা সংসার দেখে। যাহ! এই ঝাকড়া চুলের সাথে….! না, আর কিছু ভাবতে পারেনা নার্গিস। মেঘের ফাঁক থেকে উঁকি দেয়া মেঘলা দিনের সূর্যেও মতো একটা হাসির বিভা ফুটে উঠে ঠোঁটে। মহীয়সী যে বাস কওে তার অন্তরে, সে দৌড়ে পালায়। সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নেমে আসে। বুক ধরফর কওে তার। এই প্রেম লুকানো যায় না। আবার প্রকাশ করাও যায় না।
নজরুল পুকুর পাড়ে আমতলায় বসে গান রচনা করে। সে গান আবার সুর করে নিজের কণ্ঠে গায়। নার্গিসের বড়ো সখ হয়, ওকে বলে তার জন্য একটি গান লেখে দিতে। কিন্তু লজ্জায় আড়ষ্ট হয়। এই পাহাড় উচ্চতার মানুষটির কাছে আসলেই তার সবকিছু কেমন গুলিয়ে যায়। জানা কথাগুলোও কেমন অচেনা হতে থাকে। ভাবনারা বিক্ষিপ্ত হয়, দিগি¦দিক ছুটাছুটি করে, শেষে কূল কিনারা না পেয়ে এক জায়গায় স্থিত হয়ে থাকে। মাটির দিকে চেয়ে থাকে নার্গিস। মাটির গোপন কানে বোধহয় নীরব ভাষায় কোনো কথা বলে। নজরুলের ছায়া পড়ে মাটিতে। নার্গিস আঁড়চোখে চায় সে ছায়ার দিকে। পরক্ষণেই লুকিয়ে ফেলে নিজেকে। লজ্জায় আরো বেশি অধোমুখী হয়। নজরুল স্মিত হেসে বাঁশিতে ঠোঁট রাখে। পুকুর পাড়ের গাছগুলোর ছায়া সুনিবিড় ভাষার ভেতর মিশে যেতে যেতে নারগিস দৌড়ে ঘরে ফিরে। তবে পেছন পেছন একটা সুরও সঙ্গী হয়ে আসে। তার মনকে উদাসী বানিয়ে ঘরছারা করে। দেহ খাঁচা খাঁটের উপরে ধপাস করে পড়লেও রুহুপাখি উড়ে যায় নজরুলের কাছে। গোপনে খুব কাছাকাছি আসে। বুক ঘেসে বসে। আলতো হাতে বিলিকাটে কোকড়া চুলে। ভাবতে ভাবতে নার্গিস বালিশে মুখ চেপে খিলখিল করে হেসে উঠে।
হাসতে হাসতে দিন যায়। নজরুল ঝিঙে ফুল নিয়ে কবিতা লেখে। মরা মাচানের দেশে, নার্গিস কি এসেছিলো হলুদ শাড়িতে, খোঁপায় গুঁজেছিলো দুটো ফুল? সবুজ পাতার আড়ালে, মুখ তুলে হেসেছিলো ঝিঙে ফুলের মতো? হয়তো তখন বিকেল। স্নান সেওে নার্গিস চুলে ইচ্ছে মতন তেল দেয়। খোঁপাটা বাঁধতে গিয়ে আবার খুলে দেয় দীঘল কালো চুল পিঠ ভরে। হয়তো তখন তার সাধ হয় খোঁপায় দুটো ফুল গুঁজলে কেমন হয়? শরীরের শাড়িটা দেখে। কাঁচা হলুদের মতো যেনো একটি মিষ্টি রোদ খেলা করে দেহে। খোঁপাটা আবার বাঁধে। তখন হয়তো সে বাগানের পথে যায় একটি দুটি হলুদ গাঁদা ছিড়তে। কিন্তু বাগানের পথে হাঁটতে হাঁটতে তখন হয়তো তার কানে আসে আবার সে বাঁশির সুর, সে হয়তো তখন পথ হারায়। মুন্সিবাড়ির দক্ষিণ উঠোনের বিশাল বাড়িটি ছেড়ে তখন সে হয়তো চলে যেতে থাকে খানদের পুকুর পাড় ধরে। আর তখন হয়তো নজরুল ঝিঙে ফুল নিয়ে কোনো কবিতা লিখতে গিয়ে আটকে যায়। এই বাঁশ-বেতের মরা মাচান তার কাছে খুব প্রাণহীন মনে হয়। খুব কবিতাহীনতা থেকে তখন তাকে হয়তো বাঁচায় নার্গিস। হয়তো তখন সে ঝলমল করে উঠে হলুদ হলুদ তারার সুরভি নিয়ে ফুটে থাকা ঝিঙে ফুলের সাথে। তখন হয়তো নজরুল লেখে, মরামাচানের দেশ করে তোলে মশগুল।
নজরুল খানদের পুকুরে সাঁতার কাটে। ঘাটে জল আনতে এলে বাড়ির বধুদের সাথে অপাপ মস্করায় লিপ্ত হয়। তখন হয়তো বাড়ির বধুটির কলস ভেসে যায় জলে। নজরুল সাঁতার কেটে সে কলস ভরে এনে বৌটির কাছে দেয়। এ খবর চলে যায় নার্গিসের কাছে। সে দুদিন ভাত না খেয়ে থাকে। কেঁদে কেটে চোখের কোটা ফুলিয়ে মন খারাপ করে বসে থাকে। দুদিন পর হয়তো মানঅভিমান ভেঙে নার্গিসই আসে নজরুলকে দেখতে। হয়তো নজরুল তখন নিজেই নার্গিসকে দেখতে যায়। হয়তো তাদের দেখা হয়না সেদিন। হয়তো তখন নজরুলের বিরহী হৃদয় আরও বেশি পেতে চায় নার্গিসকে। তখন সে ঘনঘন যেতে থাকে নার্গিসের বাড়ি। কিন্তু নার্গিসও জেদ কমায় না। কী? এতো কিছু তলে তলে? কার কলস ভেসে গেলো তা নিয়ে নজরুলের মাথা ব্যাথা থাকবে কেনো? কেনো প্রিয় মানুষটি অন্য কারো সাথে হেসে কথা বলবে? কেনো সে জল ভরে দেবে অন্য রমনীর কলসে। তখন হয়তো নার্গিসের জেদ আরও বেশি চাপে এবং ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে সারাদিন পড়ে থাকে। সন্ধ্যার পরে হয়তো নজরুল আবার যায় মুন্সি বাড়িতে এবং জানালার পাশে হাস্নাহেনা গাছটির নিচে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু নার্গিস বেরোয় না। হয়তো সে বুঝতে পারে তার জন্য কেউ দাঁড়িয়ে আছে জানলার পাশে। সে তখন জানলার কবাটটি আরও ভালোভাবে লাগিয়ে দেয়।
সে রাতে নজরুল তার সবচেয়ে মোহিনী বাঁশিটি হাতে নেয়। বিরহের সুর তুলে তুলে খানবাড়ি ও মুন্সি বাড়ির সীমানা ধরে বাঁজাতে থাকে। রাতের অন্ধকারে সে সুর কেঁদে কেঁদে নার্গিসের কাছে আরতি জানায়। সারারাত নার্গিস ঘুমোতে পারেনা।
পরদিন সকাল বেলা এলো চুলে নার্গিস এসে দেখে নজরুল মামাদের পুকুর পাড়ের আম গাছটির গুড়িতে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। হয়তো সারারাত আজ ঘরে ফিরেনি আর। কড়ুল বাঁশের আগা দিয়ে তৈরি, পুড়িয়ে কারুকাজ করা যাদুর বাঁশিটি হয়তো পাশে পড়ে থাকে। হয়তো রাতভর অনিদ্রার ক্লান্তিতে নজরুলের চোখে তন্দ্রা নেমে আসে। হয়তো রাত জাগা নজরুল বাঁশি বাজাতে বাজাতে শেষ রাতের দিকে এই আম গাছের গুড়িতেই শুয়ে পড়ে। নার্গিসের বড় মায়া হয় ঘুমন্ত নজরুলের মুখের দিকে চেয়ে। হয়তো নজরুলের কোকড়াচুল এলিয়ে পড়ে তার একটি চোখ ঢেকে থাকে। হয়তো পাতার ফাঁকে রোদ এসে নজরুলের বুকের উপর খেলা করে। হয়তো কোথাও একটি বুলবুলি চুপচাপ চেয়ে থেকে নজরুলের দিকে হঠাৎ শিষ দিয়ে উড়ে যায়। নার্গিস ঘুমন্ত নজরুলের মুখের উপর থেকে চোখ সরাতে পারেনা। কি নিষ্পাপ সে মুখখানা। রাতজাগা ক্লান্তিতে চোখের নিচে কালি জমে আছে। নার্গিসের ইচ্ছে হয় খোঁপা খুলে কেশ দিয়ে মুছে দেয় কোজাগর ছাপ। হয়তো সে ধীর পায়ে নজরুলের আরেকটু কাছে আসে। একটি হাত উঠিয়ে লাজেম রিমরি ডাক দেয়, হেই! হয়তো তার ডাক তার গলার ভেতরই আটকে থাকে। রোমাঞ্চিত লজ্জায় সে ডাক কোনো ধ্বনি প্রবাহ তৈরি করেনা। নজরুল হয়তো সেই অস্ফুট ডাক শুনতে পায় না, হয়তো শোনে।