দেশের দুর্নীতির অপরাজনীতির হাল-হকিকত সম্বন্ধে কিছু কথা

36

কাজি রশিদ উদ্দিন

সম্প্রতি আমাদের প্রিয় মাতৃভ‚মি বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্য কুয়েতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছেন সংবাদে প্রকাশ। কুয়েতের গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক তাকে মানব ও অর্থ পাচার সংক্রান্ত অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে। যদিও তার সহধর্মিণী (যিনি নিজেও একজন মহিলা সাংসদ) গ্রেফতারের খবরটি অস্বীকার করেছেন। ওই এমপির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা টেলিভিশন চ্যানেলে বলেছেন, তিনি এলাকায় তেমন পরিচিত নন, থাকেন কুয়েতে এবং সেখানে বড় ব্যবসা পরিচালনা করেন। গত নির্বাচনে তিনি হঠাৎ দেশে এসে মনোনয়ন সংগ্রহ করে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী অজানা কারণে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ালে তিনিই একাই নির্বাচিত হয়ে যান। পরে তার সহধর্মিণীও সংরক্ষিত মহিলা কোটায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন। প্রশ্ন হলো- একজন স্বল্প পরিচিত ব্যক্তি। যার কর্মস্থল কুয়েতে। তাকে কারা ভোট দিয়ে ‘নির্বাচিত’ করল? আর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হয়ে কিভাবে তিনি এই মহামারীর সময়ে দেশত্যাগ করে বিদেশে বসে ব্যবসায়ীক কাজকর্ম করছিলেন?
প্রকৃতপক্ষে রাজনীতি হলো রাজার নীতি অর্থাৎ ‘রাজাদের নীতি বা নীতির রাজা’। নীতির রাজা হিসেবে রাজনীতি হওয়া উচিত ছিল সমাজের, দেশের এবং বিশ্বের সেরা। কিন্তু আমরা দেখছি এর উল্টোটা ঘটছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরম্ভ করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলছে রাজনীতির নামে অপরাজনীতি। বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে বিশ্বজুড়ে দেখা যাচ্ছে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন বা দুর্বৃত্তয়ায়নের রাজনীতি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা রোহনের পদ্ধতি থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনায় অদ্যাবধি যা তিনি করেছেন, তা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনাকে আরো শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছে। তার পরিণতিতে আমেরিকায় সমাজ আজ স্পষ্টত ভীষভাবে দ্বিধাবিভক্ত। যদিও শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের এই বিষবৃক্ষ যুগ যুগ ধরে মার্কিনিরা পরিচর্যা করে আসছিল, কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেটাকে ফুলে-ফলে সুশোভিত করে তুলেছেন। করোনা মহামারী ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে পুননির্বাচিত হওয়ার মোহে তিনি দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছেন। বলাবাহুল্য তিনি একজন বিরাট ব্যবসায়ী এবং অগাধ সম্পত্তির মালিক। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ইতিমধ্যে আমৃত্যু ক্ষমতায় বহাল থাকার আইন করে ফেলেছেন। উইঘুরের মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বানিয়ে তাদের ওপর চরম নির্যাতন চালাচ্ছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনও আরো ছয় বছর ক্ষমতায় থাকার বন্দোবস্ত করেছেন। মিসরের জেনারেল সিসি নির্লজ্জভাবে দেশের ইতিহাসের প্রথমবারের মতো নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মুরসিকে মাত্র এক বছর শাসনের মাথায় সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজে ক্ষমতায় বসেছেন। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য আরব-ইসরাইল সংঘাত উস্কে দেয়া এবং তাকে জিইয়ে রাখার নীতিই মূলত পশ্চিম ভূ-রাজনীতির নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছেন। সেখানে ইসরাইলি রাজনীতিকরা ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর ধ্বংসযজ্ঞ চালানোকে ক্ষমতায় যাওয়া বা থাকার রাজনীতি হিসেবে ব্যবহার করছেন। এদিকে সৌদি আরবে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নেড়ে ভবিষ্যত ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করেছেন। এমনকি ক্ষমতার ভিতকে মজবুত করার উদ্দেশ্যে সংস্কারের নামে বিশ্বের প্রায় ১৬০ কোটি মুসলমানের হৃদয়ে লালিত ইসলামী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের ধারণাকে উলট পালট করে দিচ্ছে। দুর্বৃত্তপরায়ণ রাজনীতির চর্চা উপমহাদেশেও চলছে ব্যাপকভাবে। শ্রীলংকার উগ্র বৌদ্ধত্ববাদের উত্থানকে উস্কে দিয়ে রাজনীতিকরা ক্ষমতা পাকাপোক্ত করছেন। যার বলি সংখ্যালঘু মুসলমানরা। উগ্র বৌদ্ধত্ববাদের চরম উত্থান ঘটিয়ে মিয়ানমারের অসামরিক পোশাকধারী সামরিক সরকার প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে জাতিগত নিধনের মাধ্যমে দেশচ্যুত করে বাংলাদেশকে কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন করে দিয়েছে। বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী ভারতেও চলছে একই ধরনের রাজনীতি। অর্থনৈতিক সফলতায় ব্যর্থ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উগ্র হিন্দুত্ববাদের ওপর ভর করে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসেছেন। এরপর থেকে তিনি দ্বিগুণ উৎসাহে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিস্তার ঘটিয়ে চলেছেন। বিতর্কিত ‘নাকরিকপঞ্জি’ তৈরির মাধ্যমে আসামের মুসলমানদের দেশবিহীন করে বন্দি শিবিরে আবদ্ধ করার পদক্ষেপ নিয়েছেন। নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের নামে ভারতের মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করেছেন। সেই সাথে দীর্ঘদিনের লালিত ঐতিহ্যকে পদদলিত করার মাধ্যমে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত করে কাশ্মিরকে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গীভূত করেছেন। কাশ্মিরকে সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে মাত্র এক কোটি ৪০ লাখ নাগরিকের বিপরীতে ৯ লাখ সেনা মোতায়েন করে পুরো রাজ্যকে অত্যাচার-নির্যাতনে প্রকেষ্ঠ বা বৃহত্তর বন্দিশিবির বানিয়ে রেখেছেন। প্রতিদিনই সেখানে আজ মুসলিম নাগরিকরা নির্যাতন আর হত্যার শিকার। এসব জুলুম-নির্যাতন চালানো হচ্ছে শুধু রাজনীতির নামে, রাজনৈতিক নেতাদের তত্ত্বাবধানে।
বিশ্ব রাজনীতির দেউলিয়াপনার ঢেউ প্রিয় মাতৃভ‚মি বাংলাদেশেও এসে লেগেছে। আমাদের মহান নেতা, বাংলাদেশের স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বলেছিলেন, ‘সবাই পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি’, বিদেশ থেকে ৭ কোটি কম্বল এসেছে। আমার কম্বল কোথায়? রাজনৈতিক অরাজকতার সুযোগে অরাজনৈতিক আর নীতিবিবর্জিত ব্যক্তিরা এসে রাজনীতির ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে। একজন এমপি আজ বিদেশ বিভুইয়ে (কুয়েতে) গ্রেফতার হয়ে দেশকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে। অবশ্য এই বিরাজনীতিকরণ অর্থাৎ রাজনীতির নামে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের দিয়ে রাজনীতিকে কলুষিতকরণ প্রক্রিয়া অনেক আগেই শুরু হয়েছে আমাদের দেশে।
এরই ধারাবাহিকতায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কাছে ছাত্রনেতাদের কোটি টাকা চাঁদা দাবি, আবরার হত্যাকাÐ এবং ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির মতো ঘটনাও ঘটেছে। আর উঠে এসেছে পাপিয়া, জিকে শামীম এবং সম্রাটরা। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, এই করোনা মহামারীর সময় না খেতে পারা মানুষগুলোর মুখের খাবার পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছে অসৎ তৃণমূল জনপ্রতিনিধি।
দেশের বিভিন্ন জেলার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য, পৌর কাউন্সিলর মিলে ৯৪ জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
করোনা মহামারীতে সরকারের বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচির সুবিধাদি আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে এই সব জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে। তালিকায় চট্টগ্রামের কয়েজনের নামও রয়েছে। বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন দুদকের পরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য। দুদক সূত্রে জানা গেছে (২৭ জুন) তিনি জানান, কমিশনের অভিযোগ ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত মহাপরিচালক এ কে এম সোহেলের নেতৃত্বে যাচাই-বাছাই কমিটির সুপারিশের প্রেক্ষিতে কমিশন এই ৯৪ জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। এর মধ্যে ৩০ জন ইউপি চেয়ারম্যান এবং ৬৪ জন ইউপি সদস্য রয়েছেন। এসব জনপ্রতিনিধিদের ইতিমধ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছেন। দুদকের পরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বলেন, ৯৪ জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সরকারি ত্রাণ আত্মসাৎ, ভুয়া মাস্টার রোলের মাধ্যমে সরকারি চাল আত্মসাৎ, সরকারি ১০ টাকা কেজির চালক কালোবাজারে বিক্রি, জেলেদের ভিজিএফ-এর চালক আত্মসাৎ, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দরিদ্র্যদের সাহায্যের তালিকায় স্বজনপ্রীতি ও অনিয়ম, উপকার ভোগীদের ভুয়া তালিকা প্রণয়ন করে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির সামগ্রী আত্মসাৎ ইত্যাদি রয়েছে। (সূত্র : দৈনিক আজাদী ২৮ জুন)।
বাঙালির জাতির আন্দোলন সংগ্রামের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এ জাতি প্রতিবাদমুখী, কিন্তু জাতি মনে হয় আদর্শভিত্তিক রাজনীতি অনুকরণ ও অনুশীলন বিমুখ হয়ে পড়েছে। তবে জাতীয় স্বার্থে এর অবসান হতেই হবে। জনতার বিবেক অবশ্যই একদিন জেগে উঠবে ইন্্শা আল্লাহ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করে অনেক শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট