ধাক্কা বড়, ক্ষতি কম যে কারণে

52

তুষার দেব

আগের দিন ভোররাতে আচমকা তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে পাঁচ দশমিক আট মাত্রার যে ভ‚মিকম্পে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল কেঁপে উঠেছিল তার কেন্দ্র ছিল ভূপৃষ্ঠের ৪২ কিলোমিটার গভীরে। প্রায় ৩৪ ঘণ্টার ব্যবধানে গতকাল শনিবার বিকালে ‘আফটার শকে’ ফের দুলে উঠে চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকা। রিখটার স্কেলে চার দশমিক দুই মাত্রার এই কম্পনটির কেন্দ্রও ছিল ভূ-পৃষ্ঠের ৫৩ কিলোমিটার গভীরে। এ কারণে কোথাও বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির খবর মিলে নি।
ভূ-তত্ত্ববিদরা শনিবারের মৃদু মাত্রার কম্পনটিকে বলছেন ‘আফটার শক’। তুলনামূলক উচ্চ মাত্রার কম্পনের পর সাধারণত একই ফল্ট লাইনে এ ধরনের ছোট ছোট কম্পন অনুভ‚ত হয়ে থাকে। নগরীর পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম জানান, গতকাল শনিবার তিনটা ৪৮ মিনিটে অনুভূত মৃদু ভূকম্পনটির উৎপত্তিস্থল ছিল প্রতিবেশি দেশ মিয়ানমার ও ভারত সীমান্ত এলাকায়। রিখটার স্কেলে এই কম্পনের মাত্রা চার দশমিক দুই। এতে কোনও ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায় নি।
অপরদিকে, ভ‚মিকম্প পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ভলকানো ডিসকভারি’ তাদের ওয়েবসাইটে যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে, শনিবার বিকালে যে ভূকম্পনটি সংঘটিত হয়েছে, তার উৎপত্তিস্থল ছিল মিয়ানমারের চিন রাজ্যের হাকা এলাকা থেকে ৩৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। ভূপৃষ্ঠের ৫৩ কিলোমিটার গভীরে এ কম্পনের সৃষ্টি হয়। চট্টগ্রাম ছাড়াও জেলার রাউজান, পটিয়া, মানিকছড়ি, সাতকানিয়া, সমুদ্র উপক‚লীয় স›দ্বীপ এবং পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি ও বান্দরবান, ফেনী ও ঢাকা অঞ্চলেও এ কম্পন অনুভূত হয়। এর আগে গত শুক্রবার ভোররাত পাঁচটা ৪৫ মিনিটি ৪১ সেকেন্ডে অনুভ‚ত হওয়া ছয় দশমিক দুই মাত্রার ভ‚মিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে তিনশ’ ৩৯ কিলোমিটার দূরে প্রতিবেশি মিয়ানমারের চিন রাজ্যের ফালাম এলাকার ১৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে। এটির কেন্দ্র ছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩২ দশমিক আট কিলোমিটার গভীরে। মিয়ানমারের প্লেট বাউন্ডারি লাইনে একটি মাইক্রোপ্লেটের কাছাকাছি ‘সেগিং ফল্টে’ এ ভূমিকম্প হয়েছে। গতকাল শনিবার বিকালে অনুভ‚ত হওয়া ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল একই এলাকার কাছাকাছি। ওই অঞ্চল অতি ভূমিকম্পপ্রবণ। কিছুদিন আগেও একই জায়গায় ভূমিকম্প হয়েছিল। এ ফল্ট লাইনে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের শঙ্কা রয়েছে।
ভূ-তত্ত্ব বিশারদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. অলক পাল পূর্বদেশকে বলেন, উপর্যুপরি অনুভূত হওয়া ভুকম্পনগুলোর কেন্দ্র ভূ-পৃষ্ঠ থেকে বেশ গভীরে। রিখটার স্কেলে এগুলোর মাত্রাও মৃদু থেকে মাঝারি সীমার মধ্যে হওয়ায় এখন পর্যন্ত বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে। তবে দেশের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানগত কারণে অদূর ভবিষ্যতে মাঝারি থেকে উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার- ত্রিদেশীয় অঞ্চলের ভূ-তাত্ত্বিক গঠন, বৈশিষ্ট্য অনুসারে এর অবস্থানকে পৃথিবীর অন্যতম সক্রিয় ভূমিকম্প বলয়ের মধ্যেই বিবেচনা করা হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ এবং এর আশপাশের অঞ্চলে ভ‚মিকম্প সংঘটিত হওয়ার মত বাউন্ডারি প্লেট বা ফাটল রেখা বেশ সক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। যার ফলে যে কোনও সময়ে দেশে উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এমনকি রিখটার স্কেলে তা আট বা নয় মাত্রারও হতে পারে। চট্টগ্রামের উপক‚লীয় অঞ্চল ছাড়াও রাজধানী ঢাকার মাত্র ৬০ কিলোমিটার দূরে মধুপুর অঞ্চলে সাত থেকে সাত দশমিক পাঁচ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানার মত ভূ-তাত্ত্বিক ফাটল বিদ্যমান রয়েছে। এ ফাটল দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের তুলনামূলক অস্থির ভূ-স্তরের ওপর অবস্থান করায় এখানে ভূমিকম্পজনিত ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার শঙ্কাও অনেক বেশি। ইন্দো-বার্মা-হিমালয়ান, ইউরেশীয় একাধিক ভূ-স্তর ফাটলের লাইন বিস্তৃত থাকায় এবং এর সঞ্চালনের কারণে বাংলাদেশ এবং এর আশপাশের এলাকার ভূমিকম্প বলয়টি বিশ্বের অন্যতম ক্রিয়াশীল বলয় বলে ভূ-তাত্ত্বিকরা মনে করেন। এসব অঞ্চলের বারবার মৃদু থেকে মাঝারি এবং কখনওবা তারও অধিক মাত্রার কম্পনের কারণে ভূ-ফাটল রেখাগুলো ক্রমশ শিথিল ও নাজুক রূপ নিয়েছে। যা আগামীতে শক্তিশালী ভূমিকম্প ঘটাতে পারে। উচ্চ মাত্রার কোনও ভূমিকম্পের ফলে ভূ-অভ্যন্তরে যে ফাটল বা গ্যাপের সৃষ্টি হয় তা পূরণ করতে পরবর্তীতে আরও কিছু ছোট মাত্রার ভূকম্পন সৃষ্টি হয়। এ কারণে সেসব কম্পনে সাধারণত খুব একটা ক্ষয়ক্ষতি হতে দেখা যায় না।
ভূমিকম্পজনিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় দেশে বর্তমানে প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত জনবলের অপ্রতুলতা রয়েছে। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এখনও ভূমিকম্পের মত দুর্যোগ এবং পরবর্তী পরিস্থিতি সম্পর্কে মোটেও সচেতন নয়। বিশেষ করে হাসপাতাল ও ফায়ার সার্ভিসসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোকে ভূমিকম্পপ্রতিরোধী করে গড়ে তোলা জরুরি এ মুহূর্তে অধিক ভ‚মিকম্প ঝুঁকিতে থাকা ভবনগুলোকে দ্রæত রিট্রোফিটিং করার ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। ভূমিকম্পসহনীয় টেকসই ভবনের জন্য প্রণীত বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-২০২০ দ্রুত প্রকাশ করে ভবন নির্মাণকারীদের তা মেনে চলার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়াও অত্যাবশ্যক। আপদকালীন পরিকল্পনা গ্রহণসহ ভ‚মিকম্প-পরবর্তী অবস্থা মোকাবেলা এবং উদ্ধার তৎপরতায় সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সমন্বয় সাধন করা প্রয়োজন। ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেয়া এবং তা প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলেও জনসচেতনতা তৈরি, সতর্কতা অবলম্বন ও ভূমিকম্পজনিত দুর্যোগ মোকাবিলার সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ এবং সক্ষমতা অর্জনের মধ্য দিয়েই প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা অসম্ভব নয়।