দুর্গতদের রক্ষা ও পুনর্বাসনে জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে

12

 

মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে সিলেট অঞ্চলে আবারও ভয়াবহ বন্যায় মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বৃহত্তর সিলেটজুড়ে এ ধরণের বন্যা ইতিমধ্যে আর দেখা যায় নি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সূত্রে জানা গেছে, প্রবল বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি প্রচন্ড পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। উল্লেখ্য, এটি চলতি মৌসুমের তৃতীয় দফা বন্যা। একের পর এক বন্যায় বিপর্যস্ত হচ্ছে এ অঞ্চলের অসংখ্য মানুষ, ঘরবাড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও গবাদিপশু। বন্যায় তলিয়ে গেছে উৎপাদিত কৃষি ফসল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যার প্রধান কারণ দেশের ভেতরে তো বটেই, একইসঙ্গে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বিভিন্ন রাজ্যে অতি ভারি বৃষ্টি। মূলত বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে তিনদিনের বৃষ্টিতেই তলিয়ে গেছে সিলেট বিভাগের প্রায় সব জেলা। জানা গেছে, গত তিন দিনে আসাম ও মেঘালয়ে ২ হাজার ৫০০ মিলিমিটারেরও বেশি বৃষ্টি হয়েছে, যা গত ২৭ বছরের মধ্যে তিন দিনে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। এমন পরিস্থিতিতে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ তো আছেই; উপরন্তু এরই মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা যেমন-বিদ্যুৎ স্টেশন ও সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পানি প্রবেশ করেছে। একই কারণে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রাইমারি, মাধমিক ও কলেজ পর্যায়ের অন্তত সাড়ে তিনশতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে উঁচু স্থান, স্কুল বা আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে। অনেক শিশু কিশোরদের বাড়ির টিনের ছালায় বসে দিন কাটাতে দেখা গেছে। অত্যন্ত বেদনাদায়ক এসব চিত্র দেশবাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। আমরা গণমাধ্যম সুত্রে জেনেছি, সিলেটের বন্যার ভযাবহতা এতটুকু গিয়ে পৌছেছে যে কোন গাড়ি বা বাহন নিয়ে উদ্ধার করা ত্রাণ দেয়ার ব্যবস্থা নেই। একমাত্র নৌকা, বোট বা স্পিড বোট দিয়ে পানিবন্দি মানুষগুলোকে উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণ করা যায়। ইতিমধ্যে সেনা বাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছে। এছাড়া রেডক্রিসেন্ট সহ বেশকিছু বেসরকারি সংস্থা সংগঠন উদ্ধোর কাজে সহযোগিতার কথা আমরা জেনেছি। বন্যা দুর্গত এলাকায় এসময়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা আশ্রয়, খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও কাজ। এ অবস্থায় বন্যাকবলিতদের উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা জোরদারের কোনো বিকল্প নেই। বন্যার সময় ত্রাণসামগ্রী বিতরণের একটা রেওয়াজ দেশে গড়ে উঠেছে। তবে এ ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা বন্যাকবলিত মানুষের জীবনে স্থায়ী কোনো প্রভাব ফেলে না। প্রায় প্রতিবছর ছোট-বড় বন্যায় আমাদের ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় নিয়ে এর প্রকোপ কমিয়ে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এ লক্ষ্যে নদ-নদীগুলোর নাব্য বাড়াতে হবে সর্বাগ্রে। আমাদের অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকান্ড ও অদূরদর্শিতায় একসময়ের খরস্রোতা নদীগুলো আজ জীর্ণ-শীর্ণ অথবা মরণাপন্ন অবস্থায় উপনীত হয়েছে। নদ-নদীগুলোকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে, টেকসই বেড়িবাধ নির্মাণ করতে হবে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক নদ-নদীগুলোর ব্যাপারে আমাদের অবস্থান ও দাবি আরও জোরালো করার লক্ষ্যে শক্ত কূটনৈতিক ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ ভাটির দেশ। উল্লেখযোগ্য নদীগুলোর উৎস দেশের ভূ-সীমানার বাইরে। অভিন্ন নদীগুলোর গতি-প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার ব্যাপারে প্রতিবেশী দেশ, বিশেষ করে ভারত ও নেপালের সঙ্গে এমন গঠনমূলক উদ্যোগ নেওয়া উচিত, যাতে তা ফলপ্রসূ হয়। যে কোনো দুর্যোগে সবার আগে মানবিক বিপর্যয়ের দিকগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। এজন্য বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর অসহায় মানুষ যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য, পানীয় ও আশ্রয় পায়, সে ব্যাপারে বিশেষ যত্নবান হওয়ার পাশাপাশি তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়েও নজর দেওয়া উচিত। বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসনের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। দুর্গতদের কৃষিকাজে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি সহজ শর্তে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা করা দরকার। গত ৫০ বছরে দেশে প্রচুর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ তৈরি হয়েছে। তবে বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে সরকার সাফল্যের পরিচয় দিতে পারছে না। সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব এবং অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ করতে না পারাই এর মূল কারণ। কাজেই কেবল বাঁধ দিলেই হবে না; একইসঙ্গে সেগুলোর ব্যবস্থাপনা সঠিক ও দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে। নদ-নদীগুলোর উৎপত্তি থেকে সমুদ্র পর্যন্ত দখল ও দূষণমুক্তকরণ, শাসন এবং বাঁধ নির্মাণসহ গোটা ব্যবস্থাপনা যদি আমরা সঠিক ও দুর্নীতিমুক্তভাবে করতে পারি, তাহলে বন্যার প্রকোপ হ্রাস পাবে বলে আশা করা যায়। একথা ভুলে গেলে চলবেনা যে, মৌসুমি বৃষ্টি মাত্র শুরু হয়েছে। আগামী জুলাই আগস্টজুড়ে বৃষ্টি হবে। সিলেটের সাথে ইতিসধ্যে চট্টগ্রাম ও বিভিন্ন জেলায় বন্যা-জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। সুতরাং সরকারকে এ দুর্যোগ মোকাবেলায় আরো বেশি সক্রিয় ও ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হবে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিত্তশালীরাও এগিয়ে আসলে দুর্যোগ মেকাবেলা করা অসম্ভব কিছু নয়।